ক্যালান্ডারের পাতায় তখন ১৯২৭ সাল।
বাঙালী খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত মোহনবাগান ক্লাবের সাথে আজ আরডিসিএলআই দলের খেলা। এ দলটি বিদেশী ফুটবলারদের নিয়ে গড়া। কাজেই খেলা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। হাসির আওয়াজে আসমান ফাটানো কাজী নজরুল এ খেলা দেখতে যাবেন না, তা কি করে হয়? কবির বন্ধুরা তাই সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে টিকেট খুঁজে হয়রান, কিন্তু কোথাও মিললনা। সবাই যখন একটু মন ভার করে কবির অফিসে এসে হাযির, কবি তাদেরকে দেখালেন, এ খেলার জন্য তিনি আগেই সবার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সবাই আনন্দে খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরী হল। এ সময় তিনি প্রায় প্রতিদিন কাজ শেষে বন্ধুদের নিয়ে খেলার মাঠে যেতেন। ক্রীড়ামোদী হিসেবে তখন তার বেশ পরিচিতিও ছিল বন্ধুমহলে।
জীবনের শুরু ও শেষে নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটানো কবি নজরুল এ সময়টাতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। কাজ করতেন সওগাত পত্রিকার অফিসে। বেতন হিসেবে পেতেন কমপক্ষে তৎকালে দু শ টাকা। কবিতা গান গল্প আর রচনা লিখে আরও বেশ কিছূ কামাই হতো তার। এমন সুদিনে তিনি বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকতেন হৈ হুল্লোড়ে। তার খামখেয়ালীপনার কান্ড কারখানা দেখে আনন্দের বন্যায় ভেসে যেত বন্ধুদের সব দুঃখ বেদনা।
খেলা শুরু হল। কবির দু পাশে তার বন্ধুরা তাকে বেষ্টনী দিয়ে রেখেছেন প্রহরী হিসেবে। খেলা দেখার সময় সব ভুলে একেবারে অন্যমানুষ যেন ছোট শিশুর মত হয়ে যেতেন নজরুল। কখনো আনন্দে লাফ দিয়ে কারো গায়ে পড়ে যেতেন, নয়তো কাউকে বল ভেবে পদাঘাত করে বসতেন, গোল গোল বলে জ্ঞানশূন্য হয়ে কাঁিপয়ে তুলতেন চারদিক তুমুল চিৎকারে। মাঠভর্তি দর্শক হা করে তাকিয়ে দেখত বিদ্রোহী কবির শিশুসুলভ কান্ডকারবার। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হতো আশেপাশের মানুষ।
খেলা শেষ হলো। ছয় গোলে মোহনবাগান হারিয়েছে বিদেশী ফুটবলারদেরকে। নজরুলের আনন্দ তখন আর দেখে কে?
শুরু হল বন্ধুদের নিয়ে তার উল্লাস নৃত্য। সবাইকে নিয়ে নেচে খেলে ক্লান্ত হলেন কবি। তারপর ঢুকলেন পাশের খাবারের দোকানে। পেট ভরে সবাই তৃপ্ত হল। তবু মন ভরেনা দুরন্ত কবির। এই চল, চন্দননগন থেকে ঘুরে আসি। প্রাণখোলা নজরুলের মুখে এমন কথায় সবাই একলাফে রাজী। কারো বাড়ীতে কেউ জানালোনা, সবাই চলল চন্দননগর।
চন্দননগরে এসেও মন মানে না কবির। আরও দূরে যেতে চান তিনি। একটু আনন্দ আর প্রানখোলা হাসিতে জগত ভরিয়ে দিতে তার চঞ্চল মন তাকে শান্ত হতে দিচ্ছেনা যে। নাহ, চল, সবাই ঢাকা থেকে বেড়িয়ে আসি। যা হয় হোক। কবির এমন খেয়ালীপনা তার বন্ধুদের কাছে নতুন কিছু নয়। কোনো নিয়মের শেকল তাকে আটকাতে পারেনি, ছোটবেলা থেকে নির্বাক হওয়া অবধি।
কোথায় চন্দননগর আর কোথায় ঢাকা? কিন্তু যেখানে সাধ্যের চেয়ে সাধ বড়, সেখানে আর কে ঠেকায়? বাঁধনহারা নজরুলের ডাকে এক কাপড়ে সবাই ছুটল শিয়ালদা ষ্টেশনে। এবার টিকেট কাটতে গিয়ে হুঁশ এল সবার। এক নজরুলের পকেটে যে টাকা আছে, তা দিয়ে সবার ঢাকা ঘুরে আসা সম্ভব নয়, বাকী সবার পকেট শূন্য। তবে কি সবাই ফিরে যাবে কলকাতায়? নিছক টাকার জন্য ঢাকা যাত্রা বাতিল হচ্ছে? যেখানে নজরুল, সেখানে সব হিসেব ভুল। সবাইকে হাঁক দিয়ে বললেন, এই তোরা দাঁড়া, চিন্তা করিসনে, ব্যবস্থা করে আসছি।
লম্বাচুলের বেশে বলিষ্ঠ দেহের সুপুরুষ তাগড়া জোয়ান নজরুলকে তখন অনেকেই চিনতো। তিনি ষ্টেশনের গেটে যাওয়া মাত্র তাকে দেখে দৌড়ে এলেন মাস্টার। নমস্কার জানিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানালেন লোকটি। নজরুলও তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, এই যে শুনুন, আমরা কয়েকজন ঢাকা যাব, কিন্তু সবার যাওয়ার মত খরচ নেই, আমরা ভেন্ডার গাড়ীতে যেতে রাজী আছি।’ কবির কথায় কাজ হলো। দেশজুড়ে তামাম জনতা যার কবিতায় মত্ত হয়ে যায়, সামান্য মাস্টার সেখানে তেমন কি?
সবার যাওয়ার ব্যবস্থা হল। ইষ্ট বেঙ্গল মেলে চড়ে সবাই ছুটলো হাসি আনন্দ আর গান বাজনার মধ্য দিয়ে। সবাই এসে নামলো গোয়ালন্দ স্টেশনে। এখান থেকে বাকী পথ যেতে হবে জাহাজে। টাকা নেই, টিকেট নেই। এই এতদূরে ভিনদেশে কে চিনে নজরুলকে? এবার উপায়। নজরুল পড়লেন বিপদে, তার বন্ধুরা দুশ্চিন্তায়।
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন কাজী নজরুল। যেখানে নজরুল সেখানে সব রীতি ভন্ডুল। নজরুল তাই সবাইকে চুপে চুপে কী যেন বলে নিজে একটি টিকেট আর একখানা মাদুর কিনলেন ঘাট থেকে। তারপর সোজা কোন তোয়াক্কা ছাড়া মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লেন জাহাজের ডেকে। কোনদিকে না তাকিয়ে ভরাট গলায় টান দিলেন, প্রাণভোলানো সুরে শুরু করলেন গজল গাওয়া। চুপে চুপে বলে আসা বুদ্ধিমত তার বন্ধুরা ততক্ষণে তার চারপাশ ঘিরে বসে তালি বাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ মাথা নাড়াচ্ছে, এ যেন আসমানী জলসা। কবি তখন গভীর ভাবের সাগরে ডুব দিয়ে একের পর এক গাইছেন ভুবন ভোলানো গজল। বন্ধুদের কারো কাছে টিকেট নেই, তাতে কী? সবাই তখন দেওয়ানা মাস্তানা নজরুলের দরাজ সুরের সাগরে।
দেখতে দেখতে জমে গেল ভীড়। ছুটে এল খোদ জাহাজের কর্মচারী ও কর্তারাও। কার সাধ্য, নজরুলের কথা ও সুরের যাদুকে ঠেলে দেয়, যেমনই তার কথা তেমনই তার সুর, যে শুনেনি, তাকে কে বুঝাবে তার যাদুকরী মনমোহনীর ক্ষমতা। শ্রোতা দর্শকের ভীড়ে ও চাপে জাহাজ কাত হয়ে যাচ্ছে, এমন গুরুতর দশা দেখে উপর থেকে নীচে নেমে এলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। রাগের মাথায় নীচে নেমে তিনিও মজে গেলেন সবার সাথে। বিনয় শ্রদ্ধার সাথে নজরুল ও তার সাথীদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একেবারে জাহাজের মাঝখানে বসিয়ে দিলেন কবিকে।
শুধূ কি তাই, টিকেট পরীক্ষকও সব ভুলে ডুবে থাকলেন নজরুলের মায়াবী হৃদয়দোলানো সুরের সাগরে। দৌড়ে গিয়ে নিজের রুম থেকে তবলা এনে হাতে তুলে দিলেন নজরুলের বন্ধুদের, বারবার জানতে চাচ্ছিলেন কোন সেবার কিংবা কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা? এভাবে পুরো পথ পাড়ি দিয়ে রসিক নজরুল এসে পৌঁছলেন আমাদের ঢাকায়। কবি হিসেবে তার নাম ডাক তখনো তেমন ছড়ায়নি, এই ঢাকায় তাকে সমাদর করবে কে?
তাছাড়া এত বন্ধু বান্ধব মিলে তো আর একজনের বাড়ীতে উঠা যায়না, সবাই তখন বুদ্ধি করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যার যার স্বজন পরিজনদের বাসায় গিয়ে উঠলো। নজরুল থাকলেন বুদ্ধদেব বসুর দলে। আরও কয়েকজন সাথে নিয়ে এ দলের দায়িত্ব নিলো বুদ্ধদেব। তার এক আত্মীয় ঢাকায় উচ্চপদস্থ সরকারী কর্ত। সবাই মিলে সেখানে গিয়ে উঠার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো।
এবার আরেক বিপদ। এ দলের সবাই হিন্দু শুধূ কবি নজরুল ছাড়া। বন্ধুরা বিপদে পড়লেন এ প্রাণের বন্ধুকে নিয়ে। তৎকালে ঢাকায় হিন্দুদের সমাজে ছিল জাতিভেদের প্রথা আর কৌলীন্যের বড়াই। তাই নজরুল নাম শুনলে তাকে কেউ ঘরে তুলবে না। তবে কী করা যায়? সবাই মিলে নজরুলের নাম আপাতত বদলে দিল। তার নাম স্বামী রামানন্দ। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের বিশাল বপুর অধিকারী নজরুলের সাথে নামটা একেবারে মিলে গেল। তার চোখ মুখের অপূর্ব দীপ্তি আর ভরাট গলা শুনলে তাকে বাউল সন্যাসী না ভেবে উপায় নেই।
বুদ্ধদেব বাবু তার এ দল নিয়ে হাজির হল তার আত্মীয়ের বাসায়। বাবরী চুলের নজরুলকে দেখে পরিচয় জানতে চাইল ঘরের লোকজন। ইনি বেলুড়মাঠের রামানন্দ বাবাজী’ বলে সবাইকে জানিয়ে দিলো দলনেতা। মুহূর্তে সাড়া পড়ে গেল সারা বাড়ীজুড়ে। কাছে গিয়েও যার পদধুলি পায়না মানুষ, তিনি এসেছেন এ বাড়ীতে অতিথি হয়ে, সাধক পুরুষের পদধুলিতে ধন্য হবে সবাই, নিজেদেরকে বড্ড সৌভাগ্যবান ভাবতে লাগলেন বাড়ীর কর্তারা।
শুধু কি কবি? নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার ভান্ডার। কখনো তিনি হাতের রেখা বলে ভবিষ্যত বলে দিতেন। বেদ বেদান্তদ, উপনিষেদ, রামায়ণ আর মহাভারতসহ হিন্দু ধর্মের নানা গ্রন্থে তার জানাশোনা ছিল প্রচুর। হিন্দুয়ানী ধর্মের তত্ত্বকথাতো বটেই, তাদের শ্যামাসঙ্গীতেও তিনি ছিলেন পটু। আর তাই বাবাজী বেশধারী নজরুল এ কয়টা দিন ধর্মের গুরুগম্ভীর আলোচনা, কখনো শ্যামাসঙ্গীতের উজাড় করা সুরে ভরিয়ে দিতেন সবার মন।
এমন সাধক বাবার সুনাম শুনে পাড়া পড়শীরা ছুটে আসতে লাগলো ফলমূল আর মিষ্টান্ন মিঠাই নিয়ে। ভক্ত অনুরক্তের আগমনে ভরে গেল কর্তার ঘর আঙিনা। একটু প্রনাম জানাতে নানা পদের আহারাদী নিয়ে ছোট বড়রা আসতে লাগল যে কদিন নজরুল ওখানে ছিলেন। আত্মভোলা নজরুলের বেশ ভালোই লাগছিল এ বাবাজী জীবন। আড়ালে মুখ টিপে তখন হাসছিল তার বন্ধুরা। এই না হলে কি আর তাদের প্রাণবন্ধূ নজরুল।
কুইজঃ সর্বপ্রথম কোনদিন কবির অস্বাভাবিক আচরণের প্রকাশ পাওয়া শুরু হল?
উত্তর- ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই। স্মৃতিভ্রষ্টতার কারণে এদিন তিনি এক চিঠিতে তারিখ লিখেছিণেন এভাবে- ৭-১০-১৯৪২। এদিন তার বন্ধু মুন্সী জুলফিকারকে ডেকে পাঠাতে ঘরের খোকাকে দিয়ে পাঠানো লেখা এক চিঠিতে তিনি তার এক সহকর্মীর গ্রেফতারের কথাও লিখেছিলেন, অথচ তিনি তখনো গ্রেফতার হননি। চিঠির শেষ লাইন ছিল, আমি কাল থেকে অসুস্থ।
ভালো লাগলে জানাবেন, আরও অনেক কিছু লিখব। সূত্র লাগলে জানাবেন।