এটা একটা আত্মজৈবনিক রচনার খন্ডিত গল্পাংশ। ভারত বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান পশ্চিম-বঙ্গের জলপাইগুড়ী জেলা থেকে ইন্সপেক্টর অব স্কুলস রাজশাহী রেঞ্জ নামে যে শিক্ষা দপ্তরটি পরিচালিত হতো -১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মলাভের পর ওই দপ্তরটি একই নামে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল সংলগ্ন পরিত্যক্ত সংস্কৃত কলেজ ভবনে চালু কয়া হয়। এই দপ্তরটি এখনও সেই ব্রিটিশ আমলের জলপাইগুড়ী আফিসের বেশ কিছু আসবাব পত্রের চিহ্ন ধারন কএ আছে। পরে আবশ্য এর নাম সামান্য পরিবর্তন করে ইন্সপেক্টর অব স্কুলস রাজশাহী বিভাগ করা হয়। ইন্সপেক্টর অব স্কুল পদটি বরাবরই মর্যাদা সম্পন্ন বিভাগীয় পর্যায়ের। সেই আমলে একজন ইন্সপেক্টর কোন জেলা পরিদর্শনে গেলে সংশ্লিস্ট জেলা প্রশাসক (তদানীন্তন ডিএম) রেল স্টেশনে, অভ্যর্থনা জানাতে আসতেন। ১৯৬০ সালে দপ্তরটিকে আরো এক ধাপ উন্নীত করে ডেপুটি ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকসনস বাংলায় উপ-পরিচালক জনশিক্ষা যার বহুল প্রচলিত সংক্ষিপ্ত নাম ‘ডিডিপিআই’ হয়ে যায়। আর তখন থেকেই ইন্সপেক্টর অব স্কুল পদটিকে ডিডিপিআই এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
সে সময় কোন ঐতিহ্যবাহী সরকারী কলেজের অভিজ্ঞ ও ঝানু প্রিন্সিপ্যালদের পদোন্নতি দিয়ে ডিডিপিআই এর মতো গুরুত্তপূর্ন পদে বসানো হতো। জনাব সামসুজ্জামান চৌধুরী,জনাব সামশুল হক, জনাব ইলিয়াস আহমেদ, জনাব এম,এ,করিম প্রমুখ প্রথিতযশা বহুল পরিচিত প্রিন্সিপ্যালগন এই পদ অলস্কৃত করে গেছেন। বিভাগীয় এই শিক্ষা দপ্তরটি সে সময় থেকেই অধিনস্থ জেলা ও মহকুমাগুলী ( বর্তমানে মহকুমা বিলুপ্ত) প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক,মাদ্রাসা, পিটিআই-সরকারী ও বেসরকারী সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রন করতো।
পঁচাত্তর সালের শেষ ভাগে এই অফিসে আমার যোগদানের সময় ডিডিপিআই ছিলেন যমুনা নদীর পূর্ব এলাকার বহুল পরিচিত প্রিন্সিপ্যাল জনাব এম,এ,করিম। স্বল্পবাক রাশভারী ভদ্রলোক। সেই প্রথম দিনেই তার সঙ্গে সামান্য ব্যাপারে ভুল বুঝাবুঝি। আমার কপালে চিরকালই শনির দৃস্টি-কথায় বলে না, “আমি যায় বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে।“ চট্টগ্রাম ডিডিপিআই অফিসেও যোগদানের দিনে চট্টগ্রামের ভাষা বুঝিনা বলাতে ওদের ভাষাতে সুন্দর ভঙ্গিতে অশ্লীল গালি খেয়েও হাসি মুখে হজম করতে হয়েছিলো।
প্রথম দিনের ঘটনার আকস্মিকতায় ভীষণ লজ্জিত বিব্রত, কিছুটা শঙ্কিতও হয়েছিলাম। অফিসের আবাল বৃদ্ধবনিতার রায়- বদলী আমার অবধারিত। ডিডিপিআই অফিসের কৌলিন্য ভঙ্গকারীর কোন অবস্থাতেই আর রক্ষা নেই। এতবড় সাহস! ডিডি সাহেবের মুখের উপর কথা বলা! অগত্যা এই নবাগত অবাঞ্ছিত-আগন্তকের লোটা কম্বল বেঁধে আবারও প্রস্তুতি! প্রতিদিনই সন্ত্রস্ত থাকি এই বুঝি ঘাড় মটকালো! ডিডি সাহেব তো আমার ছাঁয়াও মাড়ান না-মুখ দর্শনও হারাম! সাধারণ বাংলায় ‘একঘরে’ যাকে বলে।
এতবড় অফিসে আমি একেবারেই একা। চট্টগ্রামের মতো এখানেও আমি বহিরাগত। যদিও এই শহরে এই ডিডিপিআই অফিসের সন্নিকটেই আমার জন্ম। অফিসের কুলীনরা সবাই নমশূদ্রের দৃষ্টিতে দেখে। বসার জায়গাটা পর্যন্ত দিতে অনীহা। এই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যেই আবারও একটা উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম। ওই যে বললাম না “শনির ফের”। এক বিদ্যালয়ের সেক্রেটারী,সম্মানিত ব্যক্তি। অফিসেও তার মান্যতা লক্ষণীয়। ভদ্রলোকের স্কুলের কাজটা সমাধা করে দিলে সন্তষ্ট হয়ে আমাকেও সন্তষ্ট করার জন্য হাসি মুখে একটি খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন- আপনি নতুন মানুষ – মনে কিছু নিবেন না – সকলকেই এভাবে দিয়ে থাকি।
তার খামটা গ্রহণে অপারগতা জানিয়ে বললাম, ক্ষমা করবেন – আমি কিন্তু ওই দলের নই। দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। সরকার এ জন্য আমাকে বেতন দেয়। ভদ্রলোক তবুও নাছোড়বান্দা-খামটা টেবিলের ঊপরে রেখে চলে যাবার মুহূর্তে ওটা হটিয়ে দিতে নিচে পড়ে গেলে ভদ্রলোক মনক্ষুন্ন হয়ে ওটা ঊঠিয়ে নিয়ে আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বের হয়ে গেলেন। মনে হলো তার চোখটাই হুমকি দিয়ে শাসিয়ে গেল-এত বড় স্পর্দ্ধা! লোক চেন না!
ওইদিনই ডিডি সাহেবের একটা সালাম পেলাম। যোগদানের পর প্রথম সালাম মানে প্রথম তলব। পরওয়ানা পেয়ে দুরুদুরু বুকে তার রুমে গিয়ে দেখি একাই গম্ভীর মুখে বসে রয়েছেন। সালাম জানালে ইঙ্গিতে বস্তে বললেন। বুঝতে আর বাকি রইল না এই অফিসের ভাত শেষ! কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন,
আপনাকে এ অফিসে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। বাইরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথেও আপনি খারাপ ব্যবহার করছেন। তারা অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছে। ক’দিন আগেই তো চট্টগ্রাম থেকে এলেন এখন আবার কোথায় যেতে চান বলুন? আমাকে নিশ্চুপ দেখে অধৈর্য্যভাবে আবারও বললেন, কি কথা বলছেন না কেন?
মরিয়া হয়ে শেষে বললাম, আমি কোথাও যেতে চাইনা!
মানে?
মানে – রাজশাহীতেই থাকতে চাই!
কিভাবে থাকবেন?
পদত্যাগ করে। তবে তার আগে শুধু জেনে যেতে চাই কার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারটা করেছি। আমি কারো সঙ্গে খারাপ বুবহার করেছি বলে তো মনে পড়ছে না। আজ একজন স্কুল সেক্রেটারী খামের মধ্যে কিছু সন্তষ্টি দিলে ওটা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেছি মাত্র। আর এটাই যদি আমার খারাপ ব্যবহার বা অপরাধ হয়ে থাকে তবে বলার আর কিছু নেই। এছাড়া আর কারো সাথে কিছু হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।
আমার কথাগুলি শুনে উনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করছি আপনি এ অফিসের আর সবার চেয়ে একটু ভিন্ন। কথাগুলি বলার সময় তার চেহারায় কেমন যেন একটা প্রসন্ন ভাব লক্ষ্য করলাম। আবারও বললেন, ভেজালের রাজ্যে খাঁটি জিনিস মেলা ভার। জানেন তো খাঁটি দুধে পানি না মেশালে আজকাল ওটাও হজম হতে চায়না। এ ধরনের হেয়ালী আলাপ করে – আর কিছু না বলেই আমাকে বিদায় দিলেন। রুম থেকে বের হয়ে এলে অফিসের অনেকে করুণার দৃষ্টি মেলে আমাকে দেখলো, দু’একজন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসাও করলেন। কোন জবাব না দিয়ে চলে এলাম।
পরদিন ডিডি সাহেব আবারও আমাকে ডেকে নিয়ে অনেক খোলা-মেলা আলাপ করলেন। আজ তেকে অন্যরকম ডিডি বলেই মনে হলো। বাহির থেকে শক্ত রাশভারী মানুষ মনে হলেও ভিতরটা যে তার এত নরম এই প্রথম বুঝলাম। অনেক আলাপের পর পরীক্ষা সংক্রান্ত গোপনীয় কাজের ভার দিয়ে বললেন, এটাও আপনার একটা পরীক্ষা।
বললাম স্যার,আমি নতুন মানুষ এত বড় দায়িত্ব বহন করা কি সম্ভব হবে?
তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, আমি সঠিক ব্যক্তিকেই দায়িত্ব দিলাম।
ইতিমধ্যে বেশ কদিন পার হয়ে গেছে সেদিন সন্ধ্যার পর অফিসে শুধু ডিডি সাহেব আর আমি, পিটিআই পরীক্ষার ফলাফল সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত। কাগজপত্র সব প্রস্তুত সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ফলাফল পাঠান হবে। এমন সময় টেলিফোনে কে যেন রেজাল্ট জানতে চাইলেন। ডিডি সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলে,রোল নং শুনেই বল্লাম,প্রথম বিভাগে পাশ করেছে।
বললেন, দেখে বলুন?
বললাম সব কাগজপত্র তো আপনার কাছে। নিজে দেখে নিশ্চিত হয়ে জানিয়ে দিলেন। এভাবে পর পর আরো কয়েকটি রেজাল্ট না দেখে বলাতে উনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে জানতে চাইলেন- এটা কেমন করে সম্ভব! এর রহস্যটা কি?
বললাম এর মধ্যে কেরামতির কিছু নেই – এটা একটা প্র্যাকটিস, স্যার। উনি কি বিশ্বাস করলেন জানি না, তবে ক্রমেই তার আস্থাভাজন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। অফিসের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজই আমার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়ে গেল।অফিসের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ঈর্ষার বস্তুতে আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম।
ডিডি সাহেব প্রায় কথা প্রসঙ্গে বলতেন – এ ধরনের অফিসে নীতি মেনে সততা বজায় রেখে সৎভাবে টিকে থাকা খুবই দুরুহ ব্যাপার- পদে পদে বিপদ – হয়রানী হুমকি চাপ লেগেই থাকবে। তার প্রতিটি মূল্যবান উপদেশ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করেছি পরবর্তি কালে। তিনি এখান থেকে চলে যাবার সময় আমার শুভ কামনা করে প্রাণ ভরে দোয়া দিয়েছিলেন।এখান থেকে চলে যাবার পরেও বহুদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল –ঢাকায় তার মনিপুরী পাড়ার বাসায় গেলে আপঞ্জনের মত আপ্যায়ন করতেন।
তখনও আশির দশক শুরু হয়নি-এতদঅঞ্চলের সুপরিচিত ও জনপ্রিয় শিক্ষানুরাগী হাতে গোনা ক’জন মুসলিম বিদুষী মহিলাদের একজন মিস উম্মে আয়েশা চৌধুরী তখন ডিডিপিআই পদে। প্রথম থেকেই তার সুনজরে ছিলাম।একদিন জোর করেই অফিসের হিসেব শাখাটি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন।যে শাখাটির প্রতি সবারই এলার্জী। সেটার দায়িত্ব না নিতে সবাই ওজুহাত খাড়া করে। বদনাম ছাড়া সেখানে সুনাম ভাগ্যে জোটেনা।ম্যাডাম, একান্তে আমাকে ডেকে বল্লেন-এ অফিসে আপনি ছাড়া ওই শাখাটি চালানোর মতো আর কেঊ আছে বলে আমি মনে করি না। যত রকমের জঞ্জাল-জটিলতা মোকাবেলা করার জন্য কি এই শর্মার প্রয়োজন! যেহেতু বরাবরই আমি একটু ব্যতিক্রম। অন্যন্যদের মত গা ভাসিয়ে চলার অভ্যেস নেই –কখনও ছিলওনা। ডিডি ম্যাডাম এর দৃঢ় পদক্ষেপ ও প্রেরনার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই শাখাটিকে একেবারে আপ-টুডেট করতে সক্ষম হলেও নাটোর মহকুমার শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান খানের পুরাতন অভ্যেসটার কোন পরিবর্তন করতে পারিনি। অভ্যেস মতো সেবারও সারা বছরের বিলগুলি জুন মাসে একসঙ্গে জমা দিলেন।অফিস নির্দেশ পালনে গাফলতির জন্য কৈফিয়ৎ তলব প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে বিলের তদবীরে এলে, অফিসের নির্দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ম্যাডামের ঢাকা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শে খান সাহেব গোস্বা হলেন বলেই মনে হলো।খান সাহেব এমনিতেই একজন হাস্যোচ্ছল দিল খোলা মানুষ –তার সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই ভাল কিন্তু ওই দিন একটু গম্ভীর হয়েই চলে গেলেন। নাটোর তার চাকুরীস্থল হলেও রাজশাহী লক্ষীপুর এলাকায় নিজ বাসস্থান থেকেই প্রতিদিন নাটোর যাতায়াত করতেন। ওই দিন অফিস শেষ করে বাইরে একটু কাজ সেরে বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল -যা সাধারণত আমার হয় না। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে গিন্নি গোমড়া মুখে অনুযোগের সুরে বললো,
তুমি অফিসে কার বিল আটকিয়ে রেখেছ? বাড়ীতে এসে হম্বি-তম্বি করে যায়। ও সব উটকো ঝামেলায় জড়াও কেন? ভদ্রলোকের কথাবার্তা খুব ভালো মনে হলো না। বিশেষ করে তার সঙ্গের যুবকগুলি খুব উগ্র, কি সব আজেবাজে কথা বলছিলো, আল্লাহ্-রক্ষা করেছেন তুমি ছিলে না থাকলে কি যে হতো আল্লাই মালুম।
কথাগুলি শুনে মেজাজ গরম হয়ে উঠলো,বললাম, ওদের বাসায় ঢুকতে দিলে কেন? আমার না কড়া নির্দেশ আছে –অফিসের কোন কাজ বাসায় আলাপ করি না।
গিন্নিও সরোসে উত্তর দিলো –তাতো আমরা ভালো করেই জানি,কিন্তু তারা তো কোন নিশেধই মানে না। বাসায় নেই বললেও বিশ্বাস করে না। বলে নাটোর থেকে এসেছি আলাপ না করে যাবো না। মনে হলো ওরা তোমার সঙ্গে গন্ডগোল করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করেই এসেছিলো। শেষে ওদের আপ্যায়িত করে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছি। যাবার সময় অবশ্য ক্ষমা চেয়ে গেছে। এসব লোকদের কেন যে অফিসার বানায় বুঝিনা। গিন্নির উদ্বিগ্নতা রয়েই গেল মনে হলো। এত সব কথা শোনার পর রাত্রে আর ভালো ঘুম হলো না। অভ্যেস মতো পরদিন সকালে অফিস গিয়ে কাজ শুরু করেছি মাত্র পিওন রফিক দৌড়ে এসে বললো,
স্যার, খান সাহেব আসছেন। আমার অনুরোধ ওর সঙ্গে কোন কথা বলবেন না। রফিক আমাদের খুব বিশ্বস্ত অতি আপন জনের মতো। কথা শুনে ওর মুখের দিকে চাইতেই ও বলে চললো, কাল বিকেলে আপনি অফিস থেকে চলে যাবার পরপরই দুই ছেলে সঙ্গে নিয়ে উনি আপনার খোঁজে এসেছিলেন। ছেলেরা চেঁচিয়ে খুব আজে বাজে কথা বলছিলো। আপনাকে এখন কোথায় পাওয়া যেতে পারে। আপনার বাড়িটি কোথায় জানতে চেয়ে আমাকে ধমকা ধমকি করে সারা অফিস তোলপাড় করে গেছে।
রাতে গিন্নির কাছে শুনে এমনিতেই মেজাজটা বিগড়ে আছে তারপর রফিকের কথায় মাত্রাটা আরো এক ডিগ্রি বেড়ে গেল। খান সাহেব আমার কাছে এসেই এক লম্বা সালাম দিলেন। উনি যে কাল থেকে এতকান্ড করে বেড়িয়েছেন মনেই হচ্ছে না। হাসিমুখে সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। অফিসটা ফাঁকা তখনও কেউ এসে পৌঁছেনি। আমি চাপা ক্রোধে ফুলছি। খান সাহেব স্বভাবসিদ্ধ হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলেন,
কাল আপনার বাসায় গেছিলাম। ভাবী সাহেবা যে স্কুলে চাকুরী করেন তাতো জানতাম না। আর আপনি যে এম,এ, তে স্ট্যান্ড করা ছাত্র সে কথাও তো এতোদিনে বলেননি। আপনাকে কিন্তু এখানে একদম মানায় না- ভার্সিটিতে আপনার থাকা উচিৎ ছিল। বাড়ীতে যে আপনি কাউকে ইন্টারভিউ দেন না অফিস সংক্রান্ত কোন আলাপ-আলোচনা করেন না –শুনেও ভাবী সাহেবার হাতের চা খেয়ে এসেছি। তখনও আমি চুপচাপ। তার কোন কথার জবাব দিবার রুচিই নেই। আমাকে ইঙ্গিত করে আরো বললেন, কি ব্যাপার? কথা বলছেন না যে? আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
নিজেকে সম্বোরন করে –শান্ত কন্ঠে বললাম, এখন জরুরী কাজে ব্যস্ত আছি, আপনি দয়া করে আসুন। ডিডি ম্যাডাম ফিরলে তার সঙ্গে দেখা করবেন। আমার চেহারার গুরুগম্ভির ভাব লক্ষ্য করে অগত্যা আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন। খান সাহেবের ঘটনাটি অফিসে জানাজানি হয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করলো। রাতে ছেলেদের নিয়ে বাসায় হানা দিবার কারণে সবাই খান সাহেবকে ধিক্কার জানাতে লাগলো।
ডিডি ম্যাডাম ঢাকা থেকে ফিরলে তার কানেও ঘটনাটির কথা উঠলো, আমাকে ডেকে নিয়ে সবকিছু শুনলেন। আমি হিসাব শাখা থেকে আব্যাহতি দিবার জন্য তার কাছে অনুরোধ রাখলাম। অফিস আদেশ ফলো করতে গিয়ে আমার পরিবার পরিজন হুমকির সম্মুখীন হবে এটা আমি কখনও চাইনা। খান সাহেবের এসব ন্যক্কারজনক কাজে ক্ষীপ্ত হয়ে ম্যাডাম ওই দিনই চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে তার কৈফিয়ৎ তলব করলেন।
তলব পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন খান সাহেব। অফিসে ঢুকেই আমার হাত চেপে ধরে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলেন। ছেলেদের উস্কানিতেই এমনটি হয়ে গেছে – আর কখনও এমন ভুল হবে না। বৃদ্ধ মানুষ তদুপরি হার্টের রুগী। তার আকুতি-মিনতিতে সবারই মন স্পর্শ করে গেল। ডিডি ম্যাডাম যেভাবে ব্যাপারটি নিয়েছেন খান সাহেবের বিভাগের বাইরে বদলী অবধারিত। কিন্তু তার যা মানসিক অবস্থা অর্ডার হয়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে শেষে আমিই তার পক্ষে সুপারিশ করে এ মহাদুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করতে বাধ্য হলাম। তবে ডিডি ম্যাডাম তার দুই ছেলেকে অফিসে নিয়ে এসে বেয়াদবির জন্য মাফ চাওয়ার হুকুম দিলে তারা দুজন ওইদিনই অফিসে এসে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বাবাকে লজ্জা ও দুর্যোগের হাত থেকে উদ্ধার করলো।
আরো বেশ কিছু পরের ঘটনা। উম্মে আয়েশা চৌধুরী তখন রাজশাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে ঢাকা শিক্ষা ভবনে পরিচালকের পদে চলে গেছেন, তার সঙ্গে তখনও আমার যোগাযোগ এবং সুসম্পর্ক বিদ্যমান। খান্সাহেব আরো ঘন ঘন অসুস্থ হতে লাগলেন। রাজশাহী থেকে প্রতিদিন তার নাটোর যাতায়াত অসম্ভব হয়ে উঠলো। প্রায়ই ছুটি কাটাতে লাগলেন। তার অফিসের অচল অবস্থা। চাকুরীও শেষ পর্যায়ে।
একদিন করুণ অনুরোধ রেখে বললেন, আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন যা শোধ দিবার মত নয়। নাটোর যাওয়া আসা আর সম্ভব হচ্ছে না-এভাবে যাতায়াত করলে হয় তো রাস্তার মধ্যেই কবে পড়ে মরে থাকবো। দয়া করে যদি ডাইরেক্টর ম্যাডামকে দিয়ে আপনাদের এই অফিসে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের শূন্যপদে বদলীর ব্যবস্থাটা করে দেন তবে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। এই অসুস্থ-বৃদ্ধ মানুষটির করুণ আর্তিতে সাড়া না দিয়ে পারলাম না।
ঢাকায় গিয়ে ডাইরেক্টর ম্যাডামকে অনুরোধ করে তাকে বদলী করে আনলাম। খান সাহেব আমাদের এখানে বদলী হয়ে এলে তার সঙ্গে সখ্যতা আরো বেড়ে গেল। তার পরিবারেও আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেল। খান সাহেবও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে অনেকটা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। প্রায় প্রতিদিনই অফিস শেষে তার রিকসায় উঠিয়ে আমার বাড়ীতে ড্রপ দিয়ে লক্ষীপুর নিজ বাসায় যেতেন এবং তার পরিবারের অনেক গোপন কথা শুনিয়ে মনটা হাল্কা করতেন।
সেদিন অফিস ছুটির পরও একাগ্র মনে হাতের কাজগুলি শেষ করছি খান সাহেব কাছে এসে অনেকটা আদরের সুরে বললেন – আর কত কাজ করবেন? রাখেন কাল এসে করলেই চলবে। চলেন এখন বাড়ী যাই।
বললাম, খান সাহেব আপনি আজ একাই যান। আমার আরো দেরী হবে। হাতের কাজ শেষ না করে উঠছিনা।
প্রায় আধঘন্টার মত পার হয়ে গেছে রফিক এসে বললো –স্যার খান সাহেব বাইরে আপনার জন্য এখনও অপেক্ষা করছেন। লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখি সিঁড়ির উপর এক পা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
আমাকে দেখেই স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আরে ভাই আমরা একই রাস্তার মানুষ তাই এখনও অপেক্ষা করছি একসঙ্গে যাবো বলে। অগত্যা বাধ্য হলাম তার রিকসায় উঠতে, যদিও ওই দিন অন্যত্র একটু কাজ ছিল। রিকসায় উঠার পর থেকেই খানসাহেবের কথার যেন শেষ নেই, সবই তার পারিবারিক কথা। আমাকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়েও তিনি কথা বলেই চলেছেন।
অনেকক্ষণ আমাদের এ অবস্থা দেখে এলাকার এক পরিচিত জন একটু কৌতুক করে বলেই বসলো – আগামী কালের জন্য কিছু রেখে দেন। দেখি রিকসা ওয়ালাও বেশ বিরক্তি প্রকাশ করছে।
অবশেষে খান সাহেবকে বলতে একরকম বাধ্য হলাম, আজ আর নয়। এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নিন এবং দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। ইনশায়াল্লাহ্ আগামী কাল বাকী সব শুনবো। তাকে আর কোন সুযোগ না দিয়ে খোদা হাফেজ জানিয়ে হাঁটা দিলাম।
পরদিন অফিস শুরুর সময় হঠাৎ অফিসে ফোন এলো খান সাহেবের হার্ট এটাক হয়েছে। খবর পেয়েই ছুটলাম তার বাড়ী। গিয়ে দেখি খান সাহেব আমার উপর রাগ করে মেঝেতে সাদা চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে সটান শুয়ে আছেন। মনে হলো গত কাল কেন তার সব কথা না শুনে মাঝ পথে বিদায় দিলাম,এই তার অভিমান! নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো। আরো এমন কি কথা আমাকে বলে যেতে চেয়ে ছিলেন, কিন্তু বলতে পারলেন না। তার অব্যক্ত, কথা গুলি গুমরে গুমরে নিজের মধ্যেই থেকে গেল।
ভারাক্রান্ত মনে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম।
সেই হাস্যোজ্জল সহজ সরল দিল খোলা সদা তাম্বুল রসসিক্ত রঙ্গিন ভরাট মুখের আমার নিত্য রিকসা সঙ্গিটি আলবিদা জানিয়ে – চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
আল্লাহ তার বিদেহী আত্মাকে শান্তি দিন।