বিনা মেঘে বজ্রপাত বুঝি একেই বলে। বলা নেই কওয়া নেই আচমকা হেড আফিসে বদলীর আদেশ। দিশেহারা হয়ে শেষে শুভার্থীদের পরামর্শে ডাইরাক্টর উম্মে আয়েশা চৌধুরী আপার দ্বারস্থ হতে হলো। টেলিফোনে যোগাযোগ করলে আপা হেসেই বললেন,
এতো বড় সুখবর। তদবীর করে, চেয়ে যা পাওয়া যায়না তা আপনা থেকে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি ভাগ্যবান বটে। এর চাইতে আনন্দের আর কি আছে। হেড আফিসে আসার জন্য তো সবাই লাইন দিয়ে থাকে। আভিমানের সুরে বললাম লাইনে যারা আছে তাদের কাউকে দয়া করে নিয়ে আমাকে রেহাই দিন। ক’দিন মাত্র হলো বড় ছেলেটি ইউএনও স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ চলে গেলো। বাড়ীতে এমনিতেই সবার মন খারাপ। তারপর আবার আমার রাজশাহীর বাইরে বদলী। বাড়ী দেখার মতো কেউ থাকছে না; এ যাত্রা আমাকে রক্ষা করুন।
কিছুক্ষণ আলাপের পর ডাইরেক্টর আপা সহানুভূতির সুরে বললেন – এতো কিছু জানতাম না। জানলে হয়তো এটা ঘটতো না। আর্ডার যখন একবার হয়ে গেছে, এখন তো আর উপায় দেখছি না। সামরিক আইন-কোন আবস্থায় আর্ডার ক্যানসেল করা যাবে না। তবে আমি যখন আছি পরে একটা ব্যবস্থা হবেই। তার মৌখিক আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় যেতেই হলো।
নতুন ক্ষমতায় বসেছেন জেনারেল এরশাদ। আফিস আদালত খুব তটস্থ। স্বয়ং জেনারেল সাহেব সাইকেলে চড়ে অফিস যাচ্ছেন। একটু এদিক ওদিক হবার যো-টি নেই। শিক্ষা ভবনের প্রধান ফটকে বসেছে পুলিশ পাহারা। অফিসের লোকজন ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিশেধ। নিদৃস্ট সময়ের মধ্যে সবাইকে ফটকের ভিতরে ঢুকতে হয়। একটু দেরি হয়ে গেলে আর উপায় থাকে না। এই ভবনের আমি নতুন বাসিন্দা, অচেনা বলে মাঝে মধ্যেই গেটে আটকা পড়ি। পরিচিতজনেরা এসে উদ্বার করে নিয়ে যায়।
ঢাকায় থাকার মতো আমার তেমন কোন জায়গা নেই, আত্বীয় স্বজনও নেই বললেই চলে। চট্টগ্রাম ডিডি অফিসে থাকাকালীন পরিচিত এক বন্ধুর খিলগার বাসায় আপাততঃ অস্থায়ী ডেরা গাড়লাম। বন্ধু ও বন্ধুপত্নী খুবই হৃদয়বান। আদর যত্নের শেষ নাই। থাকার জন্য একটা ঘর ছেড়ে দিলেন। রাজধানী ঢাকায় এমনিতেই বাসস্থান সংকট, তাদের এত বড় উদারতায় সংকুচিত হয়ে গেলাম। দীর্ঘদিনের পেটের রুগী বন্ধুপত্নী আমার জন্য কস্ট করে আলাদাভাবে রান্না করে খাওয়াতেন। যতদিন ঢাকায় ছিলাম তারা আমাকে অন্য কোথাও যেতে দেননি। তাদের ঋণ শোধ হবার মত নয়।
বন্ধুটি অনেক আগে থেকেই ঢাকায় একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা রাখার কথা বললেও তার কথায় কখনও গা করিনি। ইচ্ছে করলেই পারতাম, দামও সস্তা ছিল। তখন কি আর জানতাম এভাবে কখনও ঢাকায় বদলী হয়ে আসতে হবে!
অফিস আদালতে সাধারণত লেট কামারদের শাস্তি হয়, এটাই প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু এরশাদীয় সামরিক আইনে ব্যপারটা অন্য রকম।
একদিন হঠাৎই বেলা চারটের পর অফিসের সমস্ত গেট বন্ধ করে দেয়া হলো। ব্যপার কি? মিলিটারী এক কর্তা অফিস চেক করতে এসেছেন। অফিস ছুটির পুর্বে কে কে অফিস থেকে চলে গেছেন তা চাক্ষুশ পরখ করতে। ওই সময় যাদের উপস্থিত পাওয়া গেলো না তাদের নাম ধাম তালিকাভুক্ত করার পর হুকুমজারী করে গেলেন – অনুপস্থিত তালিকার সবাই আগামীকাল তার দপ্তরে দেখা করবে।
সামরিক আইন বলে কথা! ব্যত্যয় হবার উপায় নেই। অতএব অনুপস্থিতদের হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেল। সামরিক তালিকা মানেই একটা শাস্তির ব্যাপার!
দৈবক্রমে ডিজি ব্রিগেডিয়ার সামশুল ইসলামও ওই সময় অনুপস্থিত ছিলেন। আইনতঃ তাকেও কৈফিয়ত দিতে হয়। এক বিব্রতকর অবস্থা। চারিদিক ফিসফিসানি। শেষে কনফারেন্স রুমে বসলো জরুরী সভা। এই বিশেষ সভায় অনেক আলোচনা হলো কিন্তু পরিত্রাণের রাস্তা কিছুতেই বের হয় না।
এরই মাঝে আমি কিছু বলার অনুমতি চেয়ে ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে লক্ষ্য করে ( কুটনৈতিক চালে) বললাম,
স্যার, সামরিক বাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের অধীনে চাকুরী করছি বলে আমরা গর্বিত। কিন্তু আজ যে ভদ্রলোক শিক্ষাভবন তদারক করে দাপট দেখিয়ে গেলেন –শুনলাম তিনি নাকি একজন নেভাল অফিসার। ওই অফিসার ভদ্রলোকটি কি পদাতিক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ারের চাইতেও ঊঁচু র্যাংকের? নিশ্চয় তা নয়! তা হলে বিনানুমতিতে এ দপ্তরে প্রবেশ করে হম্বিতম্বি করে হুকুমনামা জারী করে গেলেন কি ভাবে? এখন আমাদের ব্রিগেডিয়ার সাহেব কি তার দপ্তরে কৈফিয়ত দিতে যাবেন?
কথাগুলি শুনে ব্রিগেডিয়ার সাহেব একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তার জাত্যাভিমানে ঘা দিতে পেরেছি বলেই মনে হলো। এতক্ষণ দিশেহারার মত মিউমিউ করলেও এবারে একেবারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত ঘোষণা দিলেন,
যাদের নাম লিখে নিয়ে গেছে তাদের কোথাও যেতে হবে না। ব্যাপারটা আমি দেখবো। গুমোট ভাব একেবারে পরিস্কার। সবার মুখে হাসির রেখা। ক্লুটা আমার মস্তিস্কপ্রসুত বিধায় সবার ধন্যবাদ কুড়িয়ে ছিলাম সেদিন।
পরে শুনেছিলাম ব্রিগেডিয়ার সাহেব টেলিফোনে ভীষণ ঝগড়া করেছেন। ব্রিগেডিয়ার সামশুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে একজন দক্ষ সৎ অফিসার ও ভদ্রলোক হিসেবে সুপরিচিত। ওই ঘটনার পর আর কখনও শিক্ষাভবনের চৌহদ্দির মধ্যে কোন মিলিটারীর পা পড়েনি।
বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভিজিটরদের শিক্ষা ভবনে প্রবেশ ছিল এক দুরুহ ব্যাপার। চাতক পাখির মত সারাক্ষণ গেটের বাইরে রাস্তা পাহারা দিয়ে কাটাতে হতো। এতে অবশ্য কিছু টাউট বাটপারদের সুবিধা হয়েছিলো। সামরিক আইনের জু-জু দেখিয়ে বেশ দু পয়সা কামিয়ে নিত। কিছুদিনের মধ্যে আর একটু সহজ হয়ে গেলে পুলিশরা নিজেই ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলো। ওদের হাতে কিছু ধরিয়ে দিলে সসম্মানে ছেড়ে দিত। কিন্তু আমাদের এদিকের মানুষগুলি এ কাজও করতে সাহস পেত না ফলে তাদের ভাগ্যে জুটতো শুধুই হয়রানী। তাই মাঝে মধ্যে বাইরে এসে দেখতাম পরিচিত কোন অভাগাজন অপেক্ষারত আছেন কিনা!
অল্পদিনের মধ্যেই আমার পরিচিতিটা ছড়িয়ে গেলো,ওই সময় ওদের কাছে আমি ছিলাম অকুলের কান্ডারী। এ সব অসহায় নিরীহ লোকদের কিছুটা উপকারে এসে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। শিক্ষা ভবনের এতবড় বিশাল চত্বরে তখন আমিই ছিলাম উত্তর বঙ্গের একমাত্র অঘোষিত প্রতিনিধি।
উম্মে আয়েশা চৌধুরী যেহেতু রাজশাহী থেকে গেছেন অনেকের ধারনা তিনি রাজশাহীর মানুষ। ঢাকায় যাবার পর আমাদের ঘনিষ্টতায় ধারনাটা আরও পোক্ত হয়। কিন্তু আসলে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারের সদস্য। সর্বাধিনায়ক এম,এ,জি ওসমানির নিকট আত্বীয়। সারা জীবিন রাজশাহী অঞ্চলে কাটিয়েছেন বলে এ অঞ্চলের মানুষজনের প্রতি টান বেশী। পরিচিতিটাও ছিল ব্যাপক। এ অঞ্চলের মানুষের অগ্রাধিকার ছিল সব কিছুতেই। অতি আপনজনদের মত ব্যবহার করতেন। সিলেটি স্বভাব কখনও তার মধ্যে লক্ষ করিনি। শিক্ষা ভবনে তিনি ছিলেন এক বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। ব্রিগেডিয়ার সাহেব তার পরামর্শ ছাড়া কোন কাজেই হাত দিতেন না। অফিসের লোকজন তাকে খুব ভয় পেত –তাই গোপনে ‘বাঘিনী’ নামে ডাকতো। এমন সৎ সাহসী, পরিশ্রমী নিষ্ঠাবান দক্ষ অভিজ্ঞ মহিলা প্রশাসক(এডমিনিষ্ট্রার) বাংলাদেশে বিরল। এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ট সাহচার্যে ও সূদৃষ্টিতে থাকা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
শিক্ষা ভবনে টি এন্ড এম সেকশনের দায়িত্বটা ছিল আমার ঘাড়ে। কিন্তু সারা ভবনের যে কোন সমস্যা দেখা দিলে সরাসরি তিনি আমার কাছে পাঠাতেন সমাধানের জন্য। এ সমস্ত কারনে খুব অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা ভবনের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছিলাম। গেঁয়ো উত্তরবঙ্গের নব্য আগত ঠিকানা বিহীন এই অপরিচিত মানুষটির জনপ্রিয়তায় কায়েমী গোষ্টির শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে গেলাম। সামরিক আইনে বদলীর ভয়ে কিছু করতে সাহস পেত না বটে কিন্তু আমি যে ওদের টার্গেট হয়ে যাচ্ছি পরিস্কার বুঝতাম। তাই সুযোগ বুঝে একদিন ডাইরেক্টর আপাকে বললাম,
শিক্ষা ভবনের অনেকে আমাকে সহ্য করতে পারছে না,দয়া করে এভাবে ওদেরকে আমার কাছে পাঠাবেন না। ওরা অপমানিত বোধ করছে।
তিনি বললেন, আরে!এরা কোন কাজ কর্ম জানে?আইন কানুন কিছু বোঝে? এরা বোঝে শুধু পয়সা! সব বেয়াদপ! অযথাই শিক্ষকদের হয়রানী করে। এদের শিক্ষা ভবন থেকে বিদায় করা হবে।
এভাবে।, চললে তো আমার অসুবিধা হবে।
ভয় নেই- কোন চিন্তা করবেন না। ওরা কিছু করতে পারবে না, আপনি নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যান। আমি আছি না?
আমার সেকশনের কাজ শেষ করে অফিস টাইমের পর প্রতিদিনই ডাইরেক্টর আপা আর আমি তার চেম্বারে ফাইলের স্তুপ নিয়ে বসতাম। এতদিনের চাপা ফাইলগুলির মধ্যে ডুবে যেতাম। আপার বাড়ি থেকে আসা খাবার একসঙ্গে বসে খেতাম। বাইরের কোন খাবার কখনও খেতে দিতেন না। অনেক রাত ধরে কাজ করতাম প্রায় প্রতিদিনই। কাজ শেষে তার গাড়ী করে আমাকে বাড়ী পৌছে দিয়ে যেতেন। বলতেন-
আপনাকে পেলাম বলে এতবড় একটা দুরূহ কাজে হাত দিতে সাহস পেলাম। এতদিন এই কাজগুলি ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। কারো খেয়াল নেই। অথচ কাজগুলি কত জরুরি। শিক্ষা ভবনে না এলে আমার জীবনের অনেক কিছু দেখা অপূর্ণ থেকে যেত। ইচ্ছে করলে এখানে অনেক কিছু করার আছে দেশ ও সমাজের জন্য। তখনকার শিক্ষা ভবনের ক্ষমতা ও দাপট অনেক বেশি ছিল, যা এখন আর নেই।
ট্রেনিং এন্ড ম্যান পাওয়ার (সংক্ষেপে যা টি এন্ড এম) সেকশনের পুরা দায়িত্বটা ছিল আমার উপর। সেকশনটি ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডাইরেক্টর আপা সেই কারনেই বোধহয় দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন। টিটি কলেজ ছাড়াও সারাদেশের সরকারী কলেজের অধ্যাপক –অধ্যক্ষদের ট্রেনিং সেমিনার ওয়ার্কসপ সর্টকোর্স ইত্যাদি কাজে বিদেশ পাঠানোর কাজটি ছিল সেই সেকশনের। বরাবরই সেই সেকশনের দূর্নাম ছিল।নথিপত্রে দেখলাম ঢাকা ও আশেপাশের জেলার এমন কোন কলেজ শিক্ষক নেই যিনি বিদেশ যাননি। কারো কারো একাধিক বার হয়ে গেছে। তিনবারও হয়ে গেছে এমন ভি,আই,পি কিছু আছে দেখলাম। অথচ এ অঞ্চলের কারো ভাগ্যে একবারও সুযোগ জোটেনি। এ সম্পর্কে অনেকেরই ধারনা নেই। যে দুচার জন জানেন তারা এখানে কোন পাত্তাই পান না।
একজন এ্যাসিসটেন্টকে লাগিয়ে জেলা ভিত্তিক বায়োডাটাগুলি ভাগ করলাম। দেখা গেল উত্তর অঞ্চলের বায়োডাটায় সংখ্যা অতি নগণ্য। প্রতিটি জেলায় বায়োডাটা ফর্ম পাঠিয়ে দিলাম পূরণ করে ফেরৎ দিবার জন্য আর পরিচিত কাঊকে দেখলেই হাতে ধরিয়ে দিতে লাগলাম।
অল্প দিনেই পূরণ করা বায়োডাটাই অফিস ভরে গেল। এদের মধ্য হতে যোগ্যতা সম্পন্নদের প্রথম সুযোগেই বিদেশ যাবার ব্যবস্থা করে দিলাম যারা কোন দিন কল্পনাও করেননি। আরো কিছুদিন পরে দ্বিতীয় সুযোগও ওই ভাবে যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনীত করে ফেললাম। এসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর (এডি) সাহেব তালিকা দেখে হাসতে হাসতে বললেন,
কি ব্যাপার আলী সাহেব? তালিকার সবাই দেখি আপনাদের এলাকার লোকজন।
বললাম, আমার লোকজন এখানে কেঊ নেই। আমি কাঊকেই চিনিনা এরা সবাই বাংলাদেশী। সরকারী কলেজের কোয়ালিফাইড শিক্ষক, বিদেশ যাবার ক্রাইটেরিয়াই যোগ্যতাসম্পন্ন। পূর্বে যাদের পাঠানো হয়েছে তাদের অনেকেরই যোগ্যতা ছিলো না, সঙ্গে কয়েকজনের নামও ঊল্লেখ করলাম।
এডি সাহেব আমার কথায় রুষ্ট হলেন মনে হলো। অফিসে এ নিয়ে বেশ কানাঘুষা লক্ষ্য করলাম। কায়েমী স্বার্থবাদীদের আঁতে ঘা লেগেছে বুঝলাম। এতোদিন এরা নিজ পছন্দের (যাদের যোগ্যতায় ঘাটতি ছিল) বিদেশ পাঠিয়ে লাভবান হয়েছে তারা কি আর এতো সহজে মেনে নিতে পারে!
এইভাবে আবারও কিছুদিন পর তৃতীয় ব্যাচেও যখন তালিকা তৈরি করলাম এডি সাহেব তালিকা দেখে একেবারে বেঁকে বসলেন। এ তালিকা তার পছন্দ নয়। আসল কথা তার (অযোগ্য) লোকগুলি বার বার বাদ পড়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য কিছু করতে পারছেন না এটাই ভিতরের ক্ষোভ। তার যুদ্ধংদেহি ভাব দেখে বলেই ফেললাম,
অফিসে যতো বায়োডাটা জমা পড়েছে তার মধ্যে সর্বোত্তমদেরই নির্বাচিত করা হয়েছে,এর মধ্যে বিন্দুমাত্র ভেজাল নেই। এদের কেউ আমার আত্বীয় বা বন্ধু নন। এতোদিন কোন নিয়ম নীতি মানা হয়নি, এখন নিয়ম মোতাবেক তালিকা তৈরী করা হয়েছে। এ ধরনের কথায় ভদ্রলোকের অসন্তষ্টির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেল বলেই আমার ধারনা।
কথাটা শেষ পর্যন্ত ডাইরেক্টর আপার কানে গেলে, এডি সাহেবকে ডেকে কড়া ভাষায় বলে দিলেন,
আলী সাহেবের কোন কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। অযথা বাধার সৃষ্টি করলে আপনারই অসুবিধা হবে। অফিসকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্যই উনাকে আনা হয়েছে। উনি আসার পর এই সেকশনের বদনাম কিছুটা কমেছে। তার মতো আরো কয়েকজনকে আনতে পারলে পুরা শিক্ষা ভবনটাই দূর্নীতিমুক্ত করে ফেলতাম। কিছু দূর্নীতিবাজদের তালিকা রেডি করা হয়েছে শীঘ্রই এদের এখান থেকে বের করে দেয়া হবে।
এসব কথা শোনার পর এডি সাহেব একেবারে ঠান্ডা মেরে গেলেন। কাজে হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা তোয়াজ করে অতীত বদনাম ঘুচানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলেন।
ডাইরেক্টর আপার চাকুরিটাও শেষ পর্যায়ে। সুযোগ বুঝে আবারও একদিন বললাম,
অনেকদিন তো হয়ে গেল। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। আর আপনি না থাকলে আমার অবস্থা কি হবে তা তো বুঝতেই পারছি।
আপা সহানুভূতি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আগামীকাল সকাল দশটার আগেই ব্রিগেডিয়ার সাহেবের চেম্বারে আসবেন আমিও থাকবো। দেখা যাক কি হয়।
পরদিন ব্রিগেডিয়ার সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম, সোজা বলে দিলেন এভবনে আপনার খুবই প্রয়োজন ছাড়া যাবে না। আপা আমার জন্য ওকালতি করেও ফল হল না। বিফল মনে ফিরে এসে ডিসিসন নিলাম ছুটি নিয়ে রাজশাহী চলে যাবো যা থাকে কপালে।
আপার সঙ্গে দেখা করাও বন্ধ করে দিলাম। দু তিন দিনের মাথায় হঠাৎ আপার অর্ডালী এসে বললো, ডাইরেক্টর ম্যাডাম আপনাকে সালাম দিয়েছেন। ক্ষুন্নমনেই তার রুমে গেলাম। দেখেই বসতে বললেন, তার মনটাও খারাপ দেখলাম। আস্তে আস্তে বললেন,
যে কাজগুলি শুরু করেছিলাম আশা ছিল ঐগুলি শেষ করেই ছাড়বো কিন্তু তা বুঝি আর হলো না। বুঝলাম তিনি কষ্ট পেয়েছেন। আবারও বললেন, অসমাপ্ত কাজগুলি বুঝি আর শেষ করতে পারলাম না। আমার চাকুরীর এক্সটেনশনের আশ্বাস দিয়েও কার্যকর করলোনা।
তার মুখের দিকে লজ্জিত ভাবে চেয়ে বললাম, আমি দুঃখিত। ঠিক আছে আপা, এখন যেতে চাইনা। কাজগুলি শেষ করেই যাবো।
ড্রয়ারের মধ্যে থেকে একটা বড় খাম বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন –
না,আপনি রাজশাহীতে পরিবারের সাথে মিলিত হলেই আমি বেশি খুশী হবো। এখানে আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে আমি জানি। আর আমি না থাকলে আপনার যে আরো বেশি আসুবিধা হবে সেটাও বুঝি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাসি মুখেই আমাকে বিদায় জানালেন।
এ কয়েক মাসে শিক্ষাভবন যে আমার এত আপন হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। বদলীর খবরটা জানাজানি হয়ে গেলে, যারা এতোদিন বাঁকা চোখে দেখতো।শত্রু ভাবতো।তারা পর্যন্ত ঢাকায় থেকে যাবার অনুরোধ জানাতে লাগলেন। একবার শিক্ষা ভবনে এলে নাকি স্বেচ্ছায় চলে যাবার কোন নজির নেই। আমিই শুধু একটা ব্যতিক্রম। শিক্ষা ভবনে বদলীকৃতদের বিদায় অনুষ্ঠানের কোন রেওয়াজ নেই, কিন্তু কেন জানিনা ওরা আমার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই অনুষ্ঠান করেছিলো। ডাইরেক্টর আপার ভাষায় বলতে হয় “সত্যিই আমি ভাগ্যবান”।