এটা একটা আত্মজৈবনিক রচনার খন্ডিত গল্পাংশ।
গর্জে ওঠার দিন
১৯৭১ সাল বাঙালির যুগসন্ধিক্ষণের বছর। তখনও আমরা পাকিস্তানের এক অংশের নাগরিক অর্থাৎ পুর্ব-পাকিস্তানী। জাতীয় সংসদে বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে দিতে নারাজ। পশ্চিম পাকিস্তানীরা মসনদ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চলছে বৈঠক। আসলে বৈঠকের নামে চলছে ষড়যন্ত্র ও কালক্ষেপণ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে আনা হচ্ছে সেনা,গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র। শেষে যা হবার তাই, আলোচনা ব্যর্থ। সবার মনে ভয়,আতঙ্ক,কখন না জানি কি হয়। পঁচিশে মার্চ বৃহস্পতিবার সারাদিন থমথমে ভাব, নেতারা সব গা ঢাকা দিয়েছেন। এমতাবস্থায় চুপ করে বসে না থেকে প্রধানদের সঙ্গে পরামর্শ করে এলাকায় এক গোপন সমাবেশের আয়োজন করলাম। ঊদ্দেশ্য,পাকসেনাদের আক্রমন মোকাবেলা ও নিজেদের রক্ষা করা। মাঝরাতের শপথ গ্রহনের মধ্যেই খবর এলো ঢাকায় পাক-সেনারা নিরস্ত্র বাঙালির উপর বর্বর আক্রমন শুরু করেছে। তৎক্ষনাৎ সদর হাসপাতালের মোড়ের রাস্তা বড় বড় গাছের গুঁড়ি দিয়ে বন্ধ করার হুকুম দিলাম। পাক-সেনারা যাতে সহজে এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে না পারে।
ভোর হবার আগেই ওরা এখানে উপস্থিত হয়ে আশেপাশে কাউকে না পেয়ে,হাতেমখান বড় মসজিদে ফজরের নামাজে আগত মুসল্লীদের নামাজ না পড়ার নির্দেশ দিবার কিছুক্ষণের মধ্যেই এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে সারা এলাকায় এক ভীতির সঞ্চার করে ব্যারিকেড সরিয়ে,শাসিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে রাতের শপথ গ্রহণকারী অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেল,দলের বাকি সকলকে নিরাপদ স্থানে থাকার নির্দেশ দিয়ে আমিও লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলাম।
বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এর অন্তর্ধান নিয়ে নানা গুজব, কেউ বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে,কখনও শোনা যায় তিনি ভারত চলে গেছেন। তার শুভ কামনায় ঘরে ঘরে নামাজ পড়া হচ্ছে। সারা জাতি তার জন্য উদ্বিগ্ন।
ক্ষণজন্মা এ মানুষটির কথা মনে হতেই সেই ১৯৬৪ সালের কথা মনে পড়ে,তখন আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে ‘কপ’(সম্মিলিত বিরোধী দল) থেকে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান, জেনারেল আজম খান(সাবেক পুর্ব-পাকিস্তানের গভর্ণর এবং পুর্বপাকিস্তানের অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন) এবং আরো অনেক বাঘাবাঘা নেতা রাজশাহীতে নির্বাচনী সভায় এসেছেন। সেই সময় রাজশাহী সার্কিট হাউসে সেই অকুতভয় নির্ভিক যোদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে করমর্দন ও আলাপ করার সুযোগ ঘটে। আমি ও তখন মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচনে ‘কপের’ প্রার্থী ছিলাম।
বাংলাদেশ জুড়ে পাকবাহিনীর বর্বর তান্ডবে দিশেহারা বাঙালি নিরাপদ আশ্রয়ের চিন্তায় ব্যস্ত। ঠিক এমনি মুহুর্তে সাতাশে মার্চ শনিবার সবার মুখে হাসির রেখা- এক বাঙালি সামরিক অফিসার মেজর জিয়ার চট্টগ্রাম বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা,নেতৃত্বহীন, ভগ্নহৃদয় হতাশ, দিশেহারা বাঙালির প্রাণে নব আশা ও উদ্দিপনার জোয়ার বয়ে আনে।
এর কয়েকদিন পরেই ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে রাজশাহী পাকবাহিনীর দখল মুক্ত হয়। রাজশাহী শহরে যত্রতত্র পাক-বিমান বাহিনীর এলোপাথাড়ি আক্রমনে প্রতিদিনই নিহত ও আহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমতবস্থায় প্রথমে রাণীনগর এলাকায় পরে আরো দূরে কাপাসিয়া নামক গ্রামে এক দূর্সম্পর্কীয় আত্বীয়ের বাষায় আশ্রয় নিলাম। চারিদিকে নানান গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত সেদিন এগারোই এপ্রিল। কাটাখালি হাটে দেখা হলো ছেলেবেলার বন্ধু নূরুন নবী চাঁদের সঙ্গে (পরে মন্ত্রী) ও রাজশাহী আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন, জিজ্ঞাসা করলাম-
পরিস্থিতি কেমন মনে হচ্ছে ?
বিষণ্ন মুখে বললো,খুব খারাপ,দু’একদিনের মধ্যেই ওরা রাজশাহী পৌঁছে যাবে বলে মনে হচ্ছে। রাজশাহী থেকে পালিয়ে না গেলে মারা পড়বে।
মনটা একেবারে ভেঙ্গে গেল,পরিবার পরিজন নিয়ে আবার কোথায় যাবো? চিন্তিত মনে ফিরে এসে গ্রামের কয়েকটি ছেলেকে ডেকে আম বাগানের নীচে ট্রেঞ্চ কাটালাম। বিমান ও গোলাগু্লির আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য সবাইকে প্রশিক্ষণ দিলাম। পরদিন বারোই এপ্রিল সকাল থেকেই পুর্ব দিকের আনেক দূর থেকে গোলাগুলির আওয়াজ কানে ভেসে আস্তে লাগলো। ক্রমেই আওয়াজগুলি স্পস্ট হয়ে উঠছে। লোকজন বলাবলি করছে ওগুলো আমাদের বাঙালি সেনাদের গোলাগুলির আওয়াজ। আমার তখন নূরুন নবী চাঁদের কথাই বার বার মনে হতে লাগলো। আমি সকলকে সাবধান করে দিলাম।
দুপুরের দিকে কয়েকটি পাকিস্তানী বিমান চক্কর দিয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটি রকেট মাথার উপর দিয়ে একটু দূরে বিকট আওয়াজে ফেটে পড়লো। তাড়াতাড়ি সবাই ট্রেঞ্চের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। ট্রেঞ্চ থেকে নাটোর রোড একটু দূরে হলেও ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে রাস্তার সবকিছু স্পস্ট দেখা যায়। বেলা আনুমানিক চারটার দিকে দুজন যুবক নিষেধ সত্ত্বেও নাটোর রোডের দিকে চলে গেল পরিস্থিতি জানার জন্য। একটু পরে ছুটে এলে দেখি একজনের হাত উড়ে গেছে অপরজন আগেই পড়ে যাবার জন্য বেঁচে গেছে। ওদের কাছেইজানা গেল, কালো পতাকাবাহী বাঙালি জোয়ানদের জীপ ভেবে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা গুলি ছুঁড়ে, জীপটা পার হয়ে গেলে দৌড়ে পালিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে ওকে বর্ডার পার হবার পরামর্শ দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি পাকিস্তানী সৈন্যরা রাস্তা এবং দুইধার কভার করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। সামনে যা কিছু পড়ছে খতম করে দিয়ে যাচ্ছে। একটু পিছে গাড়ীর বহর যাকে কনভয় বলে, আস্ত্রশস্ত্র গোলাবারূদ ভর্তি। এধরনের গাড়ি একশত একচল্লিশটা গোনার পর ক্ষান্ত দিলাম। এতদিন সিনেমায় সামরিক আভিযানের দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে চাক্ষুস এ ভয়ংকর সামরিক অভিযান দর্শন আমার জীবনে এক বিরল ঘটনা।
পরদিন ভোরে খবর পেলাম মাসকাটাদীঘি এলাকায় বসবাসরত আমার এক আত্বীয়া পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন তার লাশ দাফন করা যায়নি। সারা এলাকায় কারফিউ- দেখা মাত্র গুলি। অনেক ঘোর পথে টহলদার সেনাদের চক্ষু এড়িয়ে এলাকায় পৌছে দেখলাম কোন রকম মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। দোয়া দরূদ ফাতেহা পাঠ করে দেখি আশেপাশে কেঊ নেই। পানির পিপাসা পেয়েছে একটু পানি খাওয়া খুবই দরকার কিন্তু ডাখাক দিয়েও কাঊকে পাচ্ছিনা। যে দু’একজনকে পেয়েছিলাম তারা কি মিলিয়ে গেল নাকি? এতবড় গ্রাম যেখানে হাজার মানুষের বাস, একেবারে শূন্য। অনাহার ক্লিস্ট কয়েকটি বিড়াল-কুকুর ছাড়া কোন প্রাণের সাড়া নেই। তাহলে যে দু’একজনকে দেখেছিলাম তারা কি মানুষ না জ্বীন!
বেহুদার মতো আমার হাঁকডাকে এক সর্প বাবাজী বোধহয় বিরক্ত অথবা কারফিঊ ভঙ্গ করেছি সে অপরাধের দায়ে হয়তো বা ফনা উচিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে দেখে তেস্টা ফেলে দিলাম এক ছুট। কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে দেখি, সাপটা আমার এ অবস্থা দেখে বোধহয় থেমে গেছে। গায়ের ময়লা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে, সামনের বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে মানুষের বার্তার আওয়াজ কানে এলো, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গিয়ে দেখি দুটি বড় বড় কলাপাতায় কি যেন ঢাকা রয়েছে। উঠিয়ে দেখি দুটি গুলি খাওয়া লাশ পাশাপাশি শুয়ে আছে। তবে ওরাই কি আমার অবস্থা দেখে নিজেদের মধ্যে এতক্ষণ রসালাপ করছিল! কোথাও কোন জন মানুষের সাড়া না পেয়ে তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করলাম এবং অস্থায়ী ডেরায় ফিরে এলাম।
চৌদ্দই এপ্রিল কারফিঊ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে রেডিওতে প্রচার করা হলো। খবর পেলাম তালাইমারী, রাণীনগর এলাকা একেবারে ম্যাসাকার! শহরের অবস্থাও খুব খারাপ, ক’দিন ধরেই দেখছি আগুন আর ধোঁয়ার কুন্ডলী। মনটা খুব বিচলিত হয়ে উঠলো। রাণীনগরে অনেক আত্বীয়-স্বজনকে ছেড়ে এসেছিলাম। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে আল্লাই মালুম। সেখানে যাবার প্রস্তুতি নিলাম। সবার বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে একটা সাইকেলে চেপে রওয়ানা দিলাম। কাটাখালি হাটে এলে সেখানেও অনেক পরিচিতজন শহরের দিকে কোন ক্রমেই না যাবার জন্য অনুরোধ ও সতর্ক করেও আমাকে নিরস্ত করতে পারলো না। দেখি এক মওলানা ধরনের মানুষ সাইকেলে একটি পাকিস্তানী পতাকা গেঁথে শহরের দিকে চলেছেন।
মওলানা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার পতাকা কোথায়?
বললাম-আমার কাছে তো কোন পতাকা নেই আপনারটাতেই কাজ সারবো। আমি আপনার পিছু পিছু থাকবো। সবার নিষেধ উপেক্ষা করে আমরা দুই অভাগা বিপদ জেনেও শহরের দিকে রওয়ানা দিলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরি পার হয়ে বিনোদপুর বাজারের কাছে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই দেখি রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য পাক সেনা গিজগিজ করছে। মওলানা সাহেব তাদের সালাম জানাচ্ছেন। আমিও তাকে অনুসরন করছি। কোন কোন সেনা তাকিয়ে মুঁচকি হাসছে। ভাবখানা ঠেলার নাম বাবাজী। একজন হাবিলদার গোছের বয়স্ক সেনা থামার নির্দেশ দিলে দুজনেই সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম,আর মনে মনে দোয়া দরূদ পড়তে লাগলাম। নিকটে এসে মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো-
তোমার গাড়ীমে ফ্লাগ কিঊ(তোমার সাইকেলে পতাকা কেন?)
মওলানা সাহেব ডান হাত ঊপরে উঠিয়ে বললেন,- পাকিস্তান জিন্দাবাদ। সঙ্গে সঙ্গে মওলানার গালে পড়লো আড়াই মন ওজনের এক থাপ্পড়। মওলানা সাহেব মা-গো বলে ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি শুরু করলো। আমি তখন বলির পাঁঠার মতো কাঁপছি।
সৈনিকটি রাগে গরগর করতে করতে বললো- শালা মিনিস্টার বান গিয়া (শালা মন্ত্রি হয়ে গেছো)।
মনে হয় আমার সাইকেলে পতাকা না থাকায় এযাত্রা রক্ষা পেলাম। তাড়াতাড়ি সাইকেলে চেপে এলাকা ত্যাগ করলাম। একটু দূরে এসে পিছনে তাকিয়েও মওলানা সাহেবের পাত্তা পেলাম না। ফাঁকা রাস্তা এখন আমি শুধু একা। কাজলা গেটের কাছে দেখি দুটো মানুষের লাশ করোগেট টিন দিয়ে ঢাকা। ফুলে গন্ধ ছড়াচ্ছে। তালাইমারি মোড়ের কাছে দেখি কুকুরে মানুষের শরীরের বিচ্ছিন্ন অংশ মুখে নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। চারিদিক দুর্গন্ধে ভর্তি। রাস্তায় জনমানবের দেখা নেই। শূন্য খাঁ খাঁ, ভৌতিক পরিবেশ। জেবের মিয়ার কাঠের মিলের কাছে এলে দেখি এখানেও বহু সৈন্য, পুলে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছে। অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে ধুরে বেড়াচ্ছে! এধরনের পরিবেশে একজন পাজাম পাঞ্জাবী মাথায় কিস্তি টুপি ধারী বেমানান ব্যক্তিকে দেখে হাত তুলে নামতে ইশারা করলো। নেমে তার পাওনা সালাম দিলাম, কোন উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
কাঁহা সে আতা হ্যায় (কোথা থেকে আসছো)
বললাম, গ্রাম সে আতা হ্যায় (গ্রাম থেকে আসছি)
ওদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে বললো- এ শালা আওয়ামী লীগকা আদমী হ্যায়, বিহারী লোককো মারকে দিহাতমে ভাগ গিয়্যাথা। (এ শালা আওয়ামী লীগের লোক বিহারী হত্যা করে গ্রামে পালিয়ে ছিল)।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দূতে মিথ্যে করে বললাম-
হামতো গরমেন্টকা আদমী। আভি দপ্তরমে যাতা হ্যায়।(আমি সরকারি কর্মচারী,অফিস যাচ্ছি)
বললো, হা, হা, শালে আভি তো গরমেন্ট আদমী বানেগা (হ্যাঁ, এখন তো সরকারী লোক হবে)।
ভিতর থেকে ( মানে মিলের ভিতরে পায়চারীরত) এক সেনা হাতে এক বিরাট ছোরা, তখনও ওটাই শুকনো রক্তের দাগ লেগে রয়েছে, চেঁচিয়ে বলছে শালাকে ইধার ভেজ দো হালাল করদেগা ( শালাকে এদিকে পাঠিয়ে দাও হালাল করে দিই )।
বুঝলাম আর রক্ষা নেই। মনে মনে সমানে দোয়া কালমা পড়ে চলেছি, আর চিন্তা করছি সবার নিষেধ অমান্য করার এই প্রতিফল। এখন এদের হাতে লাশ হওয়া ছাড়া আর কোন পথই নেই। ঠিক এমনি সময় এক মোটরের আওয়াজ কানে এলো,ওরাও কান খাড়া করে রাস্তার দিকে উঁকি দিয়ে আমাকে বললো-
চলো ভাগ যাও (যাও চলে যাও) আমি একটু বিলম্ব করছি, গাড়িটা নিকটবর্তি হলে দেখলাম,জেবর মিয়ার একটি নতুন বাস, সামনে একজন অফিসার বসে রয়েছে। তাকে স্রদ্ধাভরে সালাম জানালাম,আএ মনে মনে বললাম, তুমি আমার প্রান রক্ষাকারী ফেরেস্তা। আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছেন, নইলে এতক্ষন হয়তো লাশ হয়েই যেতাম।
আবারও সাইকেলে চেপে রওয়ানা দিয়ে কিছুদুর যেতেই দেখি (হাদীর মোড়ের কাছে) কে একজন জানালার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে ইশারা করছে,কিন্তু ঐ বাড়ির সদর দরজায় বড় বড় দুটি তালা ঝুলানো, কাছে যেতেই বললো-
আপনার সাহসতো কম নয়? মরতে বের হয়েছেন! পুলের ঐ পারে আপনার মতো ভদ্রলোকের অনেক লাশ পড়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি পাশের গলির মধ্যে ঢুকে পড়ুন।
ওখানে দেখি কুকুরে লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। তাড়াতাড়ি গলিপথে ঢুকে রাণীনগরে প্রথমে যেখানে উঠেছিলাম, সেখানে গিয়ে শুনলাম, সবাই যে যার মতো চলে গেছে। আর আমাদের রেখে যাওয়া দ্রব্যসামগ্রী ঘরের তালা ভেঙ্গে কে বা কারা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। কেঊ বলে মিলিটারী, কেঊ বলে এলাকার লোকজন। অনেক দ্রব্যসামগ্রী খোয়া যাওয়ায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
ওখান থেকে বের হয়ে সোজা নিজ বাড়ির দিকে সাইকেল চালালাম। সাহেব বাজার স্টার স্টুডিওর সামনে এলে দেখলাম (তখন রাস্তা বড় হয়নি) রাস্তার পাশে ফুলপ্যান্ট সার্ট পরা একটা মানুষের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। শহরে অনেক জায়গায় তখনও আগুন জ্বলছে। পুরা শহরটাই তখন বিহারীদের দখলে। বড় বড় দোকানপাট, বাড়ি-ঘর লুটপাট চলছে সমানে,কেউ বাধা দেবার নেই। পছন্দমত বাড়ি ও দোকান দখল করে নিজেদের নাম লিখে রাখার প্রতিযোগীতা চলছে। একেবারে রামরাজত্ব! ওদের হাতে নানান ধরনের মারাত্বক সব আস্ত্রশস্ত্র। এতো কস্ট করে এতক্ষণ প্রাণটাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসে এই তস্কর-লুটেরাদের হাতে জীবন বলী দিতে ইচ্ছে হলো না। তাই ওদের এড়িয়ে ভিন্ন পথে সোজা সদর হাসপাতালের মোড়ে এসে উপস্থিত হলাম,যেখানে পঁচিশের রাতে ব্যারিকেড দিয়েছিলাম। গাছের পাতায় রাস্তাটা একেবারে ঢেকে গেছে,মনে হচ্ছে কতকাল এ রাস্তায় মানুষ চলাচল করেনি। একটি প্রাণীরও সাড়া নেই। চার রাস্তার যেদিকে তাকাই শূন্য খাঁ-খাঁ গাটা কেমন যেন ছমছম করে উঠলো। কয়েকদিন আগে এখানেই গুলি করে হত্যা করেছিল বিশুকে। এ মুহুর্তে যদি কোন মিলিটারীর গাড়ী এসে পড়ে তবে আর রক্ষা নেই।
দ্রুত বাড়ির পথ ধরলাম,আমাকে দেখে সবাই কেমন যেন ভূত দেখার মতো আশ্চর্য হয়ে গেল। এ অবস্থায় গ্রাম থেকে শহরে জীবন নিয়ে যে কোন মানুষ আস্তে পারে কল্পনাতে আসে না। মিলিটারি দফায় দফায় আটকানোর ঘটনা শুনে সবাই স্তম্ভিত। রিস্ক নিয়ে ঐদিন আর ফিরে না যাবার জন্য পীড়াপীড়ি সত্বেও আমার পরিবারের সবাইকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে অনেক কস্টে কাপাসিয়ায় ফিরে গেলাম।