খুলনা শহর। একদিন রাতে জহিরুল্লাহ তার বাবা মার সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাবে, কি করবে সে নিজেও জানেনা; অনেক জেদি ছেলে জহিরুল্লাহ। পকেটে মাত্র একশ পঞ্চাশ টাকা আছে তার। এর মধ্যে পঞ্চাশ টাকা খরচ করে ফেলেছে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য।
বাগেরহাটে এক বন্ধু আছে তার। তাই সে চিন্তা করল বাগেরহাটে যাবে। রাত তখন ১০ টার বেশি বেজে গেছে। রুপসার খেয়াঘাট পেরিয়ে একটা বাস পেয়ে গেল সে। বাসে একটা পছন্দমত সিট আগেই বেছে নিয়েছে সে। এখন গাড়ি ছাড়ার জন্য অপেক্ষা। জহিরুল্লার পাশেই এক ৮০ বছরের বৃদ্ধ বসেছিল। জালানা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে লোক জনের আনাগোনা দেখছিল সে। জহিরুল্লাহ বাসে ওঠার সময় মাত্র এক নজর দেখেছিল। তারপর তার দিকে আর তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না।
জহিরুল্লার মনে চিন্তা হচ্ছিল, সেই সাথে ঘুমও আসছিল। একটু একটু তন্দ্রা যাচ্ছিল সে। হঠাৎ তার মনে হল,গাড়ি ছেড়েছে কি'না। চোখ খুলেই দেখল, গাড়ি সেই আগের অবস্থানেই আছে, আগেরমতই। আর পাশের বুড়ো লোকটা আগের মতই বাইরে তাকিয়ে আছে। কত সময় হল গাড়িতে বসে আছে জহিরুল্লা। মনে হতে ঘড়ি দেখল সে, রাত ২ টা বাজে । ভিসন অবাক হল জহিরুল্লা, হঠাৎ ভয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। এত সময় ধরে গাড়িতে বসা, অথচ গাড়ি ছাড়ছে না! আবার ছাড়ার কোন লক্ষনও দেখা যাচ্ছেনা। সে একনজর সামনে আর পেছনে তাকালো। যাত্রীতে বোঝাই গাড়ি, সবাই ঘুমাচ্ছে। তাহলে গাড়ি ছাড়ছেনা কেন। বাইরে ভালো করে তাকালো জহিরুল্লা, গাড়ি আসলেই চলছেনা। এবার সে রেগে গিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়ে ড্রাইভারকে চেচিয়ে প্রাশ্ন করল, ভাই গাড়ি ছাড়বেন কখন? ড্রাইবার ড্রাইভিং সিটে বসে ঝিমুচ্ছিল। পেছনে না ফিরেই বলল, এখনই।
কিন্তু গাড়ি চলতে শুরু করল তার অনেক পর। রাত তখন তিনটা। গাড়িটা চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল। জানা গেল গাড়িতে সমস্যা হয়েছে। সারতে কিছুটা সময় লাগবে। এতক্ষনে জহিরুল্লার মনে পড়ল, সে তার বন্ধুকে ফোন করে কিছু জানায় নি। তাই সে ফোন করতে গিয়ে বন্ধুর ফোন অফ পেল। সমস্যা নেই তার। বন্ধুর বাড়ি চেনা আছে। অনেক কাছের বন্ধু। বাড়িতে শুধু ওর মা আর ও থাকে। বাবা চাকরী করে ঢাকায়।.... গাড়িটি ঠিক করতে এখনো অনেক দেরি। জহিরুল্লার পাশের বয়স্ক লোকটা এতক্ষনে এই প্রথম কথা বলে উঠল, তাও জহিরুল্লা কে লক্ষ করে। - প্রচন্ড গরম, বাইরে যাবে বাবা একটু বাতাশে দাড়াতাম, আমার একা যেতে ভালো লাগছে না। জহিরুল্ল পারলে না ই বলে দিত। কিন্তু এত বয়স্ক মানুষকে সে না বলতে পারল না। যখন জহিরুল্লা বাইরে আসল, একটা দৃশ্য দেখে অবাক হল সে। গাড়ি সারাতো দুরের কথা, গাড়ির আসে পাশে গাড়ির কোন লোক নেই। লোকজন যা আছে তারা সবাই গাড়ির মধ্যে ঘুমাচ্ছে। অনেকটা ভয় পেল কিন্তু বৃদ্ধ লোকটা সাথে থাকায় কিছুটা সাহস পেল সে। বলল, আচ্ছা গাড়ির লোকজন কোথায়? বৃদ্ধ লোকটি বলল, হয়ত আসে পাশের কোন দোকানে চা খেতে গিয়েছে তারা। হয়ত এখনই ফিরে আসবে। কিন্তু জহিরুল্লা দেখল, আসে পাশে কোথাও চায়ের দোকান নেই। হয়ত থাকতে পারে ভেবে আর কোন প্রশ্ন করল না সে। হঠাৎ জহিরুল্লার বন্ধুর ফোন এল। বন্ধুর নাম রাকিব। রাকিব বলল, কি হল, এত রাতে ফোন দিয়েছিলি কেন। মিস কল এলার্ট থেকে রাকিব সংকেত পেয়েছিল। জহিরুল্লা জানালো সে রাকিবের বাড়িতে বেড়াতে আসছে। কিন্তু গাড়িতে সমস্যার কারনে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আসতে সকাল ও হতে পারে । হঠাৎ এভাবে কেন আসবে, আর খুলনা থেকে বাগেরহাটে আসতে এত বেশি দেরি হচ্ছে কেন এসব বলার আগেই ফোন কেটে দিল জহিরুল্লা। ফোনে কোন কিছু আলাপ করতে চাচ্ছেনা সে। রাকিব আরো কয়েকবার ফোন দিল। কিন্তু জহিরুল্লা ধরল না। বৃদ্ধ লোকটি বলল, এখানে বেস গরম, চল আরেকটু সামনে যাই। আরেকটু সামনে যেতেই জহিরুল্লা ভয়ে পাথর হয়ে গেল। এতক্ষনে সর্বপ্রথম বৃদ্ধের চেহারায় চোখ পড়ল তার। বৃদ্ধের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, রক্তে দাড়ি ভিজে রয়েছে। চোখ দুটো ভয়ংকর লাল। ভয়ের কথা সে প্রকাশ করতে চাইছিল না। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে বলল, মানি ব্যাগ ফেলে এসেছি বাসে, ওটা নিয়ে আসতে হবে। বলেই প্রান পনে গাড়ির দিকে ছুটতে লাগল সে। বৃদ্ধ কিছু একটা বলে থামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জহিরুল্লা কোন কথাই শুনল না। তারাহুরা করে গাড়িতে উঠে এল জহিরুল্লা। গাড়ি এতক্ষন পর স্টার্ট হতে যাচ্ছিল। জহিরুল্লা সিটে বস্তে গিয়ে দেখল, বৃদ্ধ লোকটি তার পাশের সিটে বসে আছে। তবে তার চেহারা স্বাভাবিক। কোথায় গিয়েছিলে.? এইতো বাইরে, জহিরুল্লা উত্তর দিল। জহিরুল্লা বুঝতে পারল, তার সাথে অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে। তাই তাকে হয় বন্ধুর কাছে যেতে হবে, না হয় মা বাবার কাছে। তাই সে যে ফোন নাম্বারটি তার বাবা মা জানে সেটি ওপেন করে বাবা মাকে কল দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু কল দেবার আগেই তার মায়ের মোবাইল থেকে কল আসল। কান্না জড়িত কন্ঠে জহিরুল্লার মা বলে উঠল, কোথায় আছিস বাবা, এভাবে কি রাগ করে মা বাবার সাথে। ফিরে আয় তারা তারি। আমরা খুব টেনশনে আছি। জহিরুল্লা বলল, মা আমি কোথায় আছি জানিনা। তবে আমি রাকিবদের বাড়ি যাওয়ার জন্য বাগেরহাটের গাড়িতে উঠেছিলাম
। কিন্তু আধা ঘন্টার পথ কয়েক ঘন্টায় ও শেষ হচ্ছেনা
। আমি বুঝতে পারছিনা আমি কোথায় আছি। মা আমার ভয় করে।
গাড়তে এত এত লোক ছিল, কিন্তু জহিরুল্লার মত কেউ চিন্তিত ছিল না তাদের যাত্রা নিয়ে। শুধু সে-ই ভয়ে পাচ্ছে, অবাক হচ্ছে। এতক্ষনে তার মনে একটা প্রশ্ন যাগলো, এসব যাত্রিরা আসলে কোথায় যাচ্ছে? বাগেরহাট শহরে নাকি অন্যকোথাও? দুরের যাত্রা না হলে যাত্রীরা সাধারণত এভাবে ঘুমায় না। কিন্তু প্রশ্নটা কাকে করা যায়, সবাইতো শুধু ঘুমাচ্ছে। ড্রাইভার শুধু গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে প্রশ্ন করার সাহস হল না। কেন সাহস হচ্ছেনা তা জহিরুল্লা বুঝতে পারে। কারন, সে যে চিন্তিত এটা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না সে। তাই সে পাশের সিটে বসে থাকা বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইবে কিনা ভাবল। আবার মনে মনে ভয় জাগল, বৃদ্ধের অদ্ভুত চেহারা দেখা যায় কিনা। তারপরেও সে মনে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তবে বৃদ্ধের চেহারার দিকে না তাকিয়ে, আচ্ছা চাচা আপনি কোথায় যাবেন? বলতে গিয়ে গলা কাপছিল জহিরুল্লার। - আমি কোলকাতা যাব, তুমি কই যাবে? হ্যা। আমিও কোলকাতা যাবো। জহিরুল্লা গোপন রাখল সবকিছু। সে এখন ভোর হবার অপেক্ষায় আছে। ভোর হলেই তার ভয় কেটে যাবে। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন বাগেরহাটের গাড়িতে কোলকাতা যাচ্ছে কিভাবে। এদিকে তার মা বাবা ফোন দিচ্ছে বার বার। রিসিভ করে ফিস ফিস করে কথা বলে সে। সে চায়না বাসের মধ্যে কেউ তার মানুষিক অবস্থা বুঝে যাক। জহিরুল্লা জানে তার মা বাবা খুব উদ্দিগ্ন আছে কিন্ত এই মুহুর্তে তারা কি করতে পারবে। যা করার নিজেকেই করতে হবে। সে এখন বন্ধুর বাসার কথা ভাবছে না। ভাবছে শুধু সকালের কথা। কখন সকাল হবে। জহিরুল্লা মাকে জানালো সে তার বন্ধুর বাসায় আছে, কোন বিপদ হয়নি তার, কাল বিকেলে আসবে সে । এরপর তার ফোন বন্ধ করে রাখে চার্জ না থাকার অজুহাত দেখিয়ে। এতক্ষনে জহিরুল্লার মনে হল, এই গাড়ির মধ্যে মোট তিনজন জেগে আছে। ড্রাইভার, বৃদ্ধ লোকটি আর নিজে। আচ্ছা গাড়ির অন্যরা সবাই ঘুমাচ্ছে কিন্তু এই বুড়ো কেন যেগে আছে। হয়ত বয়স হয়ে গেছে তাই। জহিরুল্লা পারলে ঘুমাতো ভয় দূর করার জন্য কিন্তু ঘুম আসেনা। অবশেষে জহিরুল্লার চোখ জল জল করে উঠল।। সকাল বেলার আলো দেখা যাচ্ছে। গাড়ি কোলকাতা পৌছেছে। সত্যি কোলকাতা। বৃদ্ধ লোকটি নেমে পড়ল, সাথে সেও ও। আর যাত্রার দরকার নেই। এখন সব কিছু বুঝতে হবে। কি হচ্ছে তার সাথে। পকেটে মাত্র ত্রিশ টাকা অবশিষ্ট আছে। বাকি টাকা কোথায় গেল? হয়ত গাড়ি ভাড়া। মনে করতে পারল না সে। যাইহোক এই ত্রিশটাকায় এখানে কিছু কেনা যাবে না। কারন এটা বাংলাদেশনা, কোলকাতা!
জহিরুল্লা তার বন্ধু রাকিবকে কল করতে চাইল কিন্তু কল যাচ্ছেনা। এমন কি বাবা মাকে কল দিতে চাইল, তাও সম্ভব হল না। বাংলাদেশে কাউকে সে কল দিতে পারছেনা। সূর্যের ফকফকে আলোয় তার চোঁখ জ্বলসে যাচ্ছে, তবে রাতের মত ভয় করছেনা। কিন্তু সে কিভাবে নিজের দেশে খুলনায় ফিরে যাবে, ভাবতে তার মুখ শুকিয়ে যায়। সে জানে তার সাথে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে যাচ্ছে কিন্তু সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়।
বিকাল পাঁচটার সময় সে আবিষ্কার করল, সে বেশ ক্ষুদার্থ। সারা দিনের দুঃশ্চিন্তায় সে সব কিছু ভুলে গিয়েছিল। সব কিছু। তার এখন আর স্কুল কলেজের কথা চিন্তা করেনা, চিন্তা করে কিভাবে বেচে ফিরবে সে।
.... সে একটা দোকানে গিয়ে দাড়ালো। পকেটের ত্রিশ টাকা বের করে কি যেন ভাবল। তারপর দোকানিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে ছোট এক প্যাক বিস্কুট দিবেন। সে এমন ভাব দেখালো যেন সে উদাস। সে চাইছিল, দোকানদার তার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে নেবে । কিন্তু দেখা গেল, সেদিকে খেয়াল করল না দোকানদার। এবার আরোকটু জোড়ে ডাকল দোকানদার কে... তারপর আরেকটু। কিন্তু ফিরেও তাকালো না দোকানদার। লোকটা যে কানা নয় তাও বুঝতে পারে জহুর। সে অবাক করা আরো একটা বিষয় আবিস্কার করল।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৫