ঘুম থেকে উঠেই ছোট ছোট ব্যস্ততায় জড়িয়ে যাওয়া আমার জন্যে নিত্যনৈমিত্তিক....। এর পর এক কাপ চা আর একটু মুড়ি নিয়ে খবরের কাগজের অন্তত শিরোনামগুলোয় চোখ তাড়িয়ে নিয়ে ঝটপট তৈরী হয়ে কাজে বেরিয়ে যাওয়া- এটা প্রায় রুটিনের পর্যায়ে।
চা হাতে দরজার ওপাশ থেকে খবরের কাগজ তুলে নেবার সময় একটি ছোট্ট চিরকুট পাওয়া গেল যাতে এভাবে লেখা আছে " ছরি ম্যাডাম, আপনার ওরকিড গাছের একটা ফুলও আর নাই। কেহ বা কাহারা চুরি করিয়া নিয়া গেছে।"
উহঃ! এই 'আর নাই' জাতীয় দু:সংবাদ খবরের কাগজ ছাপিয়ে এবার চিরকুটে এবং তা আমার ভাগ্যে? মুহূর্তেই মেজাজ বদলে গেল (প্রিয় অরকিড হারানোর বেদনা আর এলোমেলো অক্ষরে অসাধারণ বাংলায় লেখা আমার মালী বেচারার দায়িত্বশীল চিরকুটের কৌতুক মিলেমিশে যে ভীষন অনুভূতি হলো তার নাম আমার জানা নেই)।
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ আর বিশুদ্ধ ক্ষোভ নিয়ে দরজার বাইরে পা বাড়াতেই ইন্টার-কমে ফোন বেজে ওঠে:
হ্যালো! (নিজের কন্ঠস্বর নিজের কানেই কর্কশ ঠেকলো)
গুড মন্নিং ম্যাডাম, আমি ইব্রাহিম! (আর কোন কথা নেই)
হুম বলেন ইব্রাহিম! (আমার ঠান্ডা হিম কন্ঠস্বরে অনভ্যস্ত বেচারা ইব্রাহিম খানিকটা অপ্রস্তুত স্বরে যুক্ত করলো, ছ'টা গোলাপ গাছে একটা গোলাপও নেই)
আমি আসছি নীচে আপনি থাকেন। (দুঃখে- বেদনায় চোখ দু'টো আমার ভিজে উঠলো)!
লিফ্টে বন্দী হতে মন চাইলো না বরং ছটফটিয়ে সঁিড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। পায়ের চটির ক্রমশঃ বেড়ে চলা শব্দে নিজেই লজ্জা পেয়ে সামলে নিই নিজেকে।
হিমায়িত ইব্রাহিম আমার চোখের সামনে। আমার মত তাকেও বেশ আহত মনে হচ্ছে। আমার ক্ষোভের তীব্রতা হেরে গেলো ওর নিরব সমবেদনায়।
এটা কিভাবে হলো ইব্রাহিম? আমার হাত দুটো পরম মায়ায় প্রিয় গাছগুলো ছঁুয়ে চলে কেবল......। গাছগুলোও কি কষ্ট পাচ্ছে না সৌন্দর্য হারিয়ে?
গুড মর্নিং আন্টি- ছুটে এসে আমায় দু'হাতে জড়িয়ে ধরে প্রতিবেশী ছয়-সাত বছরের ফুটফুটে মেয়েটি।
গুড মর্নিং সোনামনি! তুমি আজ স্কুলে যাওনি?
না- না, আজকে তো আমার দাদুভাইয়ের হ্যাপি বার্থডে- তুমি জানো না?
ও, তাই নাকি? তা হলে তো খুউ-উ-উব মজা হবে?
হ্যাঁ তো! আজকে আমার দাদুর সেভেনটি টু ইয়ার্স হবে জানো? দাদু অনে--ক বড় হয়ে যাবে। তাই মা আর বাবাও আজকে বাইরে কোথাও যাবে না। আমি আর ভাইয়া অনেক বেলুন হ্যাং করে দাদুর রুম ডেকরেট করেছি। ঘুম থেকে উঠে দাদুতো অবাক হয়ে যাবে- আ' অ্যাম শ্যিয়র.....। আরও অনেক কিছু বলতে চায় ও....।
ওর খুশি আরো একটু বাড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে আদর করে বলি, 'শোনো আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে, বিকেলে আমি তোমার দাদুকে উইশ করতে আসবো।
ও-কে! তা হলে তো তোমাকে শপিং-এ যেতে হবে। তুমি দাদুর জন্য কি গিফ্ট কিনতে চাও আন্টি? (কি অসম্ভব নির্দোষ মিষ্টি একটি প্রশ্ন!)
তাই তো! আমার মনে হয় অনেকগুলো লাল গোলাপ আমি কিনতে পারি।
আমার এমন একটি উপহারের আকাংখায় ও খানিকটা নিভে যায়- সাথে সাথেই বলে ওঠে,
না- না! আমিইতো দাদুকে ফুল দিয়ে উইশ করবো। জানো, আমি না এই এখান থেকে অ---নে--ক ফুল তুলে নিয়ে নিজে হাতে একটা বি--উটিফুল 'বুকে' বানিয়ে দাদুর বেডের পাশে রেখে দিয়েছি চুপিচপি। দাদু ঘুম থেকে জেগে ওটাই প্রথম দেখতে পাবে। তুমি কিন্তু এসো, বা-বাই আন্টি..। ছুটে চলে গেল মিষ্টি মেয়েটি।
আমার মন ভালো হয়ে যায়- অসম্ভব আনন্দে আমার হাত দু'টো প্রিয় গাছগুলো ছঁুয়ে যায় কৃতঞ্গতা আর মমতায়.....। ওদের পাতাগুলো কেমন চকচকে সবুজ হয়ে ওঠে! যেন ওরা সবই শুনেছে, সবই বুঝতে পেরেছে।
আমি মনে মনে দেখতে পাই, একটি ফুলের মত শিশুর বিজয়ী হাসি আর একজন বাহাত্তর বছর বয়সী যুবকের একজোড়া বিজয়ী, উজ্জল চোখ আর নির্মল হাসি।
পৃথিবী কি অসম্ভব সুন্দর, আনন্দময়.......।