মক্কায় আগমন
আমরা ল্যান্ড করেছিলাম স্থানীয় সময় সকাল ১০ টায়। জেদ্দা বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে বেশী সময় লাগল না। দেখলাম স্কুল পড়ুয়া বেশ কিছু ছেলে হজ্ব যাত্রীদের কাগজপত্র চেকিং এর কাজ করছে। বুঝলাম হজ্ব উপলক্ষ এদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিমান বন্দর থেকেই দেখতে শুরু করলাম নানা রঙ এর নানা বর্ণের মানুষ। এতদিন টিভির পর্দায় নানা বর্ণের মানুষ দেখেছি, আর আজ সামনা সামনি দেখছি। মানুষের মহা মিলনমেলার নামইতো পবিত্র হজ্জ্ব।
জেদ্দা বিমান বন্দরের ছবি অনেকেই দেখেছেন, সেই তাঁবুর মত শেপ। তবে নতুন যেটা আমি যোগ করতে চাই এখানে প্রচুর বাতাস, গা জুড়িয়ে যায়। বাংলাদেশী হাজ্বীদের জন্য আলাদা জায়গা আছে টার্মিনালে, আমরা গিয়ে সেখানে দাঁড়ালাম। আমাদের ঠিক সামনেই ছিল পাকিস্তানীদের জায়গা। ওখানে আমরা প্রায় ৪ ঘন্টা ছিলাম। এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভাল, জেদ্দা বিমান বন্দরের এই সময়টাতে অবশ্যই গ্রুপের সাথে থাকতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় সাথে সাথে ওখানকার একটা মোবাইল সীম কিনলে। হাজ্বীরা মোবাইল সীম এমনিতেই কিনেন, তবে সেটা জেদ্দা বিমান বন্দরে কেনাই সবচেয়ে ভাল। টার্মিনালে বাথরুম, টয়লেট, ওযু এমনকি গোসলের ভাল ব্যবস্থা আছে। ঠিক এই টয়লেট গুলোর আশপাশেই দেখবেন কিছু বাংগালী ছেলে ঘোরাঘুরি করছে। এদের কাছেই সীম পাওয়া যাবে, তবে একটু দামাদামী করে নেয়া ভাল। আমি 'মোবাইলী' কোম্পানীর সীম কিনেছিলাম ৮০ রিয়াল দিয়ে, কিন্তু পরে শুনেছি অনেকে ১০০ রিয়াল দিয়েও একই সীম কিনেছেন।
টার্মিনাল থেকে এজেন্সীর ভাড়া করা বাসে করে আমরা রওনা দিলাম মক্কার পথে। মরুর বুকে একটু পর পরই সবুজ গাছপালা চোখে পড়ে। কিন্তু কেমন বেখাপ্পা, বেমানান। যেন জোর করে রুক্ষ মরুভূমিকে সবুজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা জোশের সাথে 'তালবিয়া' পড়ে যাচ্ছিলাম, 'লাব্বায়ক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক'। ২ ঘন্টা পর মক্কার প্রবেশ মুখে চেকপোষ্টে দাঁড়ালো গাড়ি। এখানে সৌদী সরকারের পক্ষ থেকে কিছু খাদ্য সামগ্রী দেয়া হল মেহমানদারীর নিদর্শন হিসেবে। এক লোক বাসে উঠে উর্দুতে বেশ বয়ান করে গেল, পরে বাসেই জানতে পারলাম সে বাংগালী। খুব রাগ হল, পরে অবশ্য জেনেছি এর মধ্যে কাহিনী আছে। এর মূলত: রোহিঙ্গা, সৌদী আরবে রাজনৈতিক আশ্রয়ে এসেছে। এক শ্রেণীর কুলাঙ্গার আদম ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় (বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে) এরা আসে পবিত্র নগরীতে। তারপর হেন কুকাম নেই যা এরা করে না। কিন্তু বদনাম ঠিকই হয় বাঙালীদের।
মক্কায় পৌছে প্রথম কাজ হোটেলে ওঠা। আমাদের এজেন্সী থেকে দু জায়গায় হাজ্বীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, 'এ' ক্যাটাগরীর হাজ্বীদের জন্য মিসফালায় একটা হোটেলে, আর 'বি' ক্যাটাগরীর হাজ্বীদের জন্য বাদশার বাড়ির উত্তর দিকে পাহাড়ের উপরে একটা বাড়ীতে। আমি ছিলাম 'বি' ক্যাটাগরীর, রুমে গিয়ে জায়গা বুঝে নিতে নিতে রাত ৭/৮ টা বেজে গিয়েছিল। এখানে বলে রাখা দরকার, হাজ্বীদের জন্য খুব 'শক্' খাওয়ার জায়গা হচ্ছে এই সময়টা। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দুস্তর ব্যবধান এখানে চোখে পড়বে। অপ্রশস্ত থাকার জায়গা, বাজে টয়লেট, অপর্যাপ্ত খাবার- সব মিলিয়ে অনেক সমস্যা হয়। আমাদের যারা মিসফালায় উঠেছিল, তাদের রুম গুলো ছিল খুবই ছোট, টয়লেট তো আরো ছোট। কয়েকজন দেখলাম ওখানেই তর্ক জুড়ে দিয়েছেন এজেন্সী মালিকের সাথে। কিন্তু এসব তর্কে কোন ফায়দা নাই, মক্কায় হজ্বের সময় রেডিমেড কোন থাকার জায়গা পাওয়া যায়না।
আমাদের থাকার জায়গা ছিল একটি চার তলা বাড়ী, যেটা মূলত: ফ্যামিলী বাসা ছিল। হজ্বের সময় বাড়তি ইনকামের জন্য মালিক অন্য জায়গায় চলে গেছে। রুম গুলো বড়, আমরা এক রুমে ৫/৭ জন থাকতাম। বাথরুম গুলো চমৎকার! বাথটাব পর্যন্ত আছে। রান্নার জন্য স্থানীয় বাংগালী বাবুর্চী ছিল। আমরা আগাগোড়াই বাঙালী রান্নাই খেয়েছি। এদিক দিয়ে ভাগ্যবানই বলতে হবে নিজেদের। ও হ্যাঁ, একটা সমস্যা ছিল বাসাটার। হারাম শরীফ থেকে অনেক দূর, প্রায় ১ কিলো- সেটাও বেশ খাড়া পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে উঠতে হত।
রাতের খাবার খেয়ে আমরা উমরার প্রস্তুতি শুরু করলাম....