আচ্ছা! আপনি কি হাত দিয়ে খান?
বলে কি লোকটা! হাত দিয়েই তো খাবো। পা দিয়ে কেউ খায় নাকি?
আরে ভাই চেতেন কেন? পা দিয়ে না খেলেও চামচ দিয়ে তো অনেকে খায় তাই না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বড়লোকের বিরাট কারবার! ওদের কথা ধরে লাভ আছে? আমরা পেটের দায়ে খাই। অত বড়লোকি বুঝিনা। হাত দিয়েই খাই। তো? ......
ক্ষুধার্ত কোন লোকের সামনে সাহিত্য চর্চা করতে যাবেন না। ঘুরিয়ে কিছু বলতে বা রসিকতা করতে যাবেন না। কপালে খারাবি থাকতে পারে। আগে তাকে কিছু খেতে দিন। তার পর সাহিত্য চর্চা করেন আর বিজ্ঞান চর্চা করেন সম্ভবতঃ কোন সমস্যা হবে না। তবে খাওয়াটা যেন তার মনের মত হয়। শ্রেণী ভেদে, কালচার ভেদে একেক জনের খাওয়া দাওয়া একেক রকম।
ভিন্ন কালচারে শুধু ভিন্ন খাদ্যই নয় বরং খাবারের ধরনও আলাদা হয়ে থাকে। ওগুলো কোন বড়লোকি ঠাট বা লোক দেখানো কোন বিষয় নয়। ওদের জীবনের অনুষঙ্গ। কোন চাইনিজ, ইউরপিয়ান বা আমেরিকানকে হাত দিয়ে ভাত খেতে বলুন তরকারি সহযোগে। তার পর দূরে দাঁড়িয়ে দেখুন - তামাশা! অনেকে হয়তো পারবেই না।
পেটের দায়ে জীবন রক্ষার্থে আমরা খাওয়া দাওয়া করি। আবার অনেক সময় শুধু শখের বশেও আমরা খাই। জীবন ধারণটা যেখানে মুখ্য থাকেনা। তবে পেটের ক্ষুধায় খাই আর ভরপেটে, যায় তো সেই একই যায়গায়। নাকি? তাহলে এই খাওয়াতে এত রকম ফের কেন?
কেন ইউরোপিয়ানরা খাবারের সময় চামচ, কাঁটাচামচ, ছুরি ব্যবহার করে?
কেন বাঙ্গালী, ইন্ডিয়ান বা মালায়'রা নগ্ন হাত ব্যবহার করে?
চাইনিজরা তো আরও আশ্চর্য! ওরা কেন ব্যবহার করে আধ হাত লম্বা দুইটা কাঠি?
চলুন আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাই। চমৎকার আর যুক্তিযুক্ত বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে সেখানে।
ইউরোপিয়ানরা আজ যেমন ফর্ক স্পুন আর নাইফ ব্যবহার করছে খাবার খেতে। এটা ওরা সেই আদিকালেও করতো যখন ওরা সাগর পাড়ে বা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। তবে কিছুটা ভিন্ন ভাবে। তরল কিছু খেতে গিয়ে ওরা দেখলো, বড় ঝামেলা তো! হাত দিয়ে ধরা যায়না পড়ে যায়। মুখ দিয়ে কামড়ানো যায়না শুধু জিহ্বায় একটু লাগে। তখন ওরা সাগর পারে ঝিনুক খেতে গিয়ে ভাবলো এর খোলসটা তো ঐ জিনিস তুলে খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা যায়! সেই সাগর কূল থেকে কুড়িয়ে নেয়া ঝিনুকের খোলসটাই কাল ক্রমে স্পুন বা চামচে রূপান্তর হয়।
ঐতিহ্যগত ভাবে এই উপমহাদেশীয়রা এমনকি মালয়েশিয়রা সহ অধিকাংশ মুসলিম দেশের অধিবাসীরা ক্ষুন্নিবৃত্তির কাজে খালি হাত ব্যবহার করে, অন্য কোন যন্ত্রপাতি ছাড়াই। এটা এমন নয় যে বিদেশীদের না পছন্দ অথবা ঐ সমস্ত বিদেশী যন্ত্রপাতি(!) কেনার সামর্থ হীনতা। বরং দেখা যাবে এর অনেকটাই ধর্ম বিশ্বাসের সাথে গভীর ভাবে সম্পর্ক যুক্ত।
প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক বিশ্বাস অনুযায়ী খাদ্য শুধু মাত্র দেহের জন্য নয়, মন এবং আত্মার জন্যও বটে। এবং হাতকে মনে করা হয় এই মহৎ কর্মটি করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অঙ্গ। এর সাথে আরও কিছু বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। যেমন মনে করা হয়, স্থান, বায়ু, আগুন, পানি ও পৃথিবী এই পঞ্চভূতের প্রতিনিধিত্ব করছে আমাদের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল। আর এই পাঁচ ভূতের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খাদ্য মানব দেহাভ্যন্তরে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যে কারনে বৈদিক বিশ্বাস অনুযায়ী খাবারের সময় কব্জি অথবা হাতের তালু খাবার স্পর্শ না করিয়ে শুধু পাঁচ আঙ্গুল ব্যবহার করতে বলা হয়।
মুসলিম রীতিতে শুধু যে হাতে খাবার খেতে বলা হয় তাই না, ডান হাতে খাবার খেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। (স্যুপ বেজড খাবার হলে চামচ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা নেই।) বাম হাত ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারন বাম হাতকে নির্দেশ করা হয় প্রাকৃতিক ক্রিয়া কর্ম (যেমনঃ শৌচ কর্ম ইত্যাদি) সম্পাদনে জড়িত অঙ্গ হিসেবে।
চাইনিজরা খায় দুইটা কাঠি (চপস্টিকস) দিয়ে। কাঠি দিয়ে আবার লোকেরা খায় কি করে! এটা কোন ধরনের বিলাসিতা? আদৌ বিলাসিতা কিনা? অথবা এর কোন যুক্তি আছে কিনা? হাজারো প্রশ্ন থাকতে পারে এ নিয়ে।
যিনি কখনো চপস্টিক দেখেননি বা ব্যবহার করেননি তাঁকে খাবারের টেবিলে শুধু বসেই থাকতে হবে অথবা বসে বসে অন্যদের খাওয়া দেখতে হবে। খাওয়া তার কপালে জুটবে না। এবং তার কাছে এটা অযৌক্তিকই মনে হবে।
পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ইউরোপিয়ানরা চামচ, কাঁটাচামচ, ছুরির ব্যবহার শুরুরও অনেক আগে থেকেই চাইনিজরা এই কাঠির ব্যবহার শুরু করেছিল।
চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের সময় (৫৫১-৪৪৭ খৃষ্টপূর্বাব্দ) এর ব্যবহার আরো প্রসার লাভ করে, আরো জনপ্রিয়তা পায়। কনফুসিয়াসের ভদ্রতা, নম্রতা আর দয়াশীলতার শিক্ষা আর আদর্শে কাঁটাচামচ বা ছুরির মত অন্যকে আক্রমণ উপযোগী উপকরণ ব্যবহার সমর্থন করেনা। তার বিপরীতে চপস্টিক সর্বোত্তম কাটলারি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে তারা আমাদের মত খালি হাত কেন ব্যবহার করলো না? এ তো আরো অহিংস।
প্রকৃত পক্ষে চাইনিজ ডিশগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন প্রকারের সসে ডুবানো অথবা কম বেশী সসে চুবিয়ে পরে খেতে হয়। সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত। হাতে খেতে গেলে পুরো টেবিলে ফোঁটা ফোঁটা তরল পদার্থ পরে বিশ্রী একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। চপস্টিক ব্যবহারে এর সব ঝামেলা থেকে মুক্তি। দুই কাঠিতে আলতো করে ধরো, সসে ডুবাও, টেনে নিয়ে মুখে পুরে দাও। তুলনামূলক যে কোন কাটলারির চেয়ে বেশী হাইজিনিক। তবে যেমনটা আগে বলেছি, প্র্যাকটিস না থাকলে ......
প্র্যাকটিস করবেন কেহ? আপাতত ছবি দেখে দেখে করতে থাকুন। পরবর্তীতে এ নিয়ে একটা পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:২৬