ইদানীং সোসাল মিডিয়ায় ঝড় বইছে বদরুলকে নিয়ে। বদরুল জঘন্য আর পৈচাশিক একটা অপরাধ করে ফেলেছে। একটি মেয়েকে সে নির্মমভাবে অনেক মানুষের সামনে দিনে দুপুরে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। মেয়েটির জীবন এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়ছে।
আমি এই পোস্টটি দিতে চাচ্ছিলাম না, কারন বদরুলকে নিয়ে সোসাল ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে, আর তাতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই ফুটে উঠেছে। তারপরেও আমার মনে হচ্ছে, কিছু কিছু বিষয় যেন বেশি রকম এড়িয়ে গেছে সেসব লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে। প্রায় সবাই ই বদরুলের উপযুক্ত বিচার চাইছেন, কেউ কেউ ফাঁসি চাইছেন। আমিও আমার বিচারোক চোঁখ দিয়ে দেখলে বলব, বদরুলের উপযুক্ত শাস্থি হোক, আর নির্মমতার মাত্রা দেখে বলব, বদরুলের ফাঁসি হওয়াই উচিৎ যাতে ভবিষ্যতে এরকম জঘন্য অপরাধ করতে কেউ সাহস না পায়। কিন্তু বদরুলের শাস্তি যাই ই হোক না কেন, আমাদের এটাও ভেবে দেখা উচিৎ, বদরুল কেন এরকম অপরাধ করল? কোন মানুষই পৃথিবীতে অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না, বরঞ্চ তাকে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারনে অপরাধী হতে হয়। আর এই বদরুলও কিন্তু এই নিয়মের বাইরে নয়। বদরুল যখন এই পৃথিবীতে আসে তখন সে অপরাধী হয়ে আসেনি, তার হাতে চা পাতি ছিল না। বরং সে কোন না কোন কারনে জীবনের এক পর্যায়ে চাপাতি তুলে নেয়, যার দ্বারা নির্মমতার শিকার হল খাদিজা নামক মেয়েটি। এখন এটা যেহেতু অপরাধমূলক ঘটনা, সেহেতু আমাদের ভাবতে হবে, মানুষ কেন অপরাধ করে আর কারাইবা করে? এ বিষয়গুলো না জানলে সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকবে আর যার শিকার হবে খাদিজা বিশ্বজিতের মত হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। এই বিষয়টা ব্যাখ্যা করার আগে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি।
শুরুতেই আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আমাদের কি বেশি বেশি অপরাধ করা উচিৎ? থাক আর বলতে হবে না, উত্তর পেয়েগেছি। আপনার উত্তর হল - না। কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করতে পারবেন, সমাজের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে শিশুরা থেকে যুবকরা পর্যন্ত, বড় একটা অংশ প্রতিদিন এর উত্তর "হ্যা" দিয়ে যাচ্ছে, আপনি খেয়াল করছেন না। এমনকি, অনেক পরিবেশে আপনি নিজেও এর উত্তর হ্যা দিয়েছেন। কারন, অপরাধ করে অনেক মানুষ গর্ববোধ করে। আর একারনেই আমাদের সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে প্রতিদিন! কিভাবে????? সেদিন একটি লাইব্রেরিতে বসে বই বড়ছিলাম। আমার থেকে কিছু দুরেই একটা শিক্ষিত যুবক আর একটা ছোট ছেলের মধ্যকার কথোপকথন ভেসে আসছিল আমার কানে। আমি প্রথমে মনে করছিলাম, কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়ত হচ্ছে তাদের মধ্যে। কিন্তু একটু খেয়াল করতেই বুঝে গেলাম কথোপকথনের বিষয়বস্তু। যুবক লোকটা স্কুলে থাকতে কি কি অপরাধ করেছিল, তা সবগুলো মহা আনন্দে গর্ব করে বাচ্চা ছেলেটার কানে ঢালছিল, আর বাচ্চা ছেলেটা হাসছিল আর মজা করে শুনছিল। তার কথার মধ্যে ছিল- জালানা ভেংগে স্কুল পালানোর গল্প, স্যারকে বোকা বানানোর গল্প, স্যারকে হুমকি দিয়ে ভয় দেখানোর গল্প ইত্যাদি। বাচ্চা ছেলেটা শুনছিল মজা করে আর ফাঁকে ফাঁকে নিজের কিছু অপরাধের কথাও বলছিল। যাইহোক, এটাকে কি আপনি অপরাধ নিয়ে গর্বকরা বলবেন না। আর অপরাধে গর্ববোধ কি সমাজে অপরাধ বৃদ্ধিতে সাহায্য করেনা। আর একটা উদাহরণ দিই- আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে প্রায়ই একটা অপরাধের গল্প বলতে শুনি। সে তার এক শিক্ষককে তারিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে চুবিয়েছিল। আর সে এই গল্পটা করে তার ছেলেমেয়ের সামনেই। এখন তার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের মুখ থেকেও অনেক অপরাধের কথা গর্বভরে বলতে শোনা যায়। কিছু কিছু অপরাধের কথা হয়ত তারা বানিয়ে বলছে, তবে কিছুতো সত্যি। যাইহোক এবার ফিরে আসি বদরুল নামক বদমাইসটার আলোচনায়। কিভাবে সে অপরাধী হল। আমরা যারা চালাক মানুষ, তাদের সাথে কেউ যদি হাজার বারও অপরাধের কথা গর্বকরে বলতে থাকে, আমরা কখনই অপরাধ করতে উৎসাহিত হব না!!!! কারন, আমি অপরাধ করলে তার শাস্তি আমাকেই পেতে হবে, উৎসাহ দাতা পাবেনা। আমি কাউকে কুপিয়ে জখম করলে, আমাকে জেল খাটতে হবে, যে উৎসাহ দিবে তার কিছুই হবেনা। কিন্তু আমরা নাহয় চালাক, নিজের ভালো মন্দ বুঝে কাজ করি- সবাই কি সেটা পারে? বদরুল গ্রামে জন্ম নেয়া সহজ সরল মানুষ ছিল হয়ত। কিন্তু সে ধীরে ধীরে সামাজিক কারনে অপরাধ প্রবন মনমানুষিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে নিজের অজান্তেই। সে ছোট বেলা থেকেই যা শুনেছে, সেটাকে সত্য মনে করেছে- নিজের ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা তার হয়ে ওঠেনি। কারন একটাই, সে জানে অপরাধ করা ভালো, অপরাধ করলে সমাজের মানুষ তাকে ভয় পাবে, সম্মান করবে । আর এটা সে শিখেছে, তাদের কাছ থেকে যারা অপরাধ নিয়ে গর্বের গল্প প্রকাশ করে চলছে। এটা হতে পারে রাজনৈতিক দলের কেউ, অথবা সাধারন কেউ। চালাক মানুষ প্রভাবিত হয়না, সরল মানুষ প্রভাবিত হয়। আমি এতক্ষন যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটা একটা অপরাধের বৃদ্ধি প্রভাবক মাত্র।
এখন আমরা দেখব, অপরাধ আসলে সমাজের কোন শ্রেনির মানুষেরা বেশি করে, কি কি তার কারনঃ ১। নিজে ভালো থাকার জন্য,
২। অপরকে খারাপ রাখার জন্য,
৩। আনন্দ পাওয়ার জন্য,
৪। সমাজে নিজের প্রভাব সৃষ্টি করার জন্য,
৫। পরের প্রতি হিংসাত্বক মনভাব সৃষ্টি হওয়ার জন্য।
৬। মানুষিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলার কারনে।
পোস্ট দির্ঘ হয়ে যাবে বলে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম না। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটে চলছে ঠান্ডা মাথায়, নিজের স্বার্থ আর প্রতিশোধগ্রহনের জন্য। কিন্তু যে অপরাধগুলো রাগের মাথায় হয়ে থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সাথে স্বার্থের কোন যোগসূত্র থাকেনা, আর তা ঘটে থাকে খুব সামান্য কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে।
যারা ঠান্ডা মাথায় অপরাধ করে, তারা অপরাধ পরবর্তীতে নিজের ভুল নাও বুঝতে পারে। কিন্তু গরম মাথায় অপরাধ করলে ব্যক্তি অনুশোচনায় ভোগে।
আমাদের সমাজকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে প্রধানত তিন ধরনের মানুষ পাওয়া যায়।
১। নিম্নবিত্ত ঃ উচ্চবিত্ত ঃ আমাদের সমাজের উচ্চবিত্তদের বড় একটা অংশ খুব সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এর একটাই কারন, অবিভাবকরা সন্তানের প্রতি ঠিক মত কেয়ার নিতে পারেনা। আর তাদের সন্তানেরা অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারনে খুব সহজে মাদকের সংস্পর্শ এ আসতে পারে। যার চুড়ান্ত পর্যায়ে খুনের মত ঘটনা ঘটে থাকে। তাছাড়া তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হয়না, ফলে তারা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে। আর উচ্চ বিত্তদের আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারনে, তাদের সন্তানের অপরাধের মাত্রাকে লঘু বলে সমাজে দেখাতে পারেন।
মধ্যবিত্তঃ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে করতে জীবন শেষ, অপরাধ করবে কখন। তাই মধ্য বিত্তদের মধ্যে অপরাধের হার কম থাকে।
নিম্ন বিত্তঃ আমাদের সমাজের নিম্নবিত্তরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই অক্ষম নয়, তারা সামাজিকভাবেও অবহেলের শিকার হয়। এক দিকে যেমন অর্থনৈতিক কষ্ট, অন্য দিকে সামাজিক অবহেলা দুই মিলেই একজন নিম্ন বিত্তের সন্তানকে অপরাধের দিকে খুব সহজে ঠেলে দেয়। সৃষ্টি হয় অপরাধপ্রবন মন মানুষিকতা। অর্থনৈতিক কারনে তারা যেমন চুরি ডাকাতির মত অপরাধ করতে পারে, তেমনি সামাজিক অবহেলা থেকে মুক্তি পেতে তারা উচ্চ পর্যায়ের মানুষের প্ররোচনায় খুব সহজে পা দিয়ে থাকে।
এবার দেখা যাক বদরুল কে...........
.... যতদুর জানতে পেরেছি, বদরুল নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বদরুলের এমন অপরাধের খবর পেয়ে ঘৃনা আর লজ্জায় পরিবারের লোকজন তাকে দেখতেও আসেনি। এমনকি বদিরুলের মা নিজেও সন্তানের উপযুক্ত বিচার আশা করেন।।
........ এখন বদরুলের অপরাধী হয়ে উঠার কারনের সাথে মিলিয়ে দেখুন উপরের পয়েন্টগুলো....
বদরুল যখন নিম্ন বিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়, তখন সে প্রথমেই অভাব অনটনের ধাক্কার মধ্যে পরে। তারপরেও সমাজে হয় অবহেলিত। ধনী লোকেরা তাকে শহরের টোকাইদের মত অবহেলা করে ডেকে বলবে , এই পিচ্চি এই কাজটা করে দেত.... না করতে চাইলে হয় কিল না হয় ঘুষি।...... যাইহোক এই কিল ঘুশির হাত থেকে বাচাতে তার মা বাবা লেখা পড়া করানোর চেষ্টা করতে শুরু করল। কিন্তু যত দিনে প্রতিষ্ঠিত না হয়, ততদিন তো কিল ঘুসি খেতেই হবে। যাইহোক, কিল ঘুষি খেতে খেতে হয়ত কলেজে উঠল, কিন্তু নির্মম বাস্তবতা থেকে তার মনে যে হিংসাত্বক বিজ বপিত হয়েছে, তা কোথায় যাবে? যাইহোক, সে নির্দিষ্ট কোন ধারার মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনিতীর সাথে যুক্ত হল। এখন তার হাতে অনেক ক্ষমতা, সে জানে এখন অপরাধ করলে সে খুব সহজে বেচে যেতে পারবে, আর অপরাধ নিয়ে গর্ববোধ করতে পারবে, সমাজে মানুষ তাকে ভয় পাবে। অথচ সে ই সমাজে কোন এক সময় অবহেলার শিকার হত। আর এভাবেই তার মনে জন্ম নেয়া হিংসাত্বক মানুষিকতার শিকার হতে হল খাদিজাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৪