এটা একটা আত্মজৈবনিক রচনার খন্ডিত গল্পাংশ
সৈকতে চেনা মুখ
প্রিয়জনদের করুণ আকুতি, চোখের জল উপেক্ষা করে শুধু আল্লাহকে স্মরণ রেখে অবশেষে রওয়ানা দিয়েই দিলাম। ভ্রমণ করার প্রচন্ড নেশা সেই ছোট্ট স্কুল জীবন থেকেই। সুযোগ পেলেই এদিক –ওদিক চলে গেছি। তাই বলে চাকুরির উদ্দেশ্যে যাওয়া এই প্রথম। যেখানে চলেছি সেখানে কোন আত্বীয় স্বজন এমন কি পরিচিত তেমন কেউ নেই বলেই এত দুর্ভাবনা। মনের মধ্যে যদিও কষ্ট তবুও নতুন জায়গা দেখার নেশায় ভেতর ভেতর রোমাঞ্চিতও হচ্ছি। উত্তরবঙ্গের মানুষ, বিশেষ করে রাজশাহীবাসী ঘরকুনো বদনামটা চিরকালই।
ঢাকায় পৌঁছে পরদিনই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। বাস কুমিল্লা-নোয়াখালির বুকের উপর দিয়ে খাল-বিল,বন-বাদাড়, নদী-নালা ফেরী পার হয়ে ছুটে চলেছে চট্টগ্রামের দিকে। এখনকার মত এত সহজ যাত্রা অবশ্য ছিল না সে সময়, রাস্তাঘাটও এত উন্নত হয়নি। উচু-নীচু পাহাড় ঘন-সবুজ গাছপালা, পাহাড়ের মাথার উপর কি যেন চিক চিক করছে। কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভারাক্রান্ত মনটা ততক্ষণে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আমার এ ধরনের আদিখ্যেতা দেখেই বোধ হয় পাশের সীটের ভদ্রলোক বলেই ফেললেন-
চট্টগ্রামে প্রথম বুঝি?
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই কৌতুহল মেটাতে ভদ্রলোক একের পর এক বলে গেলেন ধারা বর্ণনার মত। চট্টগ্রামের বাসিন্দা ঢাকায় কাজে গিয়েছিলেন ওর কাছ থেকেই চট্টগ্রামের পুরা ধারনা পেয়ে গেলাম। আর অবস্থানের জন্য ভালো একটা হোটেলের নাম-ঠিকানাও দিয়ে দিলেন। এখনকার মত সময় হলে হাইজ্যাকারের পাল্লায় পড়ে নির্ঘাৎ সর্বস্বান্ত হতে হতো। পথই যে পথের ঠিকানা বাৎলিয়ে দেয় সেটা প্রমাণিত হলো। আমার এতক্ষণের ভাবনা ও দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল।
রাতে হোটেলে খুব একটা ভালো ঘুম হলো না। সারা রাতই ফেলে আসা প্রিয়জনদের করুন মুখগুলি মনের পর্দায় বার বার ভেসে উঠতে লাগলো। খুব ভোরে উঠে বাইরে এদিক ওদিক একটু পায়চারী করে ভোরের শান্ত স্নিগ্ধ চট্টগ্রাম দেখে কিছু সময় কাটিয়ে পরে রওয়ানা দিলাম ভদ্রলোকের দেয়ে জামালখান রোডের ঠিকানায়। উঁচু টিলা কেটে নির্মিত দ্বিতল ভবনের সম্মুখে সাইন বোর্ডে লেখা দেখেই মনের মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠলো-এই-ই আমার সেই কাঙ্খিত অফিস। ভেতরে ঢুকে দেখি নক্সাদার পাঞ্জাবী পরিহিত চেহারা অনেকটা অবাঙ্গালীর মত, বয়স্ক এক ভদ্রলোক টেবিলের উপর লোবান কাঠি জ্বালিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যান মগ্ন হয়ে রয়েছেন।
সরকারী অফিসে এ ধরনের দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। আমার পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানাতেই ভদ্রলোক বেশ খাতির করে বসিয়ে চা এর ফরমাইস দিলেন। তখনও অফিসে তেমন কেউ এসে পৌঁছেনি। ভদ্রলোক অফিস বিল্ডিং এ অবস্থান করেন হেতু প্রত্যহ এমনি সময়ই অফিসে বসেন বলে জানালেন। চাকলাদার সাহেব এ অফিসের উচ্চমান সহকারী। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা, দীর্ঘদিন খুলনা ডিডিপিআই অফিসে কর্মরত থাকার পর সরকারের নতুন নীতিমালার ফাঁদে পড়ে আমারই মত পরিবার পরিজন ফেলে রেখে বাংলাদেশ ম্যাপের সর্বনিম্নে বঙ্গোপসাগরে ঝুলন্ত লেজ বিশিষ্ট অসমতল ভূমি এই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অবস্থান নিয়েছেন। ভদ্রলোকের চাকুরিও শেষ পর্যায়ে।
রাজশাহী থেকে গেছি শুনে অফিস আগত প্রায় সকলে একবার করে উকি দিয়ে যাচ্ছে নব্য আগন্তুককে। রাজশাহী ওদের কাছে অনেকটা অপরিচিত বলেই মনে হলো। এরই মধ্যে সুন্দর চেহারার এক উচ্ছল যুবক জিজ্ঞেস করে বসলো-আমি চট্টগ্রামের ভাষা বুঝি কি’না?
না। একেবারেই বুঝিনা। বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের চট্টগ্রামের ভাষায় হাসি হাসি মুখে সুন্দর করে গালি দিল-বলার ভঙ্গিতেই বুঝতে পারলাম। কিন্তু না বোঝার ভান করে বোকার মত চুপ করে থাকলাম। পরে একদিন গালাগালির প্রসঙ্গ ওঠাতেই ও লজ্জা পেয়ে ক্ষমা চাইল। বললাম-
ভাষা না বুঝলে সেদিন গালাগালিটা ঠিকই বুঝেছিলাম। তোমাদের চট্টগ্রামে নতুন কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর এটাই রীতি বুঝি? সেদিন ও খুব লজ্জা পেয়েছিল। ও এ অফিসের সর্বকণিষ্ট ষ্টাফ। চট্টগ্রামেরই ছেলে। খুব চটপটে এবং ভীষণ আমুদে। চট্টগ্রামের মানুষগুলিকে বেশ আত্বকেন্দ্রিক বলেই আমার মনে হয়েছিলো। স্থানীয় ভাষায় কথা না বলতে পারলে পদে পদে ভোগান্তির সম্মুক্ষীণ করতে ছাড়ে না। তবে নোয়াখালীর দাপট লক্ষ্য করার মত-অফিস আদালত ব্যবসা-বানিজ্য সর্বত্রই ওদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
বসের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য সেকশন সহকারী কবির সাহেব দোতলায় নিয়ে গেলে ভদ্রলোক হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে খুব আন্তরিকতার সাথে কুশল বিনিময় ও আলাপ করলেন। তার আন্তরিকতা ও আলাপচারিতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পঞ্চাশ উত্তীর্ণ ভদ্রলোক চেহারায় পোষাক পরিচ্ছদে সৌখিনতার ভাব স্পষ্ট। বিভিন্ন সরকারী কলেজে দীর্ঘদিন প্রিন্সিপ্যালগিরি করে পদোন্নতি পেয়ে ডিডিপিআই পদে যোগ দিয়েছেন। কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহনকারী মীর আবু সালেক রাজশাহী কলেজের এককালের বেশ পরিচিত ছাত্র। এখানের বহু স্মৃতি এখনও তার মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করছে। রাজশাহীর অনেকের অনেক খবরাখবর জানতে চাইলেন। এতক্ষণ তার রুমে যে ভদ্রলোকটি বসেছিলেন, আমার দিকে চেয়ে হঠাৎই জিজ্ঞাসা করলেন-
এম.এ. তে আমার সাবজেক্ট কি ছিল? তখনও তার পরিচয় জানিনা তবুও ভদ্রতার খাতিরে জবাব দিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেয়াড়া ধরনের আরো একটা প্রশ্ন করলেন-নিশ্চয় আপনার ক্লাশ ছিল না?
কথাটা শুনে মনে মনে বললাম, এ আবার কোন ধরনের ভদ্রলোক রে বাবা! তার দিকে চেয়ে খুব শান্ত গলায় বললাম, জ্বি ছিল।
বিস্ময়ের সুরে ভদ্রলোক আবারো বললেন-আপনার সেকেন্ড ক্লাশ ছিল?
কিছুটা বিরক্তির সাথে বললাম- কেনো? আশ্চর্য হবার কি আছে, সেকেন্ড ক্লাশের উপরে আর কোন ক্লাশ নেই নাকি!
এবারে ভদ্রলোক মুখটি কালো করে একেবারে চুপ মেরে গেলেন। ডিডিপিআই সাহেব এতক্ষণ চুপ থেকে এবারে একটা হাসি দিয়ে বললেন-কি ইন্সপেক্টর! সখ মিটেছে তো! নতুন কাউকে দেখলেই কোয়ালিফিকেশনের খোঁজ। নিজে থার্ড ক্লাশ বলে আর সবাইকে ওই মাপেই দেখেন তাই না? কথা শেষ হবার সাথে সাথে ভদ্রলোক মন খারাপ করে চলে গেলেন। তার ওইভাবে চলে যাওয়াতে নিজেকে খুব লজ্জিত ও বিব্রতবোধ করতে দেখে, ডিডিপিআই সাহেব বললেন-
ইসলাম সাহেব আমাদের স্কুল ইন্সপেক্টর, আফিসে দ্বিতীয় ব্যক্তি- তার ওই এক ম্যানিয়া, অফিসে তার চাইতে কার ক্লাশ কম কার বেশী সারাক্ষণ এই তার চিন্তা ভাবনা।
যতদিন চট্টোগ্রামে ছিলাম ভদ্রলক আমার সঙ্গে আর কখনও স্বাভাবিক ব্যবহার করেনি। এই মিঃ ইসলাম বৃহত্তর নোয়াখালীর অধিবাসী, সরকারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আগাম পদোন্নতি পেয়ে স্কুল ইন্সপেক্টর হয়ে গেছেন।
হোটেলের আতপ চালের ভাত মুখে আর রুচে না। কবির সাহেব একদিন সিদ্ধ চালের ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলেন হোটেল মিশকাতে। তখন ওই হোটেলটির খুব নাম ডাক। অনেকদিন পর সিদ্ধচালের ভাত দেখে খুশীতে মনটা নেচে উঠলো। এখানে আতপ চালের ভাতটা খুব কমন। সিদ্ধচালের ভাতের দাম বেশী বলে সবাই খায় না, অনেকটা সৌখিন বলা যায়। বয়টি ভাতের প্লেট রেখে বুক টান করে বললো- স্যার, এটা বিদেশী চালের ভাত।
ভাত দেখে ওকে বললাম-দুর ব্যাটা! এটা আমাদের ঝিঙ্গা চালের ভাত। বাড়ীতে প্রতিদিনই আমরা এ চালের ভাত খাই। বয়টি চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ের সুরে বললো-
স্যার, এ চালের ভাত আপনারা প্রতিদিনই খান!
বললাম-আমার মত আরো অনেকেই খায়।
ওর তাকানো দেখে মনে হলো আমি বিশেষ একটা কেউকেটা কিছু।
কিছুদিনের মধ্যেই ডিডিপিআই সাহেবের অনুগ্রহে অফিসের চিলেকোঠায় থাকার একটা ঠাঁই মিললো এবং অফিস মেসেরও একজন সদস্য হয়ে গেলাম। এখানে ডিডিপিআই সাহেব ছাড়া আর সবাই সদস্য। দুপুরে সবাই এখানে খাওয়া-দাওয়া করে থাকে। ডিডিপিআই সাহেব নিকটেই ষ্টেডিয়াম পাড়ায় সরকারী কোয়াটারে বসবাস করেন। পরিবার পরজন মাঝে মাঝে এখানে এলেও ঢাকায় তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করে। ডিডি মীর আবু সালেক আমাকে পেয়ে অনেক খোস গল্প করতেন একেবারে আপন জনের মতো। আমাকে পরিবার পরিজন নিয়ে যাবার জন্য চাপ দিতে থাকলেন। আমার মিসেস স্কুল টিচার শুনে তিনি চট্টগ্রামের চাকুরির নিশ্চয়তাও দিলেন। কিন্তু সেখানে বসবাস করতে আমার মন থেকে কিছুতেই সাড়া মিলছিলো না। বিশেষ করে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত চিন্তা করে।
চট্টগ্রামে পৌঁছার পরদিন থেকেই সেখানকার দর্শনীয় স্থানগুলিতে ঢুঁ মারা শুরু করেছি। প্রায় প্রতিদিনই নতুন কিছু স্থান দেখা এবং অফিস শেষে নিউ মার্কেটে পরিচিত মুখের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘোরাফেরা করা আমার প্রত্যহিক রুটিনে পরিণত হয়েছিলো। আর ছুটির দিনেতো দূরে কোথাও প্রোগ্রাম।
একা একা এভাবে রাস্তা বেড়ানো নাকি নিরাপদ নয়। চট্টগ্রামের লোকজন এ অফিসের প্রতি সন্তষ্ট নয়। কিন্তু যেহেতু আমি কারো অন্যায় করিনি অতএব আমার কোন ভয়ও নেই। বরং বাইরে যাদের সাথে আলাপ হয়েছে তাদের কাউকে খারাপ মনে হয়নি।
ডিডিপিআই সাহেব একদিন অফিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে-সোজাসুজি বলেই দিলাম, ডিডি অফিস সম্পর্কে এখানকার লোকজনের ধারনা খুব ভালো নয়- বিষয়টা আপনার দেখা দরকার।
এ অফিসের অধিকাংশ ষ্টাফ একই জেলার লোক হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী জোট আছে এবং অফিসের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিটির নেতৃত্বেই তারা পরিচালিত হয়ে থাকে। ডিডি মীর আবু সালেক ওদের কাছে জিম্মি- অসহায় বলেই আমার মনে হয়েছে। আর তাই ডিডি সাহেবের সাথে আমার সু-সম্পর্কটা ওরা বাঁকা চোখেই দেখে। অফিস শেষ করে সারা দিনের ‘কালেকশন’ এর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অফিস চলে এক অদৃশ্য চেনের মাধ্যমে। আমি ওদের কাছে একেবারেই বহিরাগত।
একদিন সকালের দিকে লম্বা আলখাল্লাধারী সুন্দর হাসি মাখা এক মৌলানা আমার রুমে এসে সালাম জানালে-তাঁকে বস্তে বলতে অসহায়ের মত কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন- স্যার আপনি এখানে নতুন এসেছেন বুঝি? এ অফিসে এমনভাবে কেউ বস্তে বলে না কখনও। সেই নোয়াখালি থেকে আসি কোন কাজ হয় না শুধু হয়রান হই। দয়া করে যদি আমার মাদ্রাসার কাজটার একটু ব্যবস্থা করে দিতেন আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দোয়া করতাম।
মৌলানা সাহেবের এধরনের আকুতিতে তার প্রতি কেমন যেন একটা মায়া হলো। কবির সাহেবকে বললাম,
আর কোন হয়রানী নয়, মৌলানা সাহেবের কাজ আজকেই করে দিতে হবে। কবির সাহেব কেমন যেন অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালেন। এই কবির সাহেবের বাড়িও নোয়াখালি, তবে অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন বলেই আমার মনে হয়েছে। দৃঢতার সাথে বললাম-
কোন কথা নয়- যার কাছে যেভাবেই থাকুক আজকেই হতে হবে। মৌলানা সাহেবকে তার সামনেই বললাম, কোথাও আপনাকে আর যেতে হবে না। আমার সামনে এখানেই বসে থাকবেন।
বেচারা কবিরের দৌড়াদৌড়ি ছুটাছূটির এক পর্যায়ে আমি বাইরে গেলে কানে এলো ও কাকে যেন বলছেন- এটা আলী সাহেবের নিজের কেস-কোন বেনিফিট পাওয়া যাবে না। আজই করে দিতে হবে।
আমার এহেন কর্মে সারা অফিসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। আমি অফিসের ঐতিহ্য নষ্ট করে ফেলছি।এভাবে চললে নাকি সবাইকে পথে বসতে হবে। কিন্তু আমি যতদিন চট্টগ্রামে ছিলাম- আমার কাছে এসে কেউ কাজের কথা জানালে, আর্জি করলে আমি ওই ভাবেই করে দিয়েছি। দূর্নীতিবাজদের মন সর্বদাই দূর্বল থাকে। আমার কোন দূর্বলতা ছিলনা বলে কাউকে ভয়ও পেতাম না।
চট্টগ্রামে এসে পৃথিবী বিখ্যাত সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার দেখা হবে না-এটা কি হয়! এক ছুটির দিনে একাই রওয়ানা দিয়ে দিলাম। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় একশত মাইল দূরে-গভীর জঙ্গল ভেদ করে ‘বন্য জন্তু হতে সাবধান’ বাণী এড়িয়ে বিডিআর এর তল্লাশী শেষ করে বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ সৈকত নগরীতে নির্দিষ্ট সময়ের একটু পরই পৌঁছালাম। আসার সময় অফিস থেকে বলা হয়েছিলো পিটিআই অথবা সরকারী স্কুলের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আর কোন সমস্যাই হবে না। বাস থেকে নেমে ব্যাগটা হাতে নিয়ে চিন্তা করছি পিটিআই-না সরকারী স্কুল -কোথায় যাই। ঠিক এমনি মুহূর্তে অকল্পনীয়ভাবেই চোখের সামনে এক অতি পরিচিত মুখ দন্ডায়মান! একি কল্পনা-না বাস্তব? কিছু বুঝতে পারছিনা। দুজনেই অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছি। কোন কথা নেই কারো মুখে। বোধ হয় কেউ বিশ্বাস করতে পারছিনা। শেষে ওই রাস্তার মাঝেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে একই প্রশ্ন করে ফেললাম- তুমি এখানে কেন?
স্কুল জীবনের সহপাঠি বন্ধু গিয়াস যে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডে আছে এই খবরটা আমার জানা ছিল না। সব পরিকল্পনা ওলট-পালট করে তার আতিথ্য গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না। ও পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে বেশ সুখেই আছে মনে হলো। তবে এই সমুদ্রের দেশে পরিচিত তেমন কারোই দেখা পাওয়া যায় না। এই তার খেদ। দুই বন্ধু অনেকদিন পর মিলিত হয়েছি- কথা শেষ হচ্ছিল না। তার ছেলে মেয়েরাও আমাকে পেয়ে ভীষণ খুশী। বন্ধুপত্নীর আদর আপ্যায়নের আর শেষ নেই। তার কোয়ার্টার আর সৈকত একেবারে লাগোয়া।
খুব ভোরে গেলাম এতদিনের লালিত স্বপ্ন সৈকত দেখতে। কিন্তু একি! – এ যে এহালী কান্ড! এই অন্ধকার ভোরেই মনুষ্য মেলা। হাজার হাজার সমুদ্রপ্রেমি মানুষে ভরপুর। আনন্দ ছুটাছুটি-লাফালাফির শেষ নেই। মনে হলো আমিই বোধ হয় সবার শেষে গেছি। স্নান সেরে ঝিনুক কুড়িয়ে ফিরতে কিছুতেই ইচ্ছে হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল, আমি আবারও সেই কিশোর বয়সে ফিরে গেছি। এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দর্শন এক অপূর্ব দৃশ্য, না দেখলে বর্ণনা করে বোঝান সম্ভব নয়। নাস্তা সেরে বন্ধুকে নিয়ে প্রথমে নিকটস্থ পিটিআই সাহেবের বাংলোয় গেলাম পরিচিত হতে। সুপার সাহেবের পিওনকে নিজ পরিচয় দিলে ও ভিতর থেকে ফিরে এসে জানাল, স্যার, পরীক্ষার কাজে খুব ব্যস্ত এখন বের হতে পারবেন না।
ডিপার্টমেন্টের লোকের এহেন ব্যবহারে বন্ধুর কাছে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল। অফিস থেকে কিন্তু এদের ঠিকানাই দিয়েছিলো- এরা সব রকমের ব্যবস্থা করবে বলে। রাগে দুঃখে মেজাজটা তিরিক্ষ হয়ে গেল। এ কোন জায়গারে বাবা! নূন্যতম ভদ্রতা জ্ঞান, সৌজন্যবোধ কিছুই নেই! অথচ সমাজে এরা শিক্ষিত মানুষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে বসে রয়েছেন। বন্ধুকে শুনিয়ে বললাম-
কোন জায়গায় তুমি বাস করছো? রাজশাহীর মানুষ হলে কি এমন ব্যবহার করতে পারতো? মাঠ পেরিয়ে গেটের কাছে চলে এসেছি দেখি ওই পিওনটা ডাকাডাকি করতে করতে পিছু পিছু ছুটে আসছে।
আপনারা আসুন, স্যার বেরিয়েছেন আপনাদের সাথে দেখা করার জন্য। এ ধরনের ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করার তখন আর আমার কোন আগ্রহই নেই। কিন্তু বন্ধুর পীড়াপীড়িতে বাধ্যহলাম ফিরতে। সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত পৌঢ় ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন।
সুযোগ সন্ধানীরা মাঝে মধ্যেই এসে জ্বালাতন করে পরীক্ষা পাশের ব্যাপারে। আমি ওদের কথাই চিন্তা করেছিলাম। আগামী কালই পরীক্ষার গোপনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে কিনা সে জন্যও খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে আছি। আপনারা রাজশাহীর লোক শুনে সব ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসেছি। রাজশাহীর মানুষের কাছে আমি ভীষণভাবে ঋণী। তার মুখের দিকে চাইতেই বললেন-
নওগা পিটিআইতে দীর্ঘদিন ছিলাম, ওই অঞ্চলের মানুষের ব্যবহার আতিথেয়তা কোনদিনই ভোলার নয় ( নওগাঁ জেলা তখন রাজশাহীর অধীনে ছিল) বাংলাদেশে এমন সহজ সরল ভালো মানুষ আর কোথাও আমার চোখে পড়েনি। চট্টগ্রাম ডিডিপিআই অফিসার হিসাবে নয় রাজশাহীর মানুষ হিসাবে আপনাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। দয়া করে আমার আতথ্য গ্রহন করলে কৃতার্থ হবো।
অপারগতা জানিয়ে- ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম। এরপর আর কোন সরকারী স্কুলে যাবার ভরসা পেলাম না। বন্ধু, বন্ধুপত্নীর অনুরোধে আরো একদিন কক্সবাজারে কাটিয়ে ফিরে এসে অফিসে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম।
বরাবরই আমি পেটের পীড়ার রুগী। নতুন জায়গায় খাওয়ার অনিয়মে পুরাতন অসুখটা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। ঔষুধপত্রে কোন কাজ হয় না। ডিডিপিআই সাহেবের সঙ্গে অনেক বার্গেনিং করে শেষে ৫ দিনের ছুটি মঞ্জুর করলাম। যদিও ট্রেনে যাতায়াতে রাস্তাতেই চারদিন শেষ হয়ে যায়।
এর মধ্যে হঠাৎ রাস্তায় একদিন দেখা হয়ে গেল ঢাকা হেড অফিসের এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে, আমার অবস্থা দেখে বদলির একটা আবেদন করতে বললেন। ডিডি সাহেব আমার বদলী আবেদনে সুপারিশ করবেন না জানালে, ভদ্রলোক নিজে থেকে চেষ্টা করে দেখবেন বলে সান্ত্বনা ও আশ্বাস দিয়ে গেলেন।
ছুটিতে রাজশাহী এলে আমার অসুখটা আরো বেড়ে গেল। ঔষুধপত্র খেয়ে ডাক্তারের পরামর্শে চলতে লাগলাম। আত্বীয়-স্বজনরা চট্টগ্রামে আর ফিরে না যাবার পরামর্শ দিল। আমিও মনে মনে ঠিক করে ফেললাম চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে দেব।
ঠিক এমন সময় দেশে এক মহাবিপর্যয় ঘটে গেল। জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বাংলাদেশের স্থপতি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষনা করা হলো। দেশ মারাত্মক এক সঙ্কটের সম্মুখীন। মহান নেতার এই মর্মান্তিক পরিণতির ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী-সন্ত্রাসী, খুনী, লুটেরা দল, যারা এ পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী তারা রাতারাতি গা ঢাকা দিল। অনেকে পার্শ্ববর্তীদেশে পালিয়ে গেল। দেশের এই টালমাতাল অবস্থায় চট্টগ্রাম অফিস থেকে টেলিগ্রাম এলো সত্ত্বর চাকুরিতে যোগদানের জন্য। অগত্যা আবারো ফিরে আসতে বাধ্য হলাম বন্দর নগরী চট্টগ্রামে।
অতিরিক্ত ছুটি কাটানোর জন্য ডিডি সাহেব আমার প্রতি ভীষণ নাখোস। আমার কোন কথাই আমলে আনেন না। মাস পার হয়ে গেল কিন্তু ছুটি মঞ্জুরির কোন সুরাহা হলো না। শেষে বেতন বন্ধ হয়ে গেল। ডিডি সাহেব কোন অনুরোধ মানতেই রাজী নন। অনন্যোপায় হয়ে শেষে কলম ধর্মঘটে বাধ্য হলাম। কথাটা ডিডি সাহেবের কানে গেলে তিনি জরুরী অবস্থার ভয় দেখালেন। সব ধরনের ধর্মঘট তখন নিষিদ্ধ। আমার মরিয়া ভাব দেখে ডিডি সাহেব শেষ পর্যন্ত এই অচলাবস্থার অবসান ঘটালেন।
রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই না দেখে দেশে ফিরে যাবো তা তো হয় না। এবারে কিন্তু আর আগের ভুলটা করলেম না। একজন সহকারী স্কুল পরিদর্শক সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে ট্যুর প্রোগ্রাম করে নির্দিষ্ট দিনে রওয়ানা দিলাম। রাঙ্গামাটি জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক সাহেব বাস ষ্ট্যান্ড থেকেই অভ্যর্থনা জানিয়ে তার বাংলো কাম অফিসে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক একাই থাকেন, কিন্তু তার বাসা ভর্তি কাঠের বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রীতে একেবারে ঠাসা। এখানে কাঠ খুব সস্তা, কিন্তু বাইরে নিয়ে যাওয়া নিষেধ। তবে ফার্নিচারে বাধা নেই। তাই ফার্নিচার বানিয়ে রেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য। ভদ্রলোকের বৈষয়িক জ্ঞান তারিফ করার মতো। মজার মজার গল্প শোনালেন, বেশ আমুদে হাসি খুশি মানুষ।
উনি প্রথম যেদিন এখানে আসেন ভোরে দরজা খুলেই দেখেন এক পরমা সুন্দরী চাকমা যুবতী করজোড়ে দোরগোড়ায় দন্ডায়মান। তাকে দেখামাত্র সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাতে ভদ্রলোক একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই নির্জন প্রত্যুষে সুন্দরী যুবতী তাও আবার একাকী। মাথা নত অবস্থায় যুবতী করজোড়ে জানাল-
আপনি বিদ্যার প্রতিনিধি- আপনাকে অর্ঘ দিতে এসেছি। দয়া করে গ্রহন করে ধন্য করুন। ডালাভর্তি ফুল-ফল ও মিষ্টি। তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি-একি স্বপ্ন না সত্য।
অথচ এত সহজ সরল নম্র ভদ্র মানুষগুলি আজ হিংস্র হয়ে উঠলো, এরা আজ অস্ত্র ধরতে বাধ্য হলো। দেখলাম এখানে কাকগুলি পর্যন্ত আমাদের দেশের মত অযথা কা কা করে পাড়া মাত করে না। নতুন মানুষ দেখেও এখানের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসে না। ভোরের মেঘগুলিকে মনে হচ্ছিল রাতের ঘুমের আলস্য এখনও কাটেনি। হাত দিলেই ওদের নাগাল পাওয়া যাবে। এমন শান্ত স্নিগ্ধ নির্মল পরিবেশ আমি আর কোথাও দেখিনি। সরকার যদিও এদের বিভিন্ন রকম সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন কিন্তু দীর্ঘদিনের অবহেলা বঞ্চনায় এরা বিদ্রোহী হতে বাধ্য হয়েছে। এখানে একমাত্র চট্টগ্রামের উপজাতি ছাড়া আর সবাই তাদের ভাষায় ‘নোয়াখালি’-যার মানে তাদের ঘৃনার শত্রু।
অফিসে ফিরে এসেই শুনলাম রাজশাহীতে আমার বদলীর আদেশ হয়েছে। খুশীতে মনটা নেচে উঠলো। মনে মনে ওই ভদ্রলোককে কৃতজ্ঞতা জানালাম তার কথার মর্যাদা রাখার জন্য। কিন্তু ডিডি সাহেব একেবারে বেঁকে বসলেন। তিনি আমাকে ছাড়তে নারাজ। কেননা তিনি আমার বদলী আবেদনে সুপারিশ করেননি। অতএব এ বদলী আদেশ বাতিল। তিনি এতদিন ধরে চেষ্টা করে বদলী হতে পারছেন না। আর আমি কিনা ক’দিন হলো এসেই আবারো বদলী! উনি কিছুতেই আমাকে রিলিজ করবেন না। এদিকে অফিস ঈদের এক সপ্তাহ ছুটি, কি যে করি ভেবে পাচ্ছি না। একেবারে অফিস শেষ সময়ে আমাকে ডেকে বললেন- আপনাকে ছাড়তে পারি একশর্তে! যদি আমার বদলীর ব্যবস্থা করতে পারেন।
আমার তেমন কোন ক্ষমতা নেই যদিও, কিন্তু ওই মুহুর্তে রাজী না হয়ে পারলাম না।
বললাম স্যার, রাজশাহী যাবার পর আমি আপনার জন্য ঢাকায় গিয়ে চেষ্টা করবো। এ আশ্বাস দিয়ে- আলবিদা জানিয়ে রূপসী নগরী চট্টলার মায়া ত্যাগ করে রাজশাহী উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসলাম।