রাত নটা। গন্তব্য উত্তরা চার নম্বর সেক্টর হতে আট নম্বর সেক্টরের বাইরে ফায়দাবাদ। রিকশা শিকারী দৃষ্টি রাস্তাতে রাখতেই একটা রিকশা পাওয়া গেলো। আসল ভাড়ার চেয়ে কম দাম হাকাইলাম, রিকশাওয়াল মামা এক দামেই রাজি। পাঁচ-দশ টাকা বাড়ানো নিয়ে কোন ক্যাচালে গেলোনা। এক প্রকার ক্রাশ খাইলাম রিকশাওয়ালা মামার উপর।
মামারে বললাম, মামা বাড়ি কই আপনার? মামায় উত্তর দিলো, ভাই কন। সেকেন্ড টাইম ক্রাশ খাইলাম। এইটা ভাইয়া রিকশাওয়ালা মামা। এই পৃথিবীর কেহ নয়।
তা ভাই বাড়ি কই আপনার? উত্তর দিলো দক্ষিণখান। আবারো প্রশ্ন করলাম, এই বাড়ি না, আসল বাড়ি কই? মামা ভাই উত্তর দিলো, যখন যেখানে থাকি সেটাই আসল বাড়ি। এখন এইটাই।
বুঝলাম ফিলোসপিক্যাল রিকশাওয়ালা মামা ভাই। কথা বার্তা একটু ফিল্টারে মেপে নিয়ে বলতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। রিকশা চলছে ঝক্কর ঝক্কর। রিকশাওয়ালা মামা ভাই নিজের থেকে বলল, আপনার বাড়ি কই? উত্তর দিলাম, এখন রিকশাতেই। মামা ভাই হাইসা দিলো।
সম্পর্ক গভীর হতে শুরু করেছে। রিকশাও চলছে ঝক্কর ঝক্কর। রেলগেটে চলে আসছে। ট্রেন যাবে। অন্যান্য রিকশা গুলো ডান বাম দিয়ে হুসহুস করে পাল্লা দিয়ে যখন লাইন ভেঙ্গে সামনে যাচ্ছে, তখন আমার রিকশাওয়ালা মামা ভাই একই জায়গায় দাঁড়াইয়া।
-ভাই পিছনের গুলো তো লাইন ভেঙ্গে সামনে যাচ্ছে। তুমি দাঁড়াইয়া আছো ক্যান?
-নিয়ম ভাঙ্গমু ক্যা? যা নিয়ম সেই নিয়মেই যামু।
আবার ক্রাশ। এই রিকশাওয়ালা মামা ভাই আসলেই এই পৃথিবীর কেহ নয়। নিয়মের ডিব্বা ওয়ালা। কপালে খারাপি নিয়া ভুল করে সুইজারল্যান্ড বাদ দিয়ে বাংলাদেশে জন্মাইছে।
ভাই বিয়া করছো? জিগাইলাম। উত্তর দিলো, এক মেয়ে আছে, ক্লাশ ফাইভে পড়ে। এইবার আসল জায়গায় আইসা পড়ছি। জিগাইলাম তারা কই থাকে? মামা ভাই একটু হাইসা উত্তর দিলো ওরা ওদের বাড়িতেই থাকে।
মামা ভাইয়ের ইন্টেলিজেন্স উত্তরে আবারো ক্রাশ। ক্রাশ মাত্রা বেড়েই চলছে। কথায় কথায় বলল, যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট ছোট খাটো ব্যবসা শুরু করছিলো। মুরগির ফার্ম ছিলো, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জোর করে দখল করছে।
এইবার একটু নড়েচড়ে বসলাম, কিছু কইলাম না। ঝক্কর ঝক্কর রিকশা চলছে, সাথে মামা ভাইয়ের কথা। গ্রামে তিনটা মামলা আছে, একটা মার্ডার দুইটা ডাকাতি মামলা। সব গুলোই ইউপি চেয়ারম্যান দ্বারা মিথ্যা মামলা। ঢাকায় পালাইয়া থাইকা রিকশা চালাইয়া বউ বেটিরে ভরন পোষন পাঠায়। মামা ভাই তার কাহিনী বলতেই আছে।
মামা ভাইয়ের পরিচয়ের লুকানোর রহস্য বুঝলাম। এক ফাঁকে নাম জিগাইলাম, ভাই নাম কি তোমার। উত্তর দিলো এখন রিকশাওয়ালা। আবারো ক্রাশ। কতগুলো যে হলো এ পর্যন্ত!
গন্তব্যে চলে আসছি। রিকশা থেকে নেমে যা ভাড়া তাই দিলাম। -ভাই তুমি কম ভাড়াতে রাজি হইছিলা। মামা ভাই বলল, আমারে পাঁচ দশ টাকা ঠকায়া আপনের কোন লাভ নাই, আখেরাতে ঠেকে যাইবেন।
মামা ভাই ভাড়া নিয়ে চলে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, আহারে! সব রিকশাওয়াল মামারা যদি ভাড়া নিয়ে ক্যাচালে না গিয়ে এইরকম ভাবতো! সবারই তো আখিরাত আছে। রিকশাওয়ালারও আছে, প্যাসেঞ্জারেরও আছে। এইসব চিন্তা চিন্তা করতে করতে গন্তব্যে চলে আসলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫৮