এটা একটা আত্মজৈবনিক রচনার খন্ডিত গল্পাংশ
পরগাছার দাপট
১৯৪৭ সাল এই উপমহাদেশের জনগনের জন্য এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছরের ১৪ আগষ্ট রক্তাক্ত ইংরেজ শাসনের সুদীর্ঘ দুশো বছরের পরাধীনতার অবসান ঘটে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ইংরেজ জাতি ভারতকে দুই ভাগে বিভক্ত করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা মুসলমান্দের জন্য আলাদা চিহ্নিত করে ‘পাকিস্তান’ নামে পৃথিবীর বুকে এক নতুন রাস্ট্রের জন্ম দিয়ে এদেশ থেকে বিদায় নেয়। সদ্যস্বাধীন রাস্ট্র পাকিস্তান ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। এক দিকে পূর্ব পাকিস্তান অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান। মাঝখানে ব্যবধান প্রায় পনেরশত মাইল। স্বার্থান্বেষী মহল যারা ভারত বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি, তাদের ইঙ্গিতে শুরু হয় সংখ্যালঘু নিধন ও বিতাড়ন। ভারতের পাঞ্জাব, বিহার ও কলকাতা ছিল এই নিধনযজ্ঞের প্রধান কেন্দ্রস্থল। এ সমস্ত এলাকায় বসবাসরত লক্ষ লক্ষ মুসলমান জঘন্য ও বর্বর হত্যার শিকার হয়।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নব্য পাকিস্তানে স্রোতের মত দাঙ্গা পীড়িত আহত অসহায় মানুষের ঢল নামে। যার ধাক্কা পাকিস্তানের মত অনভিজ্ঞ সরকারের পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিল না। ভারতের বিহার রাজ্যের মুসলমানের অবস্থা ছিল সব চাইতে ভয়াবহ ও করুন। বিহার থেকে রাজশাহী এলাকা নিকটবর্তী হবার দরুন রাজশাহী শহরের উপর চাপ পড়ে সব চাইতে বেশি। শহরের স্কুল কলেজ, মাঠ ঘাট, পরিত্যক্ত জায়গাগুলো এই সমস্ত বিতাড়িত মানুষে পুর্ণ হয়ে যায়। এমনকি মানুষের বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত ভরে উঠে উদ্ধাস্তুর ঢলে। ওই সময় এদেশের বাঙালি সমাজ, নিপীড়িত অসহায় এই বিহারী মুসলমানদের রক্ষার জন্য সর্বাত্বক সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে আপন করে নেয়।
এদের জন্য নোঙ্গরখানা, সাহায্য কেন্দ্র ও চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়। স্কুল কলেজ ও ভার্সিটির ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন সভা সমিতি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করে। প্রতিটি স্কুল কলেজে প্রতিমাসে এদের সাহায্যে জন্য আলাদা ফি ধার্য করা হয়। রেল, সিনেমা হলে টিকেটের উপর রিফিউজী কর বসানো হয়। রাজশাহীর বিবি একাডেমী, আলুপট্টিঘাট এলাকার গোডাউন, পাঁচ আনি রাজার পরিত্যক্ত বাড়ী, কাদেরগঞ্জের পাটের গোডাউন (বর্তমানে শাহ নজমুল বালিকা বিদ্যালয়) এবং অন্যান্য স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে থাকার পর শিরোইল রেল ষ্টেশনের পাশে এদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়, যা ‘রিফিউজী কলোনী’ নামে পরিচিত।
জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক এদের নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যাবার অধিকার থাকলেও ভারত সরকার এই বিহারীদের আর ফেরত নেয়নি। এই বিহারী সম্প্রদায় প্রায় প্রতিটি জেলায় উর্দূ মিডিয়াম স্কুল চালু করে। এদেশে দীর্ঘদিন বসবাস করার পরও বিহারীরা এদেশের বাঙালী মুসলমানকে কখনও মনে প্রানে গ্রহণ করতে পারেনি, বরং সুযোগ পেলেই বাঙালিদের উপর চড়াও হয়েছে, দাঙ্গা ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়েছে। এদেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ কলুষিত করেছে।
পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে, টেলিফোন টেলিগ্রাফ, পোষ্টাল ডিপার্টমেন্ট ছিল একচেটিয়া এদের দখলে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তরগুলিতে বাঙালীদের চাকুরীর কোটাগুলি এই বিহারীরা সর্বদাই দখল করে নিয়েছে। উর্দূ ভাষী হবার কারনে পাকিস্তানীদের কালচারে এরা বেশী আগ্রহী ছিল। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট সান্তাহার ছিল এদের ঘাটি ‘মিনি পাকিস্তান’। ওই সমস্ত এলাকায় একটাই ভাষা চলতো আর তা ছিল উর্দূ। ঢাকার মীরপুর, মোহাম্মদপুরেও একই অবস্থা।
বাঙালির সাহায্য সহযোগিতায় লালিত-পালিত হয়েও এরা সামান্য কারনে বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতো না। এরা হরহামেশায় বাঙালি জাতীয়তা নিয়ে বিদ্রুপ উপহাস করতো। অপমানজনক গালিগালাজ করতো। অশ্লীল কথাবার্তা বলতো। সুযোগ পেলেই নিরীহ বাঙালির সঙ্গে দাঙ্গা ফ্যাসাদে লিপ্ত হতো এবং খুন জখম করতো। এরা সংখ্য হয়েও সংখ্যগরিষ্ট বাঙালিকে কোন পরওয়া করতো না। আমি নিজে কয়েকবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি।
সম্ভবত সেটা ১৯৬৪ সাল হবে। আমরা একদল যুবক রাজশাহী থেকে কাঁকনহাট এলাকায় যাচ্ছিলাম এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ট্রেনে ভীষন ভীড়, ঠাঁই নেই কোথাও। আমরা যে রুমটায় উঠেছি দেখি এক বিহারী ভদ্রলোক ‘পা লম্বা করে মেলে একাই পাঁচ জনের সীট দখল করে রেখেছে। কাউকে সেখানে বসতে দিতে নারাজ। আমাদের মধ্যে অনেকে অনুরোধ জানালে-উল্টো তাদের গালাগালি করে বাঙালির গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছেড়েছে। কথাটা কানে এলে আমি ওই ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বিনিত অনুরোধ জানাতেই ক্ষীপ্ত হয়ে আমাকেও গালাগালি সঙ্গে বাঙালির গোষ্ঠি আর বাকি রাখলো না। তার এধরনের আচরণে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে বাঙালি কি জিনিস সেই শিক্ষা দিতে শুরু করলাম। সারা বাঙালীর ক্ষোভ সেদিন ওই চশমা পরিহিত পৌঢ়, শিক্ষিত বিহারীটির উপর দিয়ে উঠিয়ে নিতে চাইছিলাম। প্রচন্ড শিক্ষা দিয়েছিলাম সেদিন ওই কুলাঙ্গারটিকে। শেষে ট্রেনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
ঝোক সামলে উঠার আগেই দেখি বিহারী কলোনী থেকে শ’য়ে শ’য়ে বিহারী অস্ত্রসস্ত্র, লাঠি বল্লম নিয়ে হামলা করতে ছুটে আসছে ট্রেনের দিকে। দূরদর্শী সম্পন্ন গার্ড সাহেব ত্বরিত ট্রেন ছাড়ার হুকুম দিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিশ্চিত এক প্রাণহানীর হাত থেকে রক্ষা করেছিলো সেদিন।
এ ধরনের আরো একটি ঘটনা ঘটেছিলো আমার জীবনে এই রেলষ্টেশনে ১৯৬০ সালে। অবশ্য ওই দিন অনেক ভদ্রভাবেই পরিস্থিতি মীমাংসা হয়েছিলো বলে রক্ষা নইলে বিহারী ই.পি.আর. সুবেদারের গুলিতে আমার প্রাণবায়ু উড়েই যেত। বাংলাদেশে আশ্রিত, বাঙালীর সাহায্য সহযোগিতায় লালিত পালিত এই বিহারী সম্প্রদায় সব সময় বাঙালী জাতির জন্য ছিল হুমকি। একাত্তরের পাক মিলিটারীর চাইতে এরাই ছিল বাঙালীর কাছে সব চাইতে বেশী আতঙ্কের।
একাত্তরের এপ্রিলের সম্ভবত শেষের দিকে, শহর ছাড়া ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলি দু একজন করে ফিরে আসতে শুরু করেছে, পরিবার পরিজন আনার ভরসা তখনও পাচ্ছে না, যদিও সরকার রেডিও টেলিভিশনে অহরহ আশ্বস বাণী দিয়েই চলেছে। নানা গুজব আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, মানুষের আতঙ্ক তখনও দূর হয়নি। এমনি এক সকালে দেখি একজন রক্তাক্ত আহত লোককে রিকসায় দ্রুত হাস্পাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল বিহারীরা ওই ব্যাক্তিটিকে ছোরা মেরে পেটের নাড়ীভুড়ি বের করে দিয়েছে। সান্তাহার থেকে নাকি কিছু আহত বিহারীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নিয়ে এলে স্থানীয় বিহারী সম্প্রদায় উত্তেজিত হয়ে শহরের নানান জায়গায় এ ধরনের তান্ডব শুরু করেছে।
তাড়াতাড়ি দলের কয়েকজন ছেলেকে একত্রিত করে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বাজার হাট অফিস আদালত যেখানে যাকে পাওয়া গেল সংবাদ পৌছান হলো। আমি একটি সাইকেলে চেপে ( তখন ওটাই ছিল আমার মুল বাহন) কাদিরগঞ্জ এলাকার দিকে আরো সংবাদ সংগ্রহ করতে এলে মহিলা কলেজের গেটের কাছে, জনশ্যূন্য রাস্তায় ৮/১০ জন সশস্ত্র বিহারী সবার হাতেই বড় বড় নাঙ্গা তলোয়ার, ওদের মধ্যে একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে পিছনে ফিরে যাবার নির্দেশ দিল। ওই লোকটি ছিল আমার বিশেষ পরিচিত রিকসা চালক ‘আকবর’, যে প্রায়ই আমাকে বহন করতো। ভাগ্য আমার ভালই বলতে হবে, ‘আকবর’ আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলো। ও আক্রমন করলেও আমার করার কিছু ছিল না। সেখান থেকে ফিরে অন্য পথে নিউ মার্কেট পর্যন্ত গেলে ‘খালেক’ নামের এক পানের দোকানদার পরিচিত বিহারী আমাকে দেখেই বললো,
উধার মাত যাইয়ে। ওর কাছ থেকেই জানলাম সকাল থেকেই স্টেডিয়াম পলিটেকনিক এলাকায় নওহাটা রোডে ‘সফি’ বিহারীর নেতৃত্বে চলছে বাঙালি হত্যা। টমটম রিক্সা বা পায়ে হেঁটে ওই পথ দিয়ে যারাই গেছে এবং এসেছে কেউ এই জল্লাদদের হাত থেকে রেহাই পায়নি, জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে জবাই করেছে। মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার আর রক্তের বন্যায় এলাকাটা ভারী হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর মানুষশূন্য। বাজার হাট অফিস আদালত ফাঁকা। কথাটা প্রশাসনের কানে পৌছলে তারা তৎপর হয়ে উঠে। শহর শান্তি কমিটির প্রধান শুকুর জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক আববুর নেতৃত্বে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ওই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হয়। ইতিমধ্যে অসংখ্য নিরাপরাধ নরনারী এই বিহারী জল্লাদ বাহিনীর হত্যা ও লালসার শিকার হয়।
জল্লাদ ‘সফি’ বিহারী নাকি এখনও রাজশাহীতে বহাল তবিয়তে বসবাস করে, বায়া এলাকায় রমরমা তার ব্যবসা। আববু সাহেব সেদিন ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহন না করলে আরো অনেক নিরীহ মানুষ হয়তো ওই দিন জল্লাদ বাহিনীর শিকার হতো। ওই ঘটনার পরও অনেকদিন, ওই এলাকায় কোন মানুষজন যেতে সাহস পেত না। এলাকাটা প্রেতপুরী বলেই মনে হতো। ওই সময় রাজশাহী সাহেব বাজার পুরাতন বাস ষ্ট্যান্ড মানে সাধনা ঔষধালয়ের মোড় থেকে দক্ষিনে আনেস মঞ্জিল, ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত বসতো ‘বিহারী বাজার’ বা ‘সস্তা বাজার’। প্রতিদিন রাস্তার দুপাশে অসংখ্য দোকানে বাঙালিদের লুট করা দ্রব্য সামগ্রী খুব সস্তা দরে বিক্রি হতো। বিহারীরা খুব গর্ব করে বলতো এগুলি গণিমতের মাল। গণিমতের মাল বলতে কোন দেশ যুদ্ধ জয় করার পর সেই পরাজিত দেশের মালামালকে বুঝায়। আমরা তখন তাদের চোখে পরাজিত দেশের মানুষ, আমাদের দ্রব্য সামগ্রীও গণিমতের মাল(!)
গ্রাম পলাতক মানুষগুলি শহরে ফিরে আসতে শুরু করলে তাদের বাড়ীর খোয়া যাওয়া মালগুলি ওই বিহারী বাজার থেকে আবার কিনে নিতে হতো। বাঙালিদের গরুগুলি জবাই করে মাত্র একটাকা সেরে গোস্ত বিক্রি করতো এই বিহারী পট্টিতে। গ্রাম থেকে এই সমস্ত সস্তা মাল কিনতে আসা লোকজনকে এরা প্রায় হয়রান, অত্যাচার করে টাকা পয়সা কেড়ে নিত। কাউকে কাউকে মাল দেখানোর কথা বলে বিহারী কলোনীতে নিয়ে গিয়ে হত্যাও করতো। আমরা সব সময় গোপনে এই সমস্ত মালামাল না কেনার জন্য সবাইকে সাবধান ও সতর্ক করতাম।
একদিন শহরে এক ধণী মিল মালিককে কিছু জিনিস কিনতে দেখে জিজ্ঞেস করায়, ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিলেন।
আর বলেন না আমার মিলের লুট হয়ে যাওয়া জিনিস। কিছুদিন আগেই জাপান থেকে এই ছাকনি কাপড়গুলি আনিয়েছিলাম, প্রতিগজ প্রায় একশত টাকা দরে, কিন্তু এখানে এরা বিক্রি করছে মাত্র পাঁচ টাকা গজে, অন্য কেউ কিনে নিলে অসুবিধা হবে ভেবেই কিনতে ব্যধ্য হলাম। অনেক ভালো বিহারী লোককেও এই বাজারে ‘গণিমতের’ মাল বেচাকেনা করতে দেখা গেছে।
ভদ্রলোক পোষ্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকুরি করতেন নাম ‘মোক্তার হোসেন’ তাকেও দেখতাম এ ব্যবসা করতে। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করতে সেই মানুষটিও বললেন।
এগুলি গণিমতের মাল, বিক্রি করলে পাপ নেই, বরং নেকি আছে। আরো যে সমস্ত বিহারীকে ভালো বলে জানতাম তাদেরও এ ব্যবসায় খুব উৎসাহ দেখেছি।
দেশ স্বাধীনের পর রাতারাতি ভোল পাল্টে ওই মোক্তার হোসেন’ পীর হয়ে গেলেন। খানকা শরীফ বানিয়ে জিকিরে মশগুল সারাক্ষণ। অনেক বাঙালী এই লোকের মুরিদ হয়ে খানকা শরীফ উজ্জ্বল করে ফেললো। এখন মোক্তার হোসেন আর বেঁচে নেই, কিন্তু রাজশাহী শহরে এদের দুটা খানকা শরীফ অনেক সহায় সম্পদ বর্তমান।
শুধু যে বিহারীরাই এই সমস্ত দুস্কর্ম করতো তা নয়। এ সময় কিছু ‘মালদা’ ‘মুর্শিদাবাদের’ লোকজনও এদের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করতো এবং উর্দূতে বাতচিত করতে গর্ববোধ করতো। এরা কত পরিবারকে যে সর্বশান্ত করেছে তার হিসাব কোনদিনই পাওয়া যাবে না। আমি নিজেও এমন এক ব্যক্তির পাল্লায় পড়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার পরিচিত। কাদিরগঞ্জ এলাকায় বিনিময় করা বাড়িতে বসবাস করেন বেশ অবস্থাপন্ন, শিক্ষিত। সামান্য একটু ব্যপারে আমার উপর ক্ষেপে গিয়ে, এবং উর্দূ জবানে শাসিয়ে দিয়ে বললেন- শীঘ্রই তুমি টের পাবে, ‘জোহা’ হলই হবে তোমার শেষ আস্তানা। মুক্তিযোদ্ধার হয়ে কাজ করে এখনও বুক ফুলিয়ে পাকিস্তানে ঘুরে বেড়াচ্ছ! তোকার বাড় কমাচ্ছি। এভাবে আরো অনেক রকমের গালাগালি করে চলে গেল।
সে সময় জোহা হল মানে ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’ বধ্যভূমি। ওখানে গেলে আর কেউ ফিরে আসে না। ওই সময় আমার মত যুবকদের ফাসানো খুব সহজ ব্যাপার শুধু মিলিটারীকে বললেই হলো, এ মুক্তিযোদ্ধাদের লোক। ব্যস! কোন সাক্ষির প্রয়োজন নেই। আর সামাদ সাহেবদের মত লোকেরা এ ধরনের কাজ অবলীলায় করে গেছেন।
ঘটনার সময় যারা ছিলেন তারা বললেন, ভারতে পালিয়ে যান, সামাদ সাহেবের সঙ্গে পাক মিলিটারীর ভাবো জানাশোনা। আপনার বিপদ অনিবার্য।
খুব চিন্তার মধ্যে কন খারাপ করে যেতে দেখে আমার এক নিকট আত্বীয় বিষয়টি জানতে চাইলে ঘটনা তাকে জানালাম।
কাদিরগঞ্জের সামাদ সাহেব খুব ভালো লোক নন বিপদ ঘটিয়ে দিতে পারে। গা ঢাকা দিয়ে থাকো। দেখি আববু সাহেবকে দিয়ে কিছু করা যায় কিনা। বলে দ্রুত চলে গেলেন। আত্বীয়টির আববুর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল।
একদিন পরে শুনতে পেলাম সামাদ সাহেব আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ব্যপার কি! দেখা হতেই আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন,
আরে ভাই আপনি কি রাগ করেছেন? আমি আপনার বয়সে বড়, ওই দিনের ঘটনার জন্য লজ্জিত, ক্ষমা চাচ্ছি।
মনে মনে ভাবলাম, তা হলে ঠিক জায়গায় ওষুধ পড়েছে। বললাম-
ক্ষমা চেয়ে লজ্জা দিচ্ছেন শুধু শুধু, আমি কিছু মনে করিনি। তবে বয়সে ছোট হিসেবে একটা অনুরোধ, দেশের এই দুর্দিনে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করুন। কারো ক্ষতি করার চিন্তা করে বৃদ্ধ বয়সে পাপের বোঝা আর বাড়াবেন না। আল্লার ওয়াস্তে মাথা থেকে এ সমস্ত খারাপ চিন্তা ত্যাগ করুন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক।
আত্বীয়ের কাছে গিয়ে খবরটা দিতেই বললেন, ব্যাটা এখন বুঝুক! তোমার নিরাপত্তার সম্পুর্ণ দায়িত্ব এখন সামাদ সাহেবের।
আববু সাহেব অবাঙালি হলেও অনেক নিরীহ বাঙালীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন, অনেককে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। পাক মিলিটারী বাহিনী তার কথায় পরিচালিত হতো। কারো কোন অন্যায় করেছে বলে শোনা যায়নি। রাজশাহীতে থেকে যাবার অনুরোধ জানান হলেও এই মহৎ প্রাণ মানুষটি নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, কারখানা বাসভবন সহায় সম্পদ সব কিছু ফেলে রেখে পাকিস্তানে চলে যান, দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পুর্বেই।
যাবার সময় কান্না জড়িত কন্ঠে বলেছিলেন-
রাজশাহীতে থাকার ইচ্ছার কোন ঘাটতি নেই,কিন্তু পরবর্তি সময়ে যে জোয়ার আসবে তা থেকে চেষ্টা করেও আমাকে বাঁচাতে পারবেন না। ভদ্রলোকের ঋণ কোন দিনও শোধ করা যাবে না। দিল খোলা এই মানুষটির ভালবাসার কথা রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে এখনও প্রবাদের মত শোনা যায়।