বাংলাদেশ খারাপ, বাংলাদেশের মানুষ খারাপ! বাংলাদেশের মানুষ আদব কায়দা কিছু জানে না! বাংলাদেশ মানুষ চোর, ছোটলোক, অসভ্য! বাংলাদেশ ইউরোপ বা এ্যামেরিকা থেকে ৫০ বা ১০০ বছর পিছিয়ে আছে! ওহ, এই দেশ নোংরা, হাঁটাও যায় না! বাংলাদেশের অমুক খারাপ, তমুক খারাপ! এ্যমেরিকার অমুক ভালো তমুক ভালো, বাংলাতে সব কালো!
এই ধরনের কথা আমরা প্রায়ই ফেসবুক বা অন্য কোন স্যোসাল মাধ্যমে দেখে থাকি। বিশেষ করে, বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থান করা ইউরোপ বা এ্যামেরিকান প্রবাসী বাঙালী থেকে এই ধরনের বক্তব্য বেশি আসে।
আমার মতামত দেবার আগে, একটা সত্য ঘটনা বলি......
১৯৯৯ বা ২০০০ সালের দিকে, আমার মায়ের সহকর্মী বিয়ে করেন তার ফুফাতো এ্যামেরিকান বোনকে। বিয়ের কিছুদিন পর তিনি তার নতুন বউকে নিয়ে আসেন কর্মস্থলে। যদিও বিয়ের পর নামে মাত্র চাকরি করতেছিলেন, যেথেতু তিনি কদিন পরই এ্যামেরিকা চলে যাবেন। যাইহোক, আমাদের নতুন সেই মামি এসেই বাংলাদেশকে হেয় করতেছিলেন তার কথা মাঝেই, যেভাবেই পারেন। তার মূল বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ চরম অসভ্য দেশ, বর্বর দেশ, নোংরা দেশ, গরীব দেশ ইত্যাদি। আর এ্যামেরিকার সব কিছুই ভালো। সেই সময় উনার কথাগুলো আমার কানে বাজতেছিল। প্রচন্ড খারাপ লাগা সত্যেও কিছু বলতে পারি নাই। উনার কাছ থেকে জেনেছিলাম, একসময় পাটুয়াটুলীর মাইকের ব্যবসায়ী অপি ২ (ডিবি লটারীর দ্বিতীয় টা) মাধ্যমে উনার বাবা স্বপরিবারে এ্যামেরিকা যান! বেশ কয়েকদিন পর একদিনের আড্ডায় উনি আমার এবং আমার বোনের কাছে বলেন, জানো একবার না আমাদের এলাকায় সুপারমার্কেটে লুট হয়েছিল। বিদ্যুৎ না থাকার কারনে নিয়ন্ত্রণ ক্যামেরা কাজ করে নাই! *তখন সম্ভবত আধুনিক সিসি ক্যামেরা ছিল না। আমি সুযোগ পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ্যামেরিকার মানুষ নাকি অনেক সভ্য। তাহলে লুটপাট কেন হল? উনি আমাকে বললেন, এগুলো নাকি অভিবাসী নিগ্ররা করেছে (***এখানেও বর্ণবাদ)! আমার প্রশ্ন ছিল, এ্যামেরিকার অভিবাসী কারা না, রেড ইন্ডিয়ানেরা ছাড়া? উনি আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, সবাই কি একরকম? পরে আমি আর কথা বাড়াই নাই।
যাইহোক এতোগুলো কথা বলার কারন কি আমার? আজ লন্ডন প্রবাসী এক মহিলার আইডিতে দেখলাম উনি, ইংল্যান্ড নিয়ে কথা বলছেন। বাংলাদেশ মানুষ কেন ইংল্যান্ডের পায়ে ধরা উচিত! ইংল্যান্ড ধনী দেশ, বাংলাদেশ পাঁচ লক্ষ অভিবাসী তারা পালন করে, তাদের ভিক্ষা কাজ দেয়। শুধু শুধু তাদের না পালন করে, বাংলাদশীদের যখন তখন বের করে দিতে পারে! খুব দয়ায় পরে তাদের দেশ থেকে বের করে দেয় না। বাংলাদেশের প্রধান রেমিটেন্স নাকি ওখান থেকে আসে। বাংলাদেশের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। উনার লেখাটা ছিল মূলত বাংলাদেশ ইংল্যান্ড খেলা নিয়ে। উনার ভাষায় মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ জিতে বড় ভুল করেছে উনার আরেকটা লেখায় দেখলাম, পাকিস্তান জিতায় শুভেচ্ছা দিয়েছেন! পাকি প্রেমও আছে কিঞ্চিৎ। যাই হোক মূল বক্তব্যে আসি। নিজেদের এতো ছোট ভাবেন কেন, নিজেদের প্রভু ভক্ত দাস বা দাসি কেন যে ভাবেন? প্রথম কথা, বিনা কারনে ইংল্যান্ড বাংলাদেশীদের রাখে নাই, শ্রমশক্তি বা সম্পদ একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ড দয়ায় পরেই এই সব করে নাই। আর বেশিরভাগ হলেন বংশগত বাংলাদেশি,যারা একই সাথে ঐ দেশের এখন আসল নাগরিক। নিজের দেশের লোকদের বের করে দিবে কেন অকারনে? তাহলে তো এ্যামেরিকায় এই কারনে কোন লোকই তো খুঁজে পাওয়া যাবে না! আর ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর রেমিটেন্স আসে এই কথাটাও ভুল। কারন ঐ দেশের মানুষ সাধারণত যায় স্থায়ী বসবাসের জন্য, দেশে টাকা পাঠানোর জন্য না। যদি রেমিটেন্স আসে, তা বেশির ভাগ আসে সৌদি কাতার মালয়শিয়া সিঙ্গাপুর এর মত দেশগুলোর মত থেকে। বাংলাদেশের পরিবার রেখে একা কাজ করতে যায় অনেক সব গরীব কিছু মানুষ। যাদের দেশের প্রতি অফুরন্ত টান, একটা সময় দেশেই তাদের ফিরতে হয়, তাই শিকড়কে তারা খুব সহজে ভুলে না। এবার মনে করি, যদি কোনদিন লন্ডন বাংলাদেশি অভিবাসী সবাইকে বের করে দেয়, তাহলে কি অবে বাংলাদেশের? বাংলাদেশের হিসেবের খাতায় বিন্দু পরিমানেও ক্ষতি হবে না লাভ ছাড়া। বরং একসাথে বিশাল অংকের রেমিটেন্স চলে আসবে, এবং তারাও দেশে বড় অংকের বিনিয়গ করবেন, দেশ চাঙা হবে কিছুটা। ক্ষতি যা হবার লন্ডনের হবে। সেই দেশের জন শক্তি কমে যাবে, বিশেষ করে মেধাবী শ্রমিক হারাবে, যাদের কিছু তাদের নিজেদের তৈরি করা, কিছু বাংলাদেশের তৈরি করা (শিক্ষা, দক্ষতা)। তারা দেশ ছেড়ে চলে যাওযায় বরং বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছিল কিছুটা। এবার আসি ভদ্রতা নিয়ে! ইংল্যান্ড এতোই ভদ্র জাতি একটা সময় ছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ চরম অসভ্য মানুষকে গালি দেয়, ' ব্রিটিশের বাচ্চা ব্রিটিশ' বলে! এই গালিটাই তাদের পূর্বের পরিচয় দিয়ে দেয়। সারা বিশ্ব লুটতরাজ করে, আজ তারা বিশ্বের ভদ্র জাতি সেজেছে! বলবো না, তারা সভ্য হয় নি, তারা অনেক সভ্য জাতি এখন, কিন্তু কাউকে অসভ্য বলার আগে, নিজেদের ইতিহাসের দিকেও তাকানো উচিত। আজও বর্ণপ্রথা সেখানে ভালই শক্তিশালী। আর দেড় দুইশত বছর আগে ভারতবর্ষে তারা কি করেছিল, তা আর নাই বলালাম। এবার অন্য দেশের কথা বলি, এ্যামেরিকা একটাই সভ্য দেশ যে দেশের ট্যাম্পের মত লোকও প্রেসিডেন্ট হয়!? ট্যাম্পের কথা শুনে বুঝা মানুষের চিন্তাগুলো কোথায় আটকিয়ে আছে। আর সারাবিশ্বের দাদাগিরি, অস্ত্রের খেলা তো আছেই। ধর্মীয় ঘৃণা সেখানে বেশ জোড়ালো। এখনো উন্নত প্রায় দেশেই ডানপন্থীরা বেশ ক্ষমতাবান। তারা ক্ষমতাও আসেন! জার্মানে এখনো নৎসি বাহিনী সক্রিয় আছে। তারাও মাঝে মাঝে গুপ্ত হামলা করেছিল বা করছে। গুম খুন এরাও করে, বিশেষ করে বিদেশি নাগরিকদের। বড় ভড় বিশাল অংকের দুর্নীতি তারাও করে। প্যারিস চুরির জন্য বিখ্যাত ছিল, ইউরোপে প্রায় দেশেই বর্ণপ্রথা আজ বিদ্যমান। চরম শাস্তির জন্য ইটালীকে সবাই চিনতো। শান্তির সেরা দেশগুলো জলদস্যু আর ডাকাতের জন্য বিখ্যাত ছিল একসময়! আজও সুযোগ পেলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো *ডিজিটাল দুর্নীতি হয়। অথচ তাদের চাহিদা অনুযায়ী দুর্নীতি কম হবার কথা ছিল! যত গরীব দেশ দুর্নীতির মাত্র বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক অর্থনীতির ভাষায়। রেনেসাঁ বিপ্লবের আগে তাদের চরম অবস্থা সম্পর্কে প্রায় সবার জানা। অতীতের কর্মকান্ডের কথা যদি বলি, তার ঋণ শোধ করতে কয়েক শত বছর লেগে যাবার কথা। এবাবে যদি বলতে থাকি, রাত ফুরিয়ে যাবে তবুও বলা শেষ হবে না।
এবার আসি, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ কি খুব খারাপ দেশ বা খারাপ দেশ কি কখনো ছিল? ইতিহাস কি বলে? আমরা কি সমগ্র জাতিগতভাবে কখনো খারাপ ছিলাম? হ্যাঁ, বাংলাদেশে প্রচুর দুর্নীতি হয় এখন। বিশ্বের সেরা দুর্নীতির দেশগুলো মধ্যে এখন বাংলদেশ একটা দেশ। কিন্তু এই দেশের সাধারন কৃষক, শ্রমিক, বাউল, জেলে এরা কখনোই খারাপ ছিল না। এখনো খারাপ না। এরা দুর্নীতি করে না। খারাপ আমাদের মত শিক্ষিত সমাজ, এরাই দুর্নীতি করতেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায়, জোর করে মগদের অন্যের সম্পদ লুট এই দেশের মানুষদের নাম নেই। সাধারন জনগণও ধর্মান্ধ ছিল না। কিছু আগাছা, এই সময়ে জন্মেছে। যা ভবিষ্যতে হয়তো খারাপের খাতায় নাম চলে যেতে পারে খুব ভালোভাবে। কিন্তু যেভাবে নিজের জন্মভূমির বিরুদ্ধে কথা বলেন ধনী দেশের অভিবাসীরা, তাতে মনে হয় চরম একটা খারাপ দেশ বাংলাদেশ। এদেশের সবাই চোর বাটপার! ভালো মানুষ কেউ নেই! তাদের কল্পনা হয়তো তাদের নিজেদের দিক থেকে। কারন, সবাই নিজেদের মত করে দুনিয়াটাকে ভাবে।
সব কথা শেষ কথা, ভাল মন্দ নিয়েই পৃথিবীর সব দেশ। কোন দেশ ছোট করা বা নিজের দেশকে নিয়ে অহংকার করার জন্য আমার লেখাটা না। কিন্তু যখন দেখি বিনা কারনে, সুযোগ পেলেই জন্মভূমিকে বেদম পিটায়, তখন খুবই খারাপ লাগে। এই খারাপ লাগা থেকে, এই লেখাটা। কাউকে ছোট করার উদ্দেশ্যে লিখতে বসা না।
শেষে, বর্ণবাদ নিয়ে ছোট একটি কৌতুক বলি। এক ইউরোপিয়ান এক বাংলাদেশীকে সুক্ষ অপমান করার জন্য বলতেছিলেন, তোমাদের গায়ের রঙ এই রকম বাদামী কেন? সাদা না হও, অন্তত নিগ্রদের মত কালো হলেও, একটা পদ হত। বাংলাদেশী ব্যক্তি হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, ‘দেখ, তোমার আসলে জানাতে ভুল আছে। ঈশ্বর যখন, মানুষ সৃষ্টি করার জন্য মাটিটাকে চুলায় দিয়েছিলেন, তখন একটা সময় পর বের করে দেখেন, মানুষ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। এরপর ঈশ্বর পরের মানুষটাকে কম সময় রাখলেন। কিন্তু সেইবার মানুষ পুরাই সাদা হয়ে গেছে। এরপর, ঈশ্বর মাঝামাঝি সময় রাখলেন। এবার পরিপূর্ণ বাদামী রঙ এর মানুষ হয়েছে। আসলে আমাদের শরীরের রঙই সঠিক রঙ।
আমার এই লেখাটা, মূলত বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের খেলার পরেরদিন লেখ। নেট না থাকার কারনে, এতদিন পর পোস্ট করা হয়েছে। লেখাটা র, কোন ধরনের সম্পদনা করা হয় নাই। তাই কিছু শব্দ ভুল থাকতে পারে। স্থায়ী অভিবাসীদের অপমান করার জন্য আমি লেখাটা লিখি নাই! আর আমি নিজের স্থায়ী অভিবাসী। কিন্তু তাই বলে নিজের মায়ের দেশকে, দেশের মানুষকে অপমান করি না, করাটাও সহ্য করতে পারি না। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৭ ভোর ৫:১২