আমার গলায় বেশ ব্যথা লাগছিল ৷ কথা বলতেই পারছিলাম না ৷ সত্যি বলতে কি আমার বলার মত কিছুই ছিল না ৷ অনেক চিন্তা করলাম কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে আমার নিজস্ব কোন মতামত ছিল না ৷ অনুমানও করতে পারলাম না আমার কী হলো আর জানলামও না পরিচিতজনদের কী হলো ৷ আমি শুধু একটা ব্যাপারই বুঝলাম আমি বেশি আবেগী ৷ না বললেই নয়, আমি বেশ কাঁদি ৷ এটাই খুব স্বাভাবিক ৷ আরো বেশিও কাঁদতে পারি ৷ যখন কোন কষ্টের কাহিনী শুনি তখন নিজে থেকেই কান্নার জল গড়িয়ে পড়ে ৷ সারা দিন আর রাতজুড়ে কাঁদি আমি ৷ যখন কাঁদি তখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি ৷ বেশ হালকা ৷
ভালবাসার গল্পগুলো শুনতে আমার বেশ ভাল লাগে ৷ আবেগী গল্প ৷ যখন দু’জন একে অপরকে ভালবাসে আর তখনই ভিতর থেকেই পরস্পরকে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় ৷ কিন্তু আমার ভাল লাগে দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা সারাজীবন ধরে আলাদা থাকা আর তাদের মৃত্যুও হয় পৃথকভাবে ৷ যদিও একে অপরকে কখনই ভুলেনা ৷ তাদের থাকে আলাদা স্বামী বা স্ত্রী কিন্তু ভুলে যায় না জীবনের সেরা ভালবাসার কথা ৷ যেমন কোন লোক হয়ত তার জীবনসঙ্গীর হাতের উপর মরে (যে হয়ত তাকে ভালবাসে ) তখন সেই প্রেমিকা বোধহয় জানালার ওপাশে দাড়িয়ে থাকে ৷ নয়ত গোরস্থানের পাশে ৷ সবার সাথে নয় তবু পাশেই থাকে তাকে শেষবারের মত দেখার জন্য ৷ দেখেছো, আমি এখন কাঁদছি যদিও এটি স্বাভাবিক ৷ আমাকে থামিও না ৷
আমারটা থেকেও অন্যের ভালবাসার গল্পগুলো আমায় বেশ আবেগময় করে তুলে কারণ হয়ত আমি কাউকে গভীর ভাবে ভালবাসিনি ৷ সম্ভবতঃ এখনও আমি বেশ দ্বিধান্বিত ৷ তা জানি না কেন ৷ কিন্তু আমার গল্পটা হৃদয়ে দাগ কাটে না ৷ সেটা বুঝে আসে না আমার ৷ সেটি আবার নির্ভর করে কিভাবে বলা হলো ৷ কারণ হয়ত আপনি গল্পটি একভাবে বললেন তা সবাইকে কাঁদালো ৷ আবার সেটি অন্যভাবে বললে সবাই তা নিয়ে হাসতে থাকবে, আসলে গল্প কিন্তু একটাই ৷
আমার দাদিমা সবসময় আমায় এমন ভাবে আমাকে গল্প শোনাত যেন যাতে আমার কান্না পেত ৷ সেও কাঁদতো, আসলে আমরা দু’জনই কাঁদতাম ৷ আর তখনই আমি প্রথম বুঝেছিলাম যে, গল্প শোনে কান্নায় কতটা মধুর ৷
আমার দাদিমা ছিল সপ্রতিভা গল্প বলায় ৷ মাঝে মাঝে তার শরীরের চামড়ায় কি যেন অসহ্য বেদনা হতো ৷ ফলে একবার বলেই ফেলল তার পেছনের ইতিহাস ৷ সবটুকুই তার বেশ মনে ছিল ৷ অবশ্য আমিও সব জানতে কান্নাকাটি করেছিলাম ৷ তারপর দাদিমা আমায় বললঃ
‘বার্চ গাছের তক্তা চেনো ?’
‘না চিনি না ৷ কি সেটা ?’
‘তুমিও চিনবে যখন তোমাকে কেউ বার্চ গাছের বাকল দিয়ে মারবে ৷ তারা আমায় মেরেছিল একবার আর এর বেদনার স্মৃতি বহন করে চলেছি সারা জীবনভর ৷’
‘আচ্ছা এর স্বাদ কি রকম ?’
‘লবণের মত ৷ সাথে খানিকটা তিতার স্বাদও আছে ৷ যখন তক্তার আঘাত পড়বে তখন একটু তিতার স্বাদই লাগবে তখন ৷’
দাদিমাকে তার সৎমায়ের ছোট বাচ্চাকে দেখাশোনা করতে হতো ৷ একবার সেই বাচ্চাটি শেলফের উপর থেকে মেঝেতে পড়ে গেল ৷ আর সৎমায়ের মারের ভয়ে দাদিমা পাশের বনে চলে গেল ৷ তার সৎমা সবসময়ই চাবুকের আঘাতে কষ্ট দিতো তাকে ৷ বাচ্চাটিকে মেঝেতে রেখেই পালিয়ে আসল দাদিমা ৷ উনি ভেবেছিলেন বাচ্চাটি মারা গেছে কিন্তু কিছুই হয়নি তার ৷ মৃত্যুমুখবর্তী ঘোরগ্রস্থ কোন শিশুকে কোলে তুলে নেওয়া আসলে বেশ কষ্টসাধ্য ৷ জীবনের সামনে এগিয়ে যেতে তা বেশ অবহনযোগ্য ভারও ছিল ৷ বিড়ালের মতো চুঁপটি করে বসে থাকলো সন্ধ্যা পর্যন্ত বাপের বাড়ির কাছের বনে ৷ পেছন থেকে বোঝার চেষ্টা করল বাড়িতে কী ঘটছে ৷ তার সৎমা কিন্তু জানতো সে কোথায় লুকিয়ে আছে ৷ গোঁধুলি ঘনিয়ে আসলে সে আঙিনায় বেড়িয়ে এসে নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলো ৷
‘বাড়িতে এসো আমি তোমাকে মারবো না ৷ বড্ডো দেরি হয়ে গেছে, তুমি সারাদিন কিছুই খাওনি ৷ বাছা, ফিরে এসো বাড়িতে ৷ তোমাকে আজ শবজির কিছু মজাদার খাবার দিবো ৷ এসো - ভয় পেওনা ৷’
দাদিমা তাকে বিশ্বাস করল ৷ সত্যিকারের ক্ষুধার্ত ছিল বলেই পিছনের জঙ্গল থেকে সৎমায়ের কাছে ফিরে আসল ৷ সেই বাচ্চাকাল থেকেই দাদিমার পেটে খিদে থাকত ৷ এমনকি তার শেষ সময়ও সে ক্ষুধার্তই ছিল ৷ হেঁটে সৎমায়ের কাছে এসে বললঃ
‘শবজি কোথায় ?’
‘ভিতরে যাও ৷ বাড়িতে আছে ৷’
ভিতরে গেল দাদিমা ৷ এরি মধ্যে তার সৎমা গাছের বাকলের তক্তা নিয়ে প্রস্তুত ৷ দাদিমাকে ঝাপটে ধরলো ৷ সাথে সাথে তার পায়ে, পিঠে, মুখে আঘাত আসতেই লাগলো ৷ চিৎকার করতে লাগল দিদা ৷
‘নচ্ছার মাগি তুই ৷ আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি ? তাইতো শেলফ থেকে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলি ৷’
এমন করে মারতেই থাকলো যতক্ষণ না কাজ থেকে দাদিমার বাবা ফিরে আসলো ৷ তাকে টেনে কেড়ে নিল সৎমায়ের কাছ থেকে ৷ যদিও আমার দাদিমা নড়াচড়া, এমনকি কথাও বলতে পারছিলো না ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো সারা শরীর ৷ এরপরই তার বাবা সৎমাকে পেটাতে লাগলেন ৷ না, ঐ গাছের তক্তার জায়গায় হাতের ঘুঁসিতেই শুরু করলেন ৷
সৎমা প্রচণ্ড ঘৃণা করতো দাদিমাকে ৷ প্রায়ই তাকে খেতে দিতো সাবানের আজলা, একবার তো ইঁদুরের বিষও দিলো ৷ আমি একটুও মিথ্যা বলছি না, সব সত্যি ৷ নির্জলা সত্যি কথা ৷ যদিও তুমি হয়ত বিশ্বাসই করবে না আসলে এমনটা হয়ে ছিল কিনা ৷
বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল ছয় বছর বয়সে ৷ পরে তাকে বোর্ডিং স্কুলে যেতে বাধ্য করা হলো ৷
সাত বছর বয়সে বোর্ডিং স্কুল থেকে পালালো কারণ সে আতঙ্কে ছিল মৃত্যুর ৷ সেখানে সে শিখেছিল, নতুন তরকারি রান্না করা শুধু পানিতে দুটো শিমের বিঁচি ৷
বয়স আটে দাদিমা থাকতে লাগল নভোহরাড-ভলিনস্ক ( ইউক্রেনের একটি স্থান) বাজারে আর খেতে লাগল ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট আলুবোখারা ৷
তারপর কাজ পেল খামারের গরু চরানোর ৷ এরপর এক লোকের খামারে কাজ করত যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিল এক বছরের কাজের বিনিময়ে শীতে গরম কাপড়ের দেওয়ার ৷ দুই বছরের অতিরিক্ত কাজের মূল্য হিসেবে সে পেল একটা বাঁছুর ৷ মালিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এক তাতারের সহযাত্রী হয়ে বাঁছুর নিয়ে জিইতমির শহরে (ইউক্রেনে অবস্থিত) গেলেন ৷ সপ্তাহান্তে বাঁছুরটি মারা গেলে সেটার চামড়া ছিলে ও মাংস বেচে দুটো তারপোলিন কাপড়ের জুতো পেল ৷ যদিও সে দুটোই বা-পায়ের ৷
তোমাকে বললাম কত সুন্দরভাবে যদিও দশ বছর লেগেছিল দাদিমার আমাকে সবটা বলতে ৷ দশ বছর ধরে সব সূক্ষ্ম ও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছিল গল্পগুলো ৷ অন্তর দিয়ে তার জীবনটা আমি জানি ৷ সে জন্য হয়ত আমার নিজের দিকে নজরও দিতে পারি নাই ৷ সে সময়ে মনে হতো আমার জন্য নয়, দাদিমার জন্যই বেঁচে থাকা ৷ তাই তো তার দরকার ছিল কোন একজনকে সব বলার, যাতে সে সবাইকে সব কাহিনী বলতে পারবে ৷ আমার চোখে প্রায় নিখুঁত ছিল সে ৷ সে আমাকে বঞ্চিত করেছিল নিজের কাহিনীতে বেঁচে থাকতে ৷ সে কোন সুযোগই দেয় নাই আমাকে কোন ‘একজন’ হয়ে উঠতে ৷ এমনকি একজন স্বাধীন সত্ত্বাধিকারী হিসেবেও নয় ৷
আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিক ছিল দাদিমা কাউকেই ভালবাসেননি ৷ সম্ভবত সারা জীবনভর ক্ষুধার্ত ছিল সে ৷ কিন্তু আদতে কাউকে পছন্দ ছিল না তার ৷ কোন পুরুষ মানুষকে, তার সন্তানদেরকে সর্বোপরি আমাকেও নয় ৷ কাউকেই নয় এমনকি নিজেকেও নয় ৷ যদিও আমি সবসময় ভদ্রভাবে তার শ্রোতা ছিলাম ৷ এখন তার অতিতের দিকে তাকালে আমার মনে হয়, ছোটবেলার দিনগুলো থেকেই ক্ষুধার দানো তার মাঝে বসত গেঁড়েছিল ৷ আমি জানি না এমন কিছু কি আছে নাকি ? কিন্তু সেটাও আমার ধারণা ৷
যখন হঠাৎ করে, যদি বাড়িতে কিছুই না থাকে খাবার মতন দাদিমা রাগান্বিত হয়ে উঠতেন ৷ মাঝে মাঝে আমাকেও মারতেন ৷ তখন তার চোখগুলো ফুঁসে উঠতো, কুৎসিত আর আগুনের ফুঁলকির মত লাগতো ৷ মনে হতো রুটির দলার জায়গায় কারো গলা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন ৷ সে খুঁতখুঁত করে টেবিলে ছড়ানো রুটির টুকরাগুলো জড়ো করতে লাগতেন ৷ পরে বাধ্য করলেন আমাকে সেগুলো খেতে ৷ প্রচুর পরিমাণে রান্না করতেন তিনি, যার পুরোটাই ছিল চর্বিযুক্ত ৷ পরিমাণে এতই চর্বি ছিল যে, আমি তার জন্য তরকারিই দেখতেই পেতাম না ৷ লার্ড (শূকরের চর্বি) ছিল তার পছন্দের খাবার ৷ শেলফে আধা লিটার বৌয়মে লার্ডগুলো জমিয়ে রাখতো ৷ অগণিত বৌয়ম ছিল শেলফের তাকে তাকে ৷ আরও ছিল অসংখ্য শিমের বিঁচি ভর্তি বৌয়ম ৷ সেই সু-প্রাচীন শেলফের তাকে ছিল অনেক সংরক্ষিত অংশবিশেষ যার কোনটার বয়স আমার চেয়েও অধিক ছিল ৷
সংরক্ষণের ভীতি দাদিমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতো ৷ যখন গরমের সময় দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি নামতো তখন দাদিমা বাগানে বসে থাকতো ৷ আর আওড়াতে থাকতো ‘এখন কি হবে আলু, শিমের বীঁচি, গাজর ও যবগুলোর ? হে ঈশ্বর, এবার কি হবে ! না খেয়ে সবাই মারা যাব !’
আমার বেশ মনে আছে একবার দাদিমার ক্ষুধার দানোটা আমার মাঝেও বসত নেয় ৷
আমি অবশ্য কখনও খাবার-দাবারের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী ছিলাম না ৷ যখন যা পেতাম তাই খেয়ে ফেলতাম ৷ অল্প আর বেশি খুব একটা আগ্রহ ছাড়াই ৷ কিন্তু একবার কি যেন হলো ৷ অনেক টানা ঘুম দিলাম সেই দুপুর বেলা পর্যন্ত ৷ বেশ একটা দুঃসহ্য স্বপ্ন দেখছিলাম তার থেকে নিস্তারও বেশ কঠিন ছিল ৷ আমি এতই ক্লান্ত ছিলাম যে বিছানা থেকে উঠে গরমকালীন রান্নাঘরে যেতে পারছিলাম না ৷ সেখানে দাদিমা বেশ সুস্বাদু বোর্চ (গাজর দিয়ে তৈরি স্যুপ) রান্না করছিল ৷ তখন আমি গরম বোর্চের সুললিত ঘ্রাণ ভেসে আসছিল আমার নাকে ৷ কিন্তু আমি নড়তেও পারছিলাম না ৷ এতই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে একটু পাশ ফিরতে পারলাম না ৷ আমার মনে হল পেটের ভিতর খাড়া, সুগভীর একটা গর্ত তৈরি হয়ে গেল ৷ গোটা পেটটাই হয়ে গেল পুরো আমি আর আমি হয়ে গেলাম পুরো পেট জুড়ে ৷ বিছানার ধারের পুরো ওয়ালক্লথটা বা আমার জুতোর ফিতেগুলো সব খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হল ৷ এরকমটা আগে বা পরে কখনই আমার বোধ হয়নি ৷ পিঁশাচের মত হেলেদুলে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলাম পায়জামার রশি হাতে ধরে ৷ এমনকি কোন সম্ভাষণও দাদিমাকে দিলাম না ৷ বসে পড়লাম খাবার টেবিলে আর পুরোটাই বুঝতে পারল দাদি ৷ একবাটি বোর্চের স্যুপ আমাকে দিল আর আমি গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম ৷ আসলেই খাচ্ছিলাম না শুধু গিলতে লাগলাম ৷ দাদিমা পুরো সময় ধরে আমাকে দেখছিল আর মজা লুটছিল ৷ তার মনে হল যেন তার মতই হয়ে গেলাম এই আমি - যোগ্য উত্তরসূরি ৷ যেন তার ক্ষুধার দানোর অংশীদারিত্বের মানস সন্তান ৷ তাই তো আমি খুব বেশি আবেগী ৷ সেটা আমাদের দুজনের জন্যই ৷
শেষের দিকে দাদিমা মারা যাওয়ার আগে দাদিমা আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিলেন তার বিছানায় ঘুমাতে ৷ তারপর থেকে তার বিছানায় তার সাথে আমি ঘুমাতে লাগলাম ৷ সে বিছানায় দাদির মৃত্যু হয়েছিল কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে সে কখনও উদ্ধিগ্ন ছিল না ৷ সেসময় আমি তাকে এটাও বলেছিলাম তার সাথে ঘুমানো কষ্টকর ৷ কারণ আমি দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাই ৷ যদিও আমার কথাগুলো তার অনুভূতিতে সাড়াও ফেলতে পারল না ৷ আমিও ক্রমাগত প্রতিদিন দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকলাম ৷
বার বছর বয়সে আমার উপলব্দিতে আসল যতদ্রুত সম্ভব আমায় দাদিকে ছেড়ে যতদূর চলে যাওয়া উচিৎ ৷
মনে পড়ে একবার অগাস্ট মাসের ঘরমের দিন ৷ দু’জনে মিলে বাগান থেকে শিমের বিঁচি উঠাচ্ছিলাম ৷ দাদিমা তার পরের গল্প আমাকে শোনাচ্ছিল ৷ তার জন্য শিম থেকে বিঁচিগুলো বেছে বেছে বড় একটা পাত্রে জমাচ্ছিলাম ৷ সেখান থেকে বড় ব্যাগ করে উঠানের এককোণে জমিয়ে রাখছিলাম ৷ জানি না কি হয়েছিল দাদিমা স্বীকারোক্তি করতে লাগলেন ৷ সত্যি জানি না কিভাবে হল ৷ মনে হয় আমি কিছু বলেছিলাম জীবন সম্পর্কে কথার ছলে ৷ স্বর্গ, নরক ও আত্মা নিয়ে ৷ আর এগুলো নিয়ে আমার কথা বলতে ভাল লাগতো ৷
পরে দাদিমা হঠাৎ বলে উঠলঃ আমি আত্মায় বিশ্বাস করি না ৷ এমনকি কিছুতেই আমার বিশ্বাস নেই ৷ যে কেউ মরে আর তার হাড়গুলো মিশে যায় আর এটাই সব ৷ জীবিত সময়কাল অতঃপর শেষ ৷ তার বাইরে কিছু নেই ৷
আমি বললাম, ‘দাদিমা, এভাবে ভাবা আসলে সঠিক নয় ৷ তুমি কি ভয় পাওনা তুমি মারা যাবে আর তোমার হাড়গুলো মিশে যাবে. তাই সব ?’
‘সেখানে ভয় পাওয়ার কি আছে ? এভাবেই সব ঘটে থাকে ৷’
‘তাহলে কেন এই বেঁচে থাকা ? যদি এরপরই কিছু না থাকে !’
‘তারপর কি আসলে কিছু নেই ? এই তুমি ! তুমি আমার জীবনের সব মনে রাখবে, আমি যা যা সব তোমাকে বলেছি ৷ সবটা হবে অমর ৷’
আমি বুঝতে পারলাম যে, আমাকে পালাতে হবে ৷ শিমের বিঁচি ছাড়ানো বাদ দিয়ে দৌঁড়ে চলে আসলাম ৷ দাদিমা কাছ থেকে পালিয়ে আসলাম আর নিজের জীবনে প্রর্ত্যাবর্তন ৷ কারণ আমি হতে চাইনি তার অমরত্ব ৷ চেয়েছি নিজস্ব আমিকে ৷ যদিও অনেকক্ষেত্রে তা নির্ভুল নয় ৷ আর চেয়েছি নিজের জীবনের উপর কর্তৃত্ব ও অমরত্বকে ৷ আমি চাইনি তার অবিশ্বাসের ভোক্তভোগী হতে ৷ যখন পালিয়ে আসি এগুলো আমার মাথায় ভিড়ছিল ৷
এখন বয়স ত্রিশ বছর আমার ৷ দাদিমা মারা গেছেন বহু বছর আগে ৷ তার শেষযাত্রাতেও আমি যাইনি ৷ কিন্তু আমি পারিনি নিজেকে বাঁচাতে ৷ মনে হয় পালিয়েছিলাম দেরি করে ৷ আমার নিজের কোন গল্প নেই - সবই তার ৷ অন্যদেরকে আমি তার গল্পই বলি ৷ অচেতনভাবে আমার ইচ্ছার প্রতিকূলে ৷ মাঝে মাঝে আমার ভেতরে এসে বসে থাকে আর ক্রমাগত পীড়া দেয় গল্পগুলো বলতে ৷ আর যখন তাদেরকে কথাগুলো বলে ফেলি আমার সত্যিকারের আনন্দ হয় ৷ এবং কেঁদে ফেলি ও আনন্দিত হই ৷ তাই তো আপনার কাছে অনুরোধ একটু শুনুন আমার কথা ৷ খানিকটা সময় দিন ৷ চলে যাবেন না! এক মিনিট কি সময় হবে না ? যুদ্ধের সময় দাদিমা সামরিক হাসপাতালের মেস হলে কাজ করতেন ৷ কিভাবে যেন কাপড় কাঁচার সময় সেই বড় চৌবাচ্চায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন…………. ৷
*__**__**__**__**__**__**__**__**__**__**__**
ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত লেখা অনুবাদের প্রচেষ্টায় ৷