পূর্বেই বলা হয়েছে যে, জেরুজালেমে ইহুদীরা রোমানদের আক্রমনে বিতারিত হয়। পরর্বতীতে রোমানদের আক্রমনে বিধ্বস্ত ইহুদীরা ইউরোপের বিভিন্ন ভূখন্ডে ছড়িয়ে পরে এবং নিবাসিত জীবন যাপন শুরু করে। তাদের এই নির্বাসিত জীবনকে বলা হয় Diaspora. এই নির্বাসিত জীবনে তারা কোন দেশেই মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে একীভূত হতে পারেনি। পুজীবাদী রাষ্ট্রগুলোতে ইহুদীরা সর্বক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখলেও এদের জীবন পরিচালিত হতো মূলধারার বাহিরে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা বস্তিতে এবং শহরের উপকন্ঠে বাস করত। এগুলোকে 'ঘেটো' বলা হতো। এই নির্বাসিত জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইহুদীরা যে আন্দোলন তৈরী করে তাকে জায়ানবাদী বা ইহুদীবাদী আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করা হয়। বস্ত্তত 'জায়ান' হল একটি পাহাড়। জেরুজালেমের 'জুডাহ' পাহাড়। এই জায়ন পাহাড়ের পাদদেশে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদীরা এসে নিজেদের আবেগকে প্রশমিত করে, কান্না করে। তারা এখানে ফিরে আসতে চায়। এই পাহাড়ের নামে এই আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে 'জায়ানবাদী আন্দোলন' বা Zionism. জায়ান পাহাড়ে ফিরে আসার অনুভূতি বা উচ্ছাস থেকে জায়ানবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত।
জায়ানবাদীদের ধারণা অনুসারে জেরুজালেম হল তাদের OPromised land এই Promised land এ ফিরে আসার ধারণা ইহুদীদের মন থেকে কোনদিনই মুছে যায়নি। নির্বাসিত জীবনের বিভিন্ন ভূখন্ডে তাই তারা ধর্মীয় জায়ানবাদী মনোভাবকে লালন করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কিছু সংখ্যক ইহুদী প্যালেষ্টাইন ভূখন্ডে ফিরে এসে জেরুজালেম, সাফেদ এবং ত্রিবেরীতে বসবাস শুরু করে। ইতিহাসে এদেরকে Halukah বলা হয়। জায়ন পর্বতে ফিরে আসা এই আকাঙ্খাকারী জায়ানদের মধ্যে রাশিয়ার ইহুদীরাই ছিল অগ্রগণ্য। পূর্ব ইউরোপের ইহুদীরা তাদের অনুসরণ করে। মনে রাখা দরকার, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের ইহুদীরা সেদেশের সরকার কর্তৃক অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। এখান থেকে পালিয়ে একদল ইহুদী 'ওড়েসায়' তাদের কলোনী গড়ে তোলে। এখানে জায়ানদের প্রথম সংগঠন Lovers of Zionism গড়ে উঠে। এই সংগঠন ১৮৮২ সালে প্যালেষ্টাইনে একটি জায়ন কলোনী গড়ে তোলে। একই সময়ে জুডিয়া, সামারিয়া ও গ্যালিলিতে আরো কতকগুলো বসতি গড়ে ওঠে। ঐই কলোনীগুলোতে বসবাসরত ইহুদীদের অধিকাংশ রাশিয়া, রোমানিয়া, গ্যালিসিয়া থেকে আগত। পশ্চিমা ধনী ইহুদীরা এই বসতি স্থাপনে সহায়তা করতে থাকে। এদের মধ্যে Baron Rothschild এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্য আরেকটি ইহুদী কলোনী সংগঠন Baron Hiz এর নেতৃত্বে বসতি স্থাপনে এগিয়ে আসে। তারা প্যালেষ্টাইনে আরবদের কাছ থেকে জমিজমা কিনতে থাকে এবং আগত ইহুদীদের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও মূলধন দিতে থাকে।
জায়ানবাদী দর্শনকে রাজনৈতিক রুপ দিয়েছিলেন বুদাপেস্টের একজন সাংবাদিক ডঃ থিওডোর হাজের্ল। ১৮৯৬ সালে তিনি Judenstat নামে একটি বই লিখেন। এই গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন (it) O....(it) is a question National which can be solved only by making it a political world question to be discussed and settled by the civilized Nations of the world in councilO. ১৮৯৭ সালে হার্জেল জায়ানবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে প্রচার করার জন্য Diewelt নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকেন। একই বৎসরের আগষ্ট মাসে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে তারই প্রচেষ্টায় প্রথম জায়ানবাদী কংগ্রেস আহবান করা হয়।
এই সম্মেলনের সিদ্বান্তগুলো হলোঃ
১. প্যালেষ্টাইনে ইহুদীদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা।
২. ইহুদীদের জাতীয় গৌরব ও আকাঙ্খাকে লালন ও শক্তিশালী করা।
৩. ইহুদী কৃষিজীবি ও শ্রমিকদের সাহায্যে প্যালেষ্টাইন ইহুদী উপনিবেশ তৈরী করা হবে।
৪. ইহুদী আন্দোলনকে প্রচার করার জন্য বিশ্ব জায়ানবাদী সংস্থা (WZO) গড়ে তোলা।
এর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন থিওডোর হার্জেল। এই লক্ষ্যে হার্জেল প্যালেষ্টাইনে ইহুদীদের বসতি স্থাপনের জন্য অটোম্যান সুলতানের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়। এই কাজে জার্মানী অটোম্যান সাম্রাজ্যের বন্ধু হিসাবে WZO কে সমর্থন দেয়। জার্মানীকে Protectorate হিসাবে বিবেচনা করার অঙ্গীকার করা হয়। ১৯৩০ সালে দলে দলে ইহুদী রাশিয়া থেকে প্যালেষ্টাইনে আসতে শুরু করে। হার্জেল এ বিষয়ে বৃটিশ সরকারের সাথে আলোচনা করেন। বৃটিশ সরকার উগান্ডাতে ইহুদীদের বসতির জন্য জায়গা নির্ধারণ করেন। কিন্তু রাশিয়ার ইহুদীরা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া ১৯০৪ সালের WZO সম্মেলনে বলা হয় যে, প্যালেষ্টাইন ছাড়া অন্য কোন দেশে তারা নিজেদের বসতি মেনে নিবে না। ১৯০৪ সালে হার্জেল মারা যাবার পর এই আন্দোলন আরো বেগবান হয়। অধিক সংখ্যক ইহুদী WZO সদ্স্য পদ লাভ করতে থাকে। এমনকি এটি একটি আন্দোলনে রুপ লাভ করতে থাকে। The Jewish National Fund এই আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা করতে থাকে। তারা প্যালেষ্টাইনে আরবদের জমি কিনতে থাকে। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরী হয় Palestine Foundation Fund পৃথিবীর সর্বত্র সংগঠনগুলো কাজ করতে থাকে। রাশিয়ার জারদের অত্যাচার থেকে পালিয়ে এই সমস্ত ইহুদী আমেরিকায় স্থান গ্রহন করেছিল। আমেরিকার ইহুদীদের মধ্যে স্পেনীয় ও জার্মান ইহুদীও ছিল।
একথা সত্য যে, জায়ানবাদী আন্দোলন সব সময় সরল রেখায় অগ্রসর হয়নি। ইহুদীদের মধ্যেও এই আন্দোলনের বিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। ইউরোপের অধিকাংশ ইহুদী এটিকে ইহুদী ধর্মের মূল্যোবোধের বিরোধী বলে মনে করত। সমাজবাদীরা এবং পরবর্তী কালে কমিউনিষ্টরা জায়ানবাদী আন্দোলনকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া আন্দোলন হিসাবে দেখত। কোন কোন ইহুদী 'রাব্বী' রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে জায়ানবাদী আন্দোলন থেকে দূরে থাকত। তারা বিশ্বাস করতেন যে, 'জায়ান' হলো ধর্মীয় মতবাদ। এর সাথে জাতীয়তাবাদের কোন সর্ম্পক নেই। তারা মিলে মিশে সকল সমাজে বসবাসের পক্ষপাতি ছিলেন। বৃটেনের ইহুদীরা অর্থনৈতিক ভাবে সহতোগিতা করলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনিহা প্রকাশ করে। কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জায়ানবাদী আন বৃটিশ সরকারের অনুকম্পা লাভ করে। তখনও বৃটেনের অধিকাংশ ইহুদী রাজনৈতিক জায়ানবাদী দর্শনের বিরোধী ছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকায় একই ধরনের মনোভাব সম্পন্ন ইহুদীরা বসবাস করত। জায়ানবাদীর পক্ষে বিপক্ষের মনোভাব প্যালেষ্টাইন সমস্যার একটি বিশেষ দিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়ানবাদী আন্দোলনের নেতা ডঃ ওয়াইজম্যান এ আন্দোলনকে বৃটিশ লর্ডস সভায় উল্লেখযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করেন। সাথে সাথে তারা তাদের বৃটিশ জাতীয়তাবাদী চরিত্রকেও রক্ষা করার অঙ্গীকার করেন। বস্তুত ১৯১৭ সালের বিখ্যাত 'বলফোর ঘোষণা' আনুষ্ঠানিক ভাবে ইহুদী রাষ্ট্রের অস্থিত্ব স্বীকার করে। জায়ানবাদী ইতিহাসে এই ঘোষণা একটি নতুন অধ্যায়ের সুচনা করে। এই ঘোষণার পর প্যালেষ্টাইনে একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এখন থেকে জায়ানবাদী আন্দোলন কেবল ধর্মীয় প্রচারণার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয় বরং মিশনারীদের একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যায়।
ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত পদক্ষেপ গৃহীত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। জায়ানবাদী আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরর্বতী প্যারিস শান্তি সম্মেলনে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে। জায়ানবাদীরা এ সম্মেলনে প্যালেষ্টাইনে জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। সম্মেলনে তাদের প্রতিনিধি আহবান করা হয়। ম্যান্ডেট শাসনের অধীনে ইহুদী বসতী স্থায়ী করার জন্য ১৯২০ সালের সানরেমো সম্মেলনে বৃটিশ সরকার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। এখন থেকে চীম ওয়াজম্যানের সভাপতিত্বে প্যালেষ্টাইনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সামরিক ও বেসামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ইহুদীদের অব্যাহত সংখ্যাধিক্যে আরব-ইহুদী দ্বন্ধ শুরু হয়। ম্যান্ডেট শাসনের পুরো সময় জুড়ে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্ধ-দাঙ্গা ও ক্ষয়ক্ষতি চলতে থাকে।
১৯২৮-২৯ সালে এই দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বৃটিশ সরকার একদিকে ইহুদিদের আগমন অন্যদিকে আরবদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যে UNO এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিষয়টি এজেন্ডাভূক্ত করা হয়। মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যই জায়ানবাদী আন্দোলন বৃটেনের হাত থেকে আমিরিকার সাহায্য লাভ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সংকট নিরসনের জন্য United Nations Special Committee on Palestine (UNSCOP) নামে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। কমিটি সুপারিশ করে যে, প্যালেষ্টাইনকে বিভক্ত করে একটি ইহুদী ও অপরটি প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হবে। এর ফলে ইহুদী ও প্যালেষ্টাইনীরা সহবস্থানে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রের অধীনে শাসিত হবে। এই ঘোষনার পর পরই ইহুদী ও প্যালেষ্টাইনীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত এই আরব ও ইহুদীদের দ্বন্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে বৃটেনের ম্যান্ডেট শাসন শেষ হলে। একই দিনে তেলআবিবে একটি হোটেলে ইহুদীদের জাতীয় কাউন্সিলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। সাথে সাথে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলে আন্তর্জাতিক পিরমন্ডলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অব্যহতি পরে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইরাক, মিশর প্যালেষ্টাইনে প্রবেশ করে। শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী আরব-ইসরাইল দ্বন্ধ। অতি দ্রুত ইসরাইল প্যালেষ্টাইনের ৭৮ শতাংশ অণ্ঞ্চল দখল করে নেয়। প্যালেষ্টাইনীরা দেশত্যাগে বাধ্য হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসাবে জীবন যাপন করতে থাকে।
সূত্রঃ মাসিক আল-হুদা, মে-২০১০
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১০ রাত ১০:০৫