বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ সামাজিক ও পারিপার্শিক চাপে ক্রমেই যেন হয়ে যাচ্ছে এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার, গড়ে উঠছে একক জগৎ।
বিশেষ করে শহরায়নের চাপে এখন মানুষ পাল্টে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে তার স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া। যা তাকে বানিয়ে দিচ্ছে এক রকম যন্ত্র। আর এই যান্ত্রিক জীবনের অন্যতম লক্ষ্যই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিযোগিতা। সব দিক থেকেই যেন নিজেকে সেরা দেখতে চাওয়াই এখন মূল লক্ষ্য।
কিন্তু সর্বক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা আমাদের মাঝে তৈরি করে দিচ্ছে একধরণের হতাশা এবং একাকিত্ব। যাতে এখন আক্রান্ত সারা পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ।
হতাশা ও একাকিত্বের রঙ : বিশ্বায়ন ও শহরায়নের কঠিন জীবনে কেউ হচ্ছে জয়ী আর কাউকে হতে হচ্ছে পরাজিত। জয়ীরা ওই জীবনে মানিয়ে নিলেও পরাজিতরা ভেঙে পড়েন চরম হতাশায়। অকারণে নিজেকে ছোট ভাবতে শুরু করেন। ফলে একসময় চরম হীনমন্যতায় ভুগে আত্মবিশ্বাস এসে দাঁড়ায় শূন্যের কোটায়।
আবার শধু কাজের ব্যস্ততাই নয়। আধুনিক জীবনে আনন্দ বিনোদনের অভাব, পারিবারিক ভাঙন, অর্থনৈতিক দৈন্যতা, বেকারত্ব, প্রেমহীনতা মানুষের মাঝে তৈরি করে দিচ্ছে একাকিত্বতা।
ফলে দিনদিন জীবনের স্বাভাবিক উজ্বল্যতা হারানো এইসব মানুষ হয়ে পড়ছেন রোগগ্রস্থ আবার অনেকে মাদকাসক্ত। কিন্তু এ বিষয়টি সম্পূর্ণ মানসিক হওয়ায় আক্রান্তরা অনেক সময় এর সম্পর্কে ঠিক মতো বুঝেও উঠতে পারেন না।
হতাশার পরিনাম : হতাশার পরিণতি সবসময়ই নেতিবাচক। হতাশা মানুষের জীবনে শুধু কষ্টই ডেকে আনে, কোনো সাফল্য নয়। কিন্তু কিভাবে এই রোগ ধিরে ধিরে দখল করে নিতে থাকে মানুষের শরীর!
গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের মস্তিষ্কই তার সকল চিন্তা-ভাবনা আর আবেগের স্থান। মস্তিষ্কই নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের যাবতীয় মানসিক বিষয়। এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য শিরা-উপশিরা আর স্নায়ু।
মন খারাপ বা অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তায় থাকলে এই স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে অন্য অঙ্গগুলোর উপর যেমন, শরীর তার স্বাভাবিক কাজের গতি হারায়, ত্বক রুক্ষ হয়ে উঠে এবং বলিরেখা দেখা দেয়। এমনকি চুল পড়াও শুরু হয়।
এতো গেলো শরীরের বাহ্যিক প্রভাবের কথা। কিন্তু মানসিক হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা শরীরের ভেতরে প্রভাব ফেলে আরও গভীর ভাবে। দেখা গেছে, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় ফলে এতে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। যার অনিবার্য পরিনাম হার্টের অসুখ। এমনকি এ কারণে হার্ট অ্যাটাকও হয়।
আনন্দে থাকুন : বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান মোটিভেটর ও লেখক ডেল কার্নেগি বলেছেন, ‘মানুষের জীবন একটাই। তাই আমাদের উচিত এটিকে সর্বোচ্চভাবে উপভোগ করা।’ কিন্তু সময়ের ক্রমবর্ধমান চাপ ও বিশ্বায়নের এই যাতাকল থেকে বাঁচা সত্যিই সহজ নয়।
তবে এর জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি আপনি অবলম্বন করতে পারেন। মনোবিজ্ঞানীরা যেটিকে বলেন সেলফ মোটিভেসন। প্রতিদিন নিয়ম করে ঘুম, কাজ, চিত্ত বিনোদন ও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে থেকে এই হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকতে পারেন।
মোট কথা জীবনকে নতুন করে ভাবতে শুরু করুন। বিপদে মনোবল না হারিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজের শপথ নিন। কখনোই নিজেকে ছোট ভাববেন না। মনে রাখবেন যে ব্যাক্তি যত উৎফুল্ল, তার কাজ করার ক্ষমতা তত বেশি। আর চলার পথে মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট আসবেই। সেগুলোকে অতিক্রম করার সাহস রাখুন।
সুখের পরিধি : মানুষ যে কখন কিসে সুখী হয় তা বলা মুশকিল। তবে যিনি সর্বদা নিজেকে সুখী ভাবেন আসলে সেই সবচেয়ে সুখী মানুষ। এর জন্য মনোবীদরা একটি অন্যন্য উপায়ও বের করেছেন।
তারা সকলকে পরামর্শ দিয়েছেন সবসময় প্রাণ খুলে হাসার। কারণ হাসলে মানুষের মন ভালো হয়। আর বিষন্নতা পালায় হাজার মাইল দূরে।
এজন্য মনোবিজ্ঞানীরা সকলকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট প্রাণ খুলে হাসার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও আরও কিছু উপায়ে হয়তো আপনি আনন্দে থাকতে পারেন। যেমন- শত ব্যাস্ততার মাঝেও অন্তত সপ্তাহের একটি দিন বা একটি ঘণ্টা প্রিয়জনের সঙ্গে কাটান। তাদের নিয়ে বেড়াতে যান কোনো পছন্দের জায়গায়।
এছাড়া অবসরের সময়গুলোতে পরিবারের সকলকে নিয়ে টিভিতে পছন্দের কোনো অনুষ্ঠানও দেখতে পারেন। রাতে ভালো কোনো গল্পের বইও পড়তে পারেন। সিনেমা হলে গিয়ে স্বপরিবারে বা বন্ধুদের নিয়ে দেখে আসতে পারেন ভালো কোনো চলচ্চিত্র।
অবসরে বাড়ির বারান্দায় বা আঙ্গীনায় বাগানও করা যেতে পারে। অনেকেই আর্থিক বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন। তারা বিপদে কাজে লাগাতে প্রতিদিন অল্প অল্প করে সঞ্চয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন।
সর্বোপরি হতাশা আর দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে মনে রাখতে হবে আপনি যেমনই হন না কেন আপনার মত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ কোথাও নেই। পৃথিবীকে দেবার মতন আপনার কাছে এখনও অনেক কিছুই বাকি। তাই নিজেকে অহেতুক অন্যের চেয়ে ছোট না ভেবে নিজের মত করে বাঁচুন এবং আনন্দে থাকুন।
সুত্র :