একাত্তরের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ইকবাল হল তথা জহুরুল হক হল থেকে।
বস্তুত ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় থেকে ওই ছাত্রাবাসটি ছিল স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সদর দপ্তর বিশেষ। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায়কে নস্যাত করার জন্য একাত্তর সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার ঘোষণার মাধ্যমে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একাত্তরের মার্চ মাসে ধাপে ধাপে তা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যায়। এস এ সময় বঙ্গবন্ধু এক রাতে জহুরুল হক হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে এক অঘোষিত সভায় মিলিত হন বলে জানা যায়। ওই সময় আমার অবস্থান ছিল জহুরুল হক হল সংলগ্ন ২৪ নং বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে। সেখানে ২২ মার্চ রাতে বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্রনেতাদের মধ্যে এক জরুরি সভা হয়। আমি সেই সভায় যোগদান করিনি। কিন্তু পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আমার দেখা হয় সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতার সঙ্গে। তারা আমাকে জানান যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলোচনার ধাপ্পা দিয়ে সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার সময় নিয়েছেন, 'ক্র্যাক ডাউন ' আসন্ন এবং প্রতিরোধ সংগ্রাম অনিবার্য। তাই শেষ মুহূর্তে সমঝোতার জন্য গত রাতভর তারা আলোচনা চালিয়েছেন। এই সভা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে জহুরুল হক হলের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। বিস্ময়ের কিছু নেই যে, পাকিস্তানি অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল জহুরুল হক হল। সৌভাগ্যবশত ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগে প্রায় সব ছাত্রনেতা ও কর্মী হল ছেড়ে চলে যান।
পঁচিশ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী ট্যাংক, জিপে বসানো রিকয়েললেস রাইফেল, মর্টার, ভারী ও হাল্কা মেশিনগান, রকেট লঞ্চার এবং চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেল প্রভৃতি মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চারদিক থেকে জহুরুল হক হল আক্রমণ করে। দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্র"য়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত 'স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম দূর্গ ইকবাল হল' প্রবন্ধ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ উদ্ধৃত করছি।
গ্যারেজের উন্মুক্ত ছাদে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন জিন্নাত আলী ও তার সঙ্গী তারেক, আবদুর রউফ ও তার ছোট ভাই জগন্নাত কলেজের ছাত্র মোয়াজ্জেম হোসেন। আর ঘন্টা খানেক পর অর্থাৎ একটা-দেড়টার দিকে শুরু হলো পাক হানাদারদের আক্রমণ। অন্ধকারের বুক চিরে ছুটছে বুলেট। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়াল গর্জনে সমস্ত এলাকা প্রকম্পমান। অক্টোপাসের মতো হানাদাররা ঘিরে ফেলেছে হল এলাকা। কামান দাগছে, গ্রেনেড ছুড়ছে, এক ধরনের আগুনে বোমা। বোমাগুলো ফস করে জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরের ভেতরে পড়তেই ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সে আগুনে কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্রসহ যত কিছু দাহ্য বস্তু, এমনকি দালানের আস্তর পর্যন্ত পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধকারী তরুণরাও বীর বিক্রমে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।
....থ্রি নট থ্রির আওয়াজ শুনেই তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে আগুন জ্বলছে হলের সব ঘরে, তাতে কি করে বেশিক্ষণ আর ওদের পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে? আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিসহিস করে ছড়িয়ে পড়ছে। অ্যাসেম্বলি হল ও পাঠাগারে আগুন জ্বলে দাউদাউ করে। পাশের রেল সড়কের বস্তিও জ্বলছে ওদিক থেকে ভেসে আসছে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মানুষের আর্তনাদ। আকাশে উড়ছে লাল-নীল রঙের অনুসন্ধানী ফানুস। এক বিচিত্র ভৌতিক পরিবেশ। সারা নগরী যেনো জ্বলছে। প্রজ্বলন্ত আগুন, কামান, মর্টার গ্রেনেড আর যতসব স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মিলিত বীভৎস গর্জন বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। ইকবাল হলের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রেল সড়কের বস্তিতে যখন আগুন দেয় হানাদার বাহিনী, তখন বস্তিবাসী নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, যুবক সবাই পাঁচিল ডিঙিয়ে ছুটছিল হলের ভেতরের দিকে আশ্রয়ের আশায়। যেমনি দলে দলে লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়েছিল তেমনি দলে দলে মুখ থুবড়ে পড়ল স্বদেশের পবিত্র মাটিতে পাক হানাদারদের বুলেটবিদ্ধ হয়ে। ২৫ মার্চ বিভীষিকাময় কালরাতের অবসান হলো; কিন্তু হানাদাররা কার্ফ্যু জারি করেছে সমস্ত দিন ধরে। কারণ হত্যাযজ্ঞ যা চালিয়েছে, তা সবটা জানাতে চায়না বিশ্ববাসীকে। ইকবাল হলে ও আশেপাশে যারা তখনো বেঁচে ছিল, তারাও জীবনের তাগিদে বেরুচ্ছে যেদিকে সুযোগ পাচ্ছে। রাতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙে লুটে নিয়ে গেছে আর যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে নির্মমভাবে। এর ফাঁকে ফাঁকে দু-একজন বেঁচে গেছে নানা কৌশলে। যেমন বেঁচে গেছে তারেক, জিন্নাত আলী, রউফ, মোয়াজ্জেম গ্যারেজের ছাদে আশ্রয় নিয়ে। বেঁচে গেছে আরেকটি ছেলে হলের একটি কক্ষে থেকেও। সে লেপ জড়িয়ে নিঃসাড় দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালে হেলান দিয়ে। বেঁচে গেছে কয়েকজন হলের পেছনে সাধারণ কর্মচারীদের কোয়ার্টারে আত্মগোপন করে। ২৬ মার্চ ভোরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়েছে, সেখানেই দেখা গেছে লাল আর লাশ। এদেশের সোনার ছেলেদের গুলি খাওয়া লাশ।
জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেতে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার তিনটি (২৩, ২৪ ও ২৫নং) আবাসনে পাকিস্তানি সৈন্যরা সিঁড়িতে, ছাদে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক, আশ্রয়গ্রহণকারী বস্তিবাসী, প্রেসিডেন্ট হাউসে (পুরাতন গণভবন) প্রহরারত নিরস্ত্রীকৃত ইপিআর জোয়ান, যারা ২৩ নং বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের হত্যা করে। শিক্ষকদের বাড়ির ঘরে ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিক্ষকদের হত্যা করবে এমন ধারণা ছিল কল্পনারও অতীত। তাই জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার শিক্ষকরা কেউ ২৫ মার্চ রাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি।
নীলক্ষেত এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। জহুরুল হক হল সংলগ্ন শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আর পুরনো রেল লাইনের ওপর গড়ে ওঠা বস্তি এলাকায় পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুন্ঠন চালায়, তা শুধু চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, চরম যুদ্ধাপরাধও বটে। পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, টিএসসি, রোকেয়া হলে ঢোকে এবং পরিবার-পরিজনসহ বহু বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীকে হত্যা করে। এছাড়াও ফুলার রোড আবাসিক এলাকায় ঢুকে শিক্ষকদের আবাসে হানা দেয় এবং বাসা থেকে তাদের ধরে এনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।
এই বাহিনী সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষকদের বাসা এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রহরারত ইপিআর জোয়ানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। জগন্নাথ হল আক্রমণকারী পাকিস্তান বাহিনী জগন্নাথ হল ছাড়াও নিকটবর্তী শিববাড়ি ও শহীদ মিনার এবং জগন্নাথ হল মাঠে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় হানা দেয়। যে পাকিস্তান বাহিনী শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমীতে গোলাবর্ষণ করে, তারা ঢাকা হল সংলগ্ন শিক্ষক আবাস এবং কিংবদন্তির চরিত্র মধুদ'ার বাড়িতে ঢোকে।
মোট কথা ট্যাংক, ট্রাক, উইপন ক্যারিয়ার, পিকআপ, জিপ আরোহী মোবাইল পাকিস্তান বাহিনীর ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বালুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, এলএমজি, মেশিনগান, মর্টার, ট্যাংক বিধ্বংসী রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার প্রভৃতি মার্কিন ও চীনা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চারিদিক থেকে ঘেরাও করে প্রচণ্ড গোলাগুলি, বোমাবর্ষণ এবং হল ও শিক্ষক কর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে যে 'অপারেশন সার্চ লাইট' পরিচালনা করে, তাতে ১০ জন শিক্ষক, বহু ছাত্র, পরিবার-পরিজনসহ বহু কর্মচারী নিহত হন। এছাড়া ২৩ নং নীলক্ষেত শিক্ষক আবাসনের ছাদে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ৩০ জনকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকিস্তা বাহিনী নীলক্ষেতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে ঢুকে ক্লাব কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী এবং আবদুল মজিদকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। তাদের লাশ অপসারণ করা হয় অনেক পরে, যেদিন ২৩নং নীলক্ষেত আবাসনের ছাদ থেকে ৩০ জনের লাশ সরানো হয় সেদিন, এই ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসনে নিহত হয়েছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর ফজলুর রহমান ও তার দুজন আত্মীয়। তবে একই আবাসে বসবাসকারী বাংলার অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ইংরেজির অধ্যাপক রাশিদুল হাসান অলৌকিকভাবে বেঁচে যান ২৫ মার্চ রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে। তারা ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়িতে ঢুকে টর্চ ফেলে কোনো ঘরে কাউকে দেখতে না পেয়ে এই বলে বেরিয়ে যায় যে, 'বাঙালি কুত্তা ভাগ গিয়া'। একই দালানে সপরিবারে আক্রান্ত হয়েও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান গ্রন্থাগারিক মৃধা সাহেব।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর রক্তপিপাসু-হায়েনারা নীলক্ষেত এলাকার ২৪ নং বাড়িতে ঢোকে। ওই দালানে দোতলার একটি ফ্ল্যাটে আমি সপরিবারে থাকতাম। ২৫ মার্চ রাতে রেললাইন বস্তির দুই মা পায়ে ও উরুতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কোলে সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। তাদের রক্তে সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের যে দলটি ২৪ নং বাড়িতে হানা দেয়, তারা এই রক্ত দেখে মনে করে অপারেশন কমপ্লিট। ফলে তারা আর বিল্ডিংয়ে ঢোকেনি। আমরা প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেও গুলিবিদ্ধ ওই দুজনকে আমাদের ঘরে টেনে নিই। ডেটল দিয়ে গুলিবিদ্ধ জায়গা পরিস্কার করে তুলা নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেই। ২৭ মার্চ সকালে ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় ২৪ নং বাড়ির অন্যতম বাসিন্দা গণিতের অধ্যাপক ড. সোহরাব ও তার স্ত্রী জ্যোৎ�া ওই দুই মাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে আমরা বেঁচে আছি কি-না তা দেখতে আসেন একে একে আমার আব্বা, জহির রায়হান ও আলমগীর কবীর। আমাদের জীবিত দেখে তারা দ্রুত প্রস্থান করেন। পরে আমাদের বিভাগের সাবেক ছাত্রী জাহানারা ইমাম (প্রয়াত শহীদ জননী) এবং তার পুত্র রুমি (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) তাদের গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। পাকিস্তান বাহিনী টিএসসি বা ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে ঢুকে কর্তব্যরত কর্মচারী আবদুস সামাদ, আবুদুস শহীদ ও লাড্ডু লালকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
রোকেয়া হল প্রাঙ্গনে কর্মচারীদের বাড়িতে ঢুকে পাকিস্তানিরা খুন করে, আহমদ আলী, আবদুল খালেক, ননী, মো. সোলায়মান খান, মো: নুরুল ইসলাম।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কেবলমাত্র ৩৪ জন ছাত্র জগন্নাথ হলেই শহীদ হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে স্বপন চৌধুরী যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয় এবং গণপতি হালদার তার জন্মভূমি মঠবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে। উল্লেখ্য যে, গণপতি হালদার ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে যায়। হলের শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্রদেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি চিৎবল্লী ও জনৈক রাজুকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের কাছে সজনে গাছের নিচে খুব স্বল্প পরিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিসকগণ চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিনজন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন মার্চেই শহীদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা-অজানা অনেক লোক। এদর খুব কম অংশই আমরা জানি। সকলের পরিচিত মধুদা (মধুসুদন দে) জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকট আত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খদেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃতুক্যে বরণ করেছেন। আরো মারা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সুনীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, দাসুরাম, ভীর রায়, মনিরাম, জহরলাল রাজভর, মরভরণ রায়, শংকর কুরী প্রমুখ।
নির্মলেন্দু গুণ ২৮ মার্চ জগন্নাথ হলে এসেছিলেন এবং তৎকালীন ঢাকার একাংশের একটি খণ্ডচিত্র তার এক কবিতায় বর্ণনা করেছেন। তার মতে, কবি আবুল কাসেম জগন্নাথ হলেই মারা যান, কেননা তার মৃতদেহ জগন্নাথ হলের পুকুরে ভাসতে দেখেছেন তিনি। এছাড়া বহুসংখ্যক অতিথিও এই রাতে পাকবাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়েছেন। ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পাল, জগন্নাথ কলেজের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর প্রমুখ ছাত্র ও অতিথিদের নাম সাক্ষাৎকার দানকারীদের কাছ থেকে জানা যায়, যারা ২৬ মার্চ জগন্নাথ হলের গণহত্যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন। জগন্নাথ হলের কিছুসংখ্যক ছাত্র তখন রমনার কালীবাড়িতে থাকতো, ২৬ মার্চ রমনা কালীবাড়িও পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সেখানে নিহত হয় ৫/৬ জন জগন্নাথ হলের ছাত্র। তাদের মধ্যে কেবল অর্থনীতির ছাত্র রমনী মোহন ভট্টাচার্য ব্যতীত আর কারো নাম জানা যায়নি।
উল্লেখ্য যে, শিববাড়ীর ৫ জন সাধুকে ধরে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয়েছে। ২৬ মার্চ রাত ১২ টার পর হতে ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় শতাব্দীর যে নিদারুণ নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়েছিল তা বিক্ষিপ্ত। ফলে এক বা দুজন লোকের পক্ষে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। একেকজন একেক স্থান থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ঢাকা হল সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায়, যার ফলে নিহত হন হলের সহকারী হাউস টিউটর গণিত বিভাগর শিক্ষক শরাফত আলী এবং পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক এ. আর. খান খাদিম। ঢাকা বিশ্বদিব্যালয়ের সরকারি ইতিহাস 'দি হিস্ট্রি অফ দি ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা' গ্রন্থে ঐতিহাসিক এম. এ. রহিম লিখেছেন:
হিসাবমতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ও ২৬ মার্চ সকালে ক্যাম্পাসে প্রায় তিনশ' জন নিহত হয়, যার মধ্যে ১০ জন শিক্ষক, ২৯ জন কর্মচারী, বাকিরা ছাত্র ও অতিথি।
শহীদ মিনার অঞ্চলের আবাসিক এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও তার মুসলমান পালক মেয়ের মুসলমান স্বামীসহ একই সঙ্গে তার বাসভবনে আর শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত ৩৪ নং দালানের সিঁড়ির নিচে এক সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন প্রফেসর মনিরুজ্জামান, তাঁর ছেলে, ছোটভাই শ্যালক এবং প্রফেসর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। উভয় স্থানেই হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের ধারা একই সঙ্গে মিলে যায়, পাকিস্তানিরা উভয় ক্ষেতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে নির্বিচারে গুলি চালায় কারণ তাদের কাছে ড. দেব, ড. মনিরুজ্জামান, ড. গুহ ঠাকুরতার একমাত্র পরিচয় ছিল তারা বাঙালি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস রোকেয়া হলে কী ঘটেছিল এ সম্পর্কে ঢাকাস্থ তদানীন্তন মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট-এ যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিঠলেন সে সম্পর্কে 'দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ৩০ ডিসেম্বর ২০০২ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম কিছুকাল আগে অবমুক্ত 'মার্কিন গোপন দলিল' উদ্ধৃত করে 'রোকেয়া হলে ফ্যানের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা ছিল ধর্ষিত ছয় মেয়ের নগ্ন লাশ' শিরোনামে লিখেছেন,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ফ্যানের সিলিংয়ে ৬ টি মেয়ের লাশ পা বাঁধা নগ্ন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে এক ব্যবসায়ী (আওয়ামী লীগ সমর্থক নন) জানিয়েছেন। প্রতীয়মান হয় মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করার পর গুলি করে ফ্যানের সঙ্গে পা ঝুলিয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকার মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাড, সম্পতি প্রকাশিত 'দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ' (ইউপিএল ঢাকা ২০০০) গ্রন্থে লিখেছেন,
সাতসমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী বালুচিস্তানের কসাই জেনারেল টিক্কাখানের অধিনায়কত্বে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির নিয়ন্ত্রণে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার অধীনে ৫৭ নং ব্রিগেডের ১৮ নং পাঞ্জাব, ৩২ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বালুচ, ১৩ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ৩১ নং ফিল্ড রেজিমেন্ট, ১৩ নং বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট এবং তিনটি কমান্ডো কোম্পানি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ঢাকায় 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামে যে অভিযান পরিচালনা করে তার মধ্যে ১৮ ও ৩২ পাঞ্জাব এবং ২২ বালুচ লে. কর্নেল তাজের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে 'এথনিক ক্লিনিজং' এর উদ্দেশে যখন রক্তগঙ্গা, ধ্বংসের তান্ডবলীলা ও ব্যাপক অগ্নি সংযোজনের মাধ্যমে প্রজ্জলিত নরকে পরিণত করেছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্য বিহীন।
টিক্কা খান ড. সাজ্জাদ হোসেনকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়।
সংগ্রহীত: রফিকুল ইসলাম
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখানে সেরা ইগো কার?
ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।
‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন