বেশ কিছুদিন ধরে গোটা এ্যাপার্টমেন্টটি জুড়ে গম্ভীর নিস্তব্ধতা ৷ ছেলে-মেয়ের নিরব খেলাধুলা আর কোনও কথা নেই বাবা-মার মাঝে ৷ নিরাবতাখানি যেন তীক্ষ্ণ ও বিকট ভারী ৷ ছেলে ও মেয়েটি যখন মা-বাবার মাঝে কোন প্রশ্ন ফেলে দেয় ততক্ষণাৎ হয়ত দু’জনেই উত্তর দিয়ে ফেলে ৷ সেই সঙ্গে নৈঃশব্দ্যের প্রতিধ্বনির আচ্ছন্নে আবৃত করে ফেলে পরিবেশ ৷
একবার একদিন মা কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসেন ৷ তখন ভাইটি ছিল না সেখানটায়, যদিও বাবা কাজ করছিলেন ৷ মেয়েটি একা একা নিজের সাথে কথা বলার খেলায় মত্ত ছিল ৷ সেটি ছিল প্রশ্ন ও ভিন্ন স্বরে উত্তরের ক্রিয়াশৈলী ৷
যখন সিলভা ও ক্যাটরিনা তাকে ‘আমেরিকা’ সম্পর্কে ধারণা দিল ৷ ঢালগুলো কেমন পিচ্ছিল যেন তাতে যে কেউ পড়ে গিয়ে মাঝ বরাবর প্রচণ্ড আঘাত পেতে পারে ৷ তা শুনে আলেঙ্কা তাদেরকে ভিন্নরকম কিছু বলতে বললো ৷
মা বললো- ‘আলেঙ্কা রান্নাঘরে আসো ৷’
খেলনাগুলোর কাছে মিনতি জানিয়ে অন্যস্বরে বলে গেল, সে দ্রুতই ফিরে আসবে ৷
এদিকে মা বলতেই লাগলো ‘আলেঙ্কা, তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল’ ৷
মায়ের ক্রুদ্ধ অবয়ব দেখে সে আরো ভীতসন্তুস্ত হয়ে উঠলো ৷ খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিভ্রান্ত চেহারা নিয়ে উৎকন্ঠায় রইল ৷
‘তুমি কি জানো বাবা একখানা জন্মদিনের উপহার নিয়ে এসেছেন ৷’
যদিও আলেঙ্কা এগারতম বর্ষে পদার্পন করবে শীঘ্রই ৷ কৈশরে উত্তীর্ণের চূড়ান্ত বছর এটা ৷ ফলে সে আর থাকবেই না ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে হিসেবে ৷
‘বাবা তোমার জন্য একখানা সাইকেল নিয়ে এসেছে ৷ সেই রকম একটি রগ-পনি-ফল্ডিং সাইকেল ৷’
শোনে আলেঙ্কা কিছুই বললো না ৷ তবে কিছু একটা তার হৃদয়ে চেপে বসছিল তাতে ক্রমশঃ রাগ বাড়তে লাগলো ৷ অবশ্য দীর্ঘদিন যাবত একখানা পনি চেয়ে আসছিলো সে ৷ যাতে চড়ে সিলভা আর ক্যাটেরিনাকে নিয়ে পাশের রাস্তার ছোট্ট ‘অ্যামেরিকা’তে যেতে পারে ৷ সাইকেল বিহীন অবস্থায় যা ছিল তার কাছে বেশ দূরবর্তী ৷ তাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শুনতো ঢালগুলো কতটা পিচ্ছিল যাতে পড়ে যে কেউ ভাঙ্গতে পারে মাঝ বরাবর আঘাত পেতেই পারে যখন তখন ৷ তার অবশ্য ইচ্ছে হতো আরও অন্য কিছু শুনতে ৷
সেই ভুল মুখশ্রীর ঐ দৃষ্টি নিয়ে মা বলতে লাগলো, ‘তুমি কি জান আলেঙ্কা ? খুব খুশি খুশি ভাবে থাকো কারণ বাবা আসলেই বেশ ক্লান্ত ৷ সে সাইকেলের জন্য ধার নিতে বাধ্য হয়েছে ৷’
‘ঠিক আছে মা’ বলে জানালার ধারের তার খেলনাগুলোর কাছে চলে আসল ৷ আর তাদের বলতে লাগল ‘অবাক হবার মতন করে আমি একখানা সাইকেল পেয়ে গেছি ‘৷ তা শোনে তারা উপরে নিচে লাফালাফি শুরু করে দিল ৷
তারপর যথা সময়ে সমাগত তার জন্মদিন ৷ পেট ব্যাথা নিয়েই সে স্কুলে চলে গেল ৷ এরপর ক্লাশের মাঝ সময়ে সে অবাক হয়ে খেয়াল করল সব সাইকেলের রঙই নীল অথবা লাল ৷ সব পনি-ই নীল বা লাল রঙের শুধু সিলভা’টির রঙ গোলাপি যা তার বাবা করে দিয়েছে ৷
মধ্যাহ্নভোজের পর বাবা আসলেন ৷ কেমন অদ্ভূত অনুভূতি হতে লাগলো আলেঙ্কার সঙ্গে সে বোধের মতই তার চেহারাও বদলে যেতে লাগল, যা আদতে তার স্বাভাবিক চেহারার সাদৃশ্য ছিল না ৷ বাবা বেসমেন্টে নেমে আসতে বললো তাকে ৷ পরে নেমে আলেঙ্কা হালকা নীল রঙের সাইকেলটির কাছে চলে আসল ৷
সেদিকে তাকিয়ে রইল আলেঙ্কা, পরে এক ফাঁকে দেখে নিল বাবাকেও ৷ সে জানতো তার এখন খুশি হওয়া উচিত কিন্তু পেটের ব্যাথা আরো বাড়তে লাগল ৷ যখন সাইকেলটি স্পর্শ করল তখনই যেন শীতল ধাতবখানা ধীরে ধীরে তাকে মৃদু আঘাত দিতে লাগল ৷
ধন্যবাদ বলেই সে যেতে চাচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি উপরে উঠে তাদেরকে বলবে তার চমক প্রাপ্তির কথা ৷
‘তুমি কি খানিকটা চড়ে বেড়াবে না ?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বাবা ৷ অল্প সময় ধরে কিংকর্তব্যমিমূঢ় আলেঙ্কা ৷ অতঃপর স্বগতোক্তি দিল ‘ঠিক আছে খানিকক্ষণ পর ৷’
বেসমেন্টটুকু ছিল খুব সরু আর মৃদু আলোয় ভরপুর ৷ বিশাল আকৃতির বাবা আর ক্ষুদ্রাকৃতি আলেঙ্কা ৷ মাথায় শুধু একটা শব্দই ভেসে আসল “ধার”৷ কিন্তু একটুও নড়তে পারছিল না সে ৷ বাবার পেছনে তার নতুন পনি-র পাশে দাঁড়িয়ে রইল সে ৷ অপেক্ষা করতে লাগল বাবার প্রস্থানের, যাতে সিলভা আর ক্যাটরিনা চলে আসতে পারে ৷ তাদেরকে নিয়ে তার ইচ্ছা ‘অ্যামেরিকা’র উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে পারে অবশেষে ৷
**
স্লোভান থেকে ইংরেজি ভাষান্তর ক্রিস্টিনা জরাভিক রিয়েরডন ৷
==================================
[লেখিকা পরিচিতিঃ লিলি পোতপারা (জন্ম ১৯৬৫ সালে মারিবোর, স্লোভেনিয়ায় ) লেখক ও ফ্রিল্যান্স অনুবাদক যিনি বর্তমানে স্লোভেনিয়ায় Ljubljana শহরে কর্মরত আছেন ৷ বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে ৷ এর মধ্যে গল্প সংকলন Zgodbe na dusek (Bottoms Up Stories, LUD Literatura, 2002) and Prosim, preberi (Please, Read Me, LUD Literatura, 2006) অন্যতম ৷ যার মধ্যে Zgodbe na dusek জিতে নেয় ২০০২ সালের স্লোভেনিয়ান বইমেলার নতুন লেখকের সাহিত্য সম্মান পরে ২০০৬ সালে পুনর্মুদ্রণ হয় এর ৷ বহু ইংরেজী উপন্যাসের সফল অনুবাদক হিসেবে এদের মধ্যে অন্যতম করমাক ম্যাকার্থির The Road যার জন্য ২০০৮ সালে Slovenian Literary Translators' Association-এর সম্মাননা লাভ করেন ৷
দুই সন্তানের জননী লিলি ফ্রেন্চ আর ইংরেজি ভাষা এবং সাহিত্যের উপর ব্যাচলর ডিগ্রি লাভ করেন Ljubljana বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ থেকে ৷ এছাড়াও স্কুল ও কলেজেই পারফর্মিং আর্টস্ (সংগীত)এর উপর দুটো ডিপ্লোমা লাভ করেন ৷ এদিকে সার্বিয়ান, সুইডিশ, ইংরেজি ও গায়েলিক ভাষায় তার ছোটগল্পের অনুবাদ হয়েছে ৷]
*উপরের ছবিতে গল্প সংকলন Zgodbe na dusek (Bottoms Up Stories, LUD Literatura, 2002)এর প্রচ্ছদ, যেখান থেকে The Surprise বা চমক গল্পটি সংগৃহীত ও পাশে লেখিকা ৷
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০