...জহিরুল্লা দোকানদারের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য তার হাত ধরতে গেল, কিন্তু জহির তা পারল না। মনে হল হাতটা ধরতে গিয়ে বাতাশ ধরার চেষ্টা করছে সে। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি এবার সত্য সত্য স্বপ্নের মধ্যে আছে। হাতে একটা চিমটি কাটল। নাতো স্বপ্ন নয়ত! ব্যাথাতো পাওয়া যাচ্ছে, নাকি ব্যাথাটাও স্বপ্ন। জহির নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কয়েকবার দোকান দারের হাত ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু হাত না যেন বাতাস ধরছে জহির। তাহলে সে কি ভূত হয়ে গিয়েছে সত্যি সত্যি। নিজের এমন অবস্থা সে কিছুতে বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে আরো কিছু বস্তু ধরার চেষ্টা করল পারল না। দোকানে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলো ধরতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। এবার রেগে গিয়ে চেয়ার টেবিল ভাংতে চাইল। কিন্তু পারল না। যখন সে কোন কিছু ধরতে যায়, তার মধ্যে নিজের হাত ঢুকে যায়- অনেকটা পানি বা বাতাশের মত। এখন আর জহিরের বুঝতে বাকি নেই, সে এখন ভুত। শহরটাও তার কাছে আজব মনে হয়- এটাকি সত্যই কোলকাতা, নাকি এটাও কোন বানানো শহর। জহিরুল্লা এখন ও নিশ্চিত না তার সাথে কি হচ্ছে, বা কেন হচ্ছে। সে যেন ইতিমধ্যে ক্ষুধার কথাও ভুলে গেছে।
... ব্যাগটা সাথেই ছিল জহিরুল্লার। নিজের ব্যাগ, বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল আসার সময়। তার ভেতর থেকে ছোট আয়নাটা বের করল সে। নিজের মুখটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখা গেল না। শুধু কোলকাতা শহরের ছবি দেখা গেল। তারপর নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করল, তাও দেখা গেল না। জহিরুল্লার প্রচন্ড উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল। না, আমি যা দেখছি সব যেন মিথ্যে হয়, সব যেন স্বপ্ন হয়। বলতে বলতে চুটে গেল একটি সেলুনের দিকে। বড় আয়না। সেদিকে তাকালো সে। কিন্তু নিজের ছবি দেখতে পেল না।....
জহিরুল্লা রাস্তার মাঝখানে পড়ে রইল মরার মত, বেহুস হয়ে, বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাওয়ার কারনে দুশ্চিন্তায় মুর্ছা বারবার। তার গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে, কিন্তু তার হুস হচ্ছেনা। সে বাস্তব জগতের সব অনুভুতি হারিয়ে যেন অন্য এক জগতে এসে পৌছেছে। .... তার কয়েকঘন্টা পরে জহিরুল্লার হুস হল। সে নিজেকে আবিস্কার করল একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে। বিষয়টা তাকে অবাক করল না। কারন অবাক করার মত অনেক ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে। জহিরুল্লা খেয়াল করল বিল্ডিংয়ের ছাদের এক কোনে কে যেন বসে সিগারেট খাচ্ছে। চাদের আলোয় সে লোকটিকে চিনতে পারল, এই সেই ৮০ বছরের লোক যে বাসে পাশের সিটে বসা ছিল জহিরুল্লার। এই লোকের ই কাজ সে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। নিশ্চিত খারাপ কোন মতলব আছে তার। কেননা সেদিন তার একটা ভয়ংকর চেহারা জহির দেখতে পেয়েছিল। তাছাড়া পকেট থেকে ৭০ টাকা চুরি করেছিল সম্ভবত এই লোকটাই।.... জহির একবার ভাবলো, সে কি লোকটার সাথে কথা বলবে, নাকি পালিয়ে যাবে। কথা বলতে গিয়ে যদি বিপদ হয়! বোঝা যায় না লোকটার মনে আসলে কি আছে। অনেক ভেবে চিন্তে জহির পালিয়ে যাবার চিন্তা করল। আবার ভাবলো, যদি লোকটা দেখে ফেলে, নিশ্চয়ই বড় কোন স্বাস্থি দিয়ে বসতে পারে। জহিরুল্লা বাসে থাকতেই বুঝে ফেলেছিল লোকটি আসলে মানুষ না। আর এখন সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত। হয়ত বাসে সে একাই মানুষ ছিল, নয়ত অন্য কিছু হবে।... জহিরুল্লা খুব সাবধানে শিড়ির দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তায় নেমে হাটতে শুরু করল জোড়ে জোড়ে। কোলকাতার আলো শহরে পৌছাতে চায় সে। অন্ধকারে ভয় লাগে তার।... জহিরুল্লা মাত্র কয়েক পা হেটেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সে ধোয়াটা দেখতে পেল চাদের আলোয়। কেউ হয়ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কিন্তু না, এতো সেই বৃদ্ধ লোকটি যার ভয়ে সে পালাচ্ছে।
-কোথায় যাচ্ছ জহিরুল্লাহ, তোমার জন্য খাবার রেড়ি করে রেখেছি এক সাথে খাব বলে।
জহিরুল্লার নাম লোকটা কিভাবে জানলো, তাতে সে অবাক হল না। কারন, যে লোকটি মুহুর্তে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় উড়ে আসতে পারে, তার কাছে নাম জানা বিচিত্র কিছু না।
জহিরুল্লা বলল, আমি একটু আলোর সন্ধানে যেতে চাই। অন্ধকার ভালো লাগেনা আমার। কিন্তু লোকটা ছাড়ার পাত্র না। জহিরুল্লাকে খাবার সে খাইয়ে ছাড়বে। তাই এক প্রকার জোড় করে সে বিল্ডিংয়ের ছাদে নিয়ে আসল। তবে এবার আর ছাদে নয়, বিল্ডিয়ের একটা রুম, যেখানে সম্পূর্ন আলো নেই। শুধুই অন্ধকার। রুমের মধ্যে কটু গন্ধ। তবে জহিরুল্লা ভয় পেল না। কারন ভয় পাওয়ার মত অনেক ঘটনা ইতিমধ্যে তার ভয় অনেকটা কাটিয়ে দিয়ে গেছে। লোকটা বলল, এটা আমার ঘর। এখানে আমি থাকি। এটা ছাড়াও আমার অনেক ঘর আছে।... তারপর লোকটা বলল, টেবিলের উপর অনেক খাবার আছে। ওগুলো খেয়ে নাও। ইতিমধ্যে লোকটা খাওয়াও শুরু করে দিয়েছে। হাড় খাওয়ার কপমট শব্দও শুনতে পাচ্ছে সে। জহিরুল্লা ভাবল, আসলেই এখন খাওয়া দরকার এই সুযোগে। কারন সে ক্ষুদার্থ। আবার মনে মনে ভাবল, খাবার স্পর্শ করতে পারবেতো সে! আবার ভাবল, এত আগ্রহ নিয়ে খাবার খাওয়াতে চায় কেন লোকটা? কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেইতো। খাবার খাইয়ে মেরে ফেলবে নাতো লোকটা! না জানি এই খাবারের মধ্যে কি মিশিয়েছে লোকটা। লোকটার যে নিশ্চিত কোন খারাপ মতলব আছে, তা জহির বুঝতে পারছে। তা না হলে সে তার পিছু নিয়েছে কেন? আচ্ছা এই খাবারের ভিতর মারাত্মক কি এমন থাকতে পারে যা খেলে তার ক্ষতি হবে? আর ক্ষতিটা কেমন হতে পারে? সর্বোচ্চ মারাই যাবে। এর বেশি কিছুতো আর হবেনা। হ্যা মারা যাওয়াই ভালো। এসব ভয়ংকর পরিস্থিতে থেকে বাচার জন্য মরে যাওয়া অনেক ভালো। তবে চেষ্টাও করতে হবে বেচে থাকার জন্য। কেননা জহির নিজ শহরে অনেক কিছু ফেলে এসেছে । সেখানে অনেক কিছু পূর্নতা দেয়ার বাকি আছে। তার জীবনেরতো কেবল শুরু। এখনই সে মারা যেতে চায় না।... জহিরুল্লা বলল, কিন্তু আমি এই অন্ধকারে বসে কিভাবে খাব। আমি খাবার দেখতে পাচ্ছিনা।
- অন্ধকারে বসেই খেতে হবে। টেবিলের উপর হাত দাও, খাবার পেয়ে যাবে। জহির তাই করল। আর সে প্রচন্ড শিউরে উঠল। টেবিলের উপর এসব কি! এগুলো আর যাইহোক, খাবার না। এগুলো হয়ত পশুপাখির পচা মাংশ। আর তা দিয়ে দুর্গন্ধ আসছে। এ কোথায় এল জহির। এখন তাকে এসব খেতে হবে । না এগুলো সে কিছুতেই খাবেনা, মরে গেলেও না। আবার সে ভাবল, সেতো মরে গেছে না বেচে আছে, তা সে নিজেও জানেনা।....
জহির ৮০ বছরের ওই লোকটির নাম জানতে পারল । নাম সোলেমান। কোলকাতা তার জন্মস্থান। আর কিছু বলেনি সে। আর জহির জানতেও চায়নি। সোলেমান যখন বুঝতে পারল, এগুলো জহির খাবেনা, তখন সে কিছু ফল পাকড়া নিয়ে আসল জহিরের জন্য। জহির অনেক তৃপ্তিতে সেগুলো খেয়ে নিল।.... পরের দিন ফকফকা দিনের আলো। সোলেমান লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে নিজের দেশে। বলা যায় না সোলেমানের মনে কি কু মতলব আছে। হয়ত এই সব কিছু এই লোকটাই করে যাচ্ছে । হয়ত এসব কিছু ওরই সাজানো নাটক। খুজতে খুজতে একটা গাড়ি পেল জহির। জানতে পারল গাড়িটা খুলনায় যাবে। কোন কথা না বলেই উঠে পড়ল। তারপর হঠাৎ মনে হল, তার পকেটেতো টাকা নেই। আবার মনে হল, এই গাড়িতে হয়ত তার ভাড়া লাগবে না। কারন আসার সময় তার কাছে কেউ ভাড়া চাইতে আসেনি। তবে সে যে ৭০ টাকা হারিয়ে ফেলেছিল, তা মনে আছে। যাইহোক গাড়িতে তাকে উঠতেই হবে, দেশে তাকে ফিরতেই হবে। এজন্য সে পথে বসে মার খেতেও রাজি। কেননা সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য যা খুশি করতে পারে, অনেক কিছু ত্যাগ করতে পারবে, সইতে পারবে। সে এবার সামনের একটা সিট নিয়ে বসে পড়ল। তার বার বার মনে হচ্ছিল, সোলেমানের মত কেউ এসে তার পাশে বসবে নাতো! কিন্তু তা হলনা। একজন মধ্যবয়সী লোক তার পাশে বসল। সেও বাংলাদেশের খুলনায় যাবে । গাড়ি স্টার্ট হল। জহিরুল্লার বুক ধর ফর করতে লাগল। সে নিশ্চিত জানেনা তার সাথে কি হচ্ছে বা সে দেশে ফিরতে পারবে কি'না। বাসে অনেক যাত্রী, তারা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করেছে। এমনকি পাশের লোকটাও। জহিরুল্লা খেয়াল করল, বাসের মধ্যে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে না। ব্যাগ থেকে আয়নাটা বের করল। আয়নায় কাউকে দেখতে পেলোনা, এমনকি নিজেকেও না। তারপর আয়না সরিয়ে নিয়ে দেখল, সবাইকে দেখা যাচ্ছে। জহিরুল্লা যেন কোন কিছু বুঝেও বুঝে উঠতে পারছেনা।.... কিছুক্ষন পরে সেটাই ঘটল জহিরের সাথে যা নিয়ে সে চিন্তায় ছিল। কন্টাকটার ভাড়া নিতে এসেছে। জহির অবাক দৃষ্টিতে সুপারভাইজারের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, কিশের ভাড়া?
সুপারভাইজারও অবাক হল জহিরের কথা শুনে, বলল কিশের ভাড়া?
-গাড়ি ভাড়া।
-গাড়ির আবার ভাড়া দিতে হয় না'কি- একটু ন্যাকামির ভাব সেখিয়ে বলল জহির। তারপর সুপারভাইজার কিছু বলার আগেই মিন মিনিয়ে বলল, আগের গাড়িতেতো ভাড়া লাগেনি আমার। সুপারভাইজার অবাক হয়ে বলল, তাহলে তুমিই সেই লোক যে ভাড়া না দিয়ে পালিয়েছিলে। আমরা তোমাকে অনেক খুজেছি, তখন পেলে হাড় গুড়ো করে ফেলতাম তোমার। জহিরুল্লা ভয় পেয়ে গেল কিছুটা। দ্রুত নিজেকে সামলে একটু হাসির অভিনয় করে বলল, আরে আমিতো তোমার সাথে মজা করছিলাম। এই নাও ভাড়া। বলেই পকেট থেকে ৩০ টাকা বার করে দিল। সুপারভাইজার এবার চরমভাবে রেগে গিয়ে বলল, মজা কর তুমি। আমার ছুড়িটা কোথায়, একে কেটে টুকরো করে বিক্রি করব। এই লোকের জন্ম বোধ হয় নতুন। সে তো দেখি কিছুই বোঝেনা।
সুপারভাইজার তার ছুড়িটা আসলেই খুজে ছিল কিনা কে যানে। কিছুক্ষন পরে এসে বলল, তুই এখনই গাড়ি থেকে নেমে যা। আর এতোদুর গাড়িতে আসার জন্য তোর ত্রিশ টাকা আর পাবিনা। আর তুই অতিতে আমাদের গাড়ির ভাড়া না দিয়ে চলেগিয়েছিলি। সময় থাকলে তোকে বিচার করে ছাড়তাম। বলেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দিল জহিরকে। গাড়ি চলে গেল। তবে জহির কোলকাতা ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে। এখানে কোথাও বাড়ি ঘর দেখা যায় না। রাস্তার দুধারে শুধু জংগল। জহিরুল্লা পারলে বাসের সুপারভাইজারকে উচিৎ জবাব দিত। কিন্তু তার সেই সামর্থ এখন নেই। সে এখন মহাবিপদে আছে। একই অবস্থা জহির রাস্তায় কতক্ষন ঠায় বসেছিল, তা সে জানেনা। শুধু জানে রাস্তা দিয়ে দুই ধরনের গাড়ি চলতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। এক ধরনের গাড়িতে চলে মানুষ, আরেক ধরনের গাড়িতে ভুতেরাই চড়তে পারে শুধু। একে অপরকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। আচ্ছা জহির কি সত্যই এখন ভুত, এটা তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। আর ভুত যদি সে হয়েই থাকে, তবে কিভাবে হল? সে হয়ত স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাংলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ সুপারভাইজারের কথাগুলো মনে আসল তার। বাসের সুপারভাইজার কেন এভাবে কথা বলছিল তার সাথে? তাহলে সে কি সত্যই ভুত হয়ে গেছে। না এ হতে পারে না!..... তার কিছুক্ষন পরে সোলেমান জহিরকে খুজতে খুজতে তার সামনে এসে দাড়ালো। সোলেমানের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, চোখ আগুনের মত জ্বল জ্বল করছে । মাত্র এক নজর দেখলো জহির, তারপর রেগে মেগে তার দিকে ছুটে গিয়ে সার্টের কলার চেপে ধরল। এই বুড়ো সুলেমান, তাহলে তুই আমার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছিস। আজ তোর জন্য আমি খুলনায় জেতে পারলাম না। ৪০ টাকা কম ছিল। বলেই সোলেমানের নাকের উপর ঘুষি বসিয়ে দিল একটা । যা হবার হবে। এসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। এখন আর খারাপ কি হওয়ার বাকি আছে। সোলেমানের নাক দিয়ে স্রোতের মত রক্ত ঝরছে । সেই রক্ত জহিরের নিজের গায়ে লেগে গেল।। জহির এবার ভয় পেল প্রচণ্ড। সে শিউরে উঠল। এবার হয়ত তার সাথে আরো খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু সোলেমান বিচলিত হল না। সে মাথা ঠান্ডা রাখল। সে শান্তভাবে জহিরকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করল। জহির তুমি এখন আর বেচে নেই। তুমি এখন অন্য জগতে চলে এসেছো। এই সত্যটাকে মেনে নাও.., তমি এখন আমাদের এই সমাজের বাসিন্দা। এখানের জীবনের সাথে আগের জীবনের কোন মিল পাবেনা....