somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গন্তব্য... (গল্প)

০১ লা জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ক'টা বাজে এখন? কতটা পার হয়েছে বেলা?

বিকেল পড়ে এসেছে। সন্ধে হয়ে এলো বোধহয়। বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে বোঝা যায় না সময়।

বড় অসহায় লাগে নিজেকে।

জানি না এইবেলা আর খেতে দেবে কিনা। গত দু'দিন ধরে একবেলা মাত্র খাবার দিয়ে যায়। তাও খুব ভয়ে ভয়ে। কোনওরকমে একজন ঘরের তালাটা খুলে আলগোছে ঠেলে দিয়ে যায় বাসি খাবারের একটা থালা। আমি হাত বাড়ালেই সভয়ে সে হাত সরিয়ে নেয়। যেনবা ভয়াবহ কোনও ক্ষতি হয়ে যাবে আমার ছোঁয়া লাগলে।

পাড়ার মেয়েপুরুষ সব দলে দলে এসে জানালা দিয়ে দেখে দেখে যায় আমাকে। কি অদ্ভুত আতঙ্কগ্রস্থ চাহনি একেকজনের!

কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না।

সহজ সরল একটা জীবন ছিলো আমার। গ্রামের এক গেরস্থ ঘরের বউ। ছোট ছোট দু'টি ছেলেমেয়ের মা। খুব গরীব সংসারে জন্ম হয়েছিলো। স্কুল পাশ করতে না করতেই আত্মীয়রা সম্বন্ধ এনে বিয়ে দিয়ে দিলো জমি জিরেতওয়ালা এই ঘরে।

তা হোক। আমি দোষ দিই না কারও। চিরকাল বড় খাওয়া পরার কষ্টে মানুষ হয়েছি। এখানে তো আর সেটা ছিলো না। দু'বেলা দু'টো ভাত আর বছরে দু'টো নতুন পরণের কাপড় পেলে আর কি লাগে মেয়েমানুষের?

কেউ ফিরেও তাকাতো না এখানে। মোষের মত খাটতাম শুধু। সংসারের কাজ করে, ক্ষেত খামারের হ্যাপা সামলে, গরু ছাগলের দেখভাল করে, শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করে, দিন নেই রাত নেই মানুষের ফাই ফরমাশ খেটে, রেঁধে বেড়ে সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে নিজেরই আর মরার মত শক্তিটুকুও থাকতো না।

ছেলে মেয়ে দু'টো হবার পরে অবাক হয়ে দেখি, কেউ তো তবু তাকায় আমার মুখের দিকে। কেউ তো তবু হাসে আমার মুখের হাসি দেখে। সে এক অনির্বচনীয় সুখ!

সাধারণ আর দশটা মানুষের মতই চলে যাচ্ছিলো দিন। সাধারণ, স্বাভাবিক। মানুষের ভেতরে যে এত অস্বাভাবিকতা থাকে, আমার জানা ছিলো না। আমার নিজের ভেতরেই এত অস্বাভাবিকতা আছে, সেটাই তো চাপা ছিলো বহুদিন ধরে। ভুলে ছিলাম যে আমি একজন অস্বাভাবিক মানুষ। কিংবা কে জানে, হয়তো আমি মানুষই না। হয়তো আমি অন্য কিছু। হয়তো আমি অন্য কেউ। অন্যসব স্বাভাবিক মানুষদের মত জীবনযাপন আমার পক্ষে সম্ভব না। শত চেষ্টা করলেও না।

ভালোই তো ছিলো সব। শুধু একটা ঘটনা বদলে দিলো সবকিছু।

সেদিনও এমনই বিকেল ছিলো। গেরস্থ বাড়ি, চারিধারে গাছপালা অনেক। অনেক বড় একটা পেয়ারা গাছের ধারে খেলছিলো বাড়ির সব ছেলেমেয়েগুলো। এক পাশে জমিতে নিড়ানি দিচ্ছিলো এই ঘরেরই কিছু লোক। চাকর বাকরও ছিলো বোধহয় কিছু। খেলতে খেলতে হঠাৎ কি মনে হওয়ায় বাচ্চাগুলো পেয়ারা পেড়ে খেতে চাইলো। কিন্তু ওরা তো ছোটমানুষ, অতবড় গাছের আগায় নাগাল পাবে কিভাবে? তাই ভাবলাম ওদের জন্য একটা পেয়ারা আমিই পেড়ে দিই।

আর কি অদ্ভুত! আমি হাত বাড়ানো মাত্রই সেই হাতটা সবকিছু ছাড়িয়ে বিশাল থেকে বিশালতর হতে হতে পৌঁছে গেলো গাছের মগডালে। তারপর হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে এলো একটা আস্ত পেয়ারা!

আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি যে ওটা আমারই হাত!

আর সেই থেকে শুরু হলো আমার এই বন্দী জীবন।

প্রথম দিনটা শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলো পা দু'টো। তারপর কি মনে করে যেন একজন এসে খুলে দিয়ে গেলো।

এখন আমি অমনিই বসে থাকি একভাবে। স্থির, অনড়।

জীবন্মৃতের মত।

মাঝেমাঝে ছেলেমেয়ে দু'টো এসে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, ঘরের জানালা দিয়ে। কি ভয়ার্ত সেই দৃষ্টি! আমার চোখ ফেটে পানি আসে ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে। আমি তো ইচ্ছে করে করিনি এমন। আমি তো জানতামই না যে আমি এমন।

অনেক আগে, ছোটবেলায় খুব অদ্ভুত কিছু জিনিস দেখতাম। কিন্তু বুঝতাম না যে ওগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার না, ভাবতাম আমার মত অন্য সবাইও দেখে ওসব। একবার পুকুরে, অনেক গভীরে পানির তলায় দেখেছিলাম একটা জীবন্ত মুখ, কি যেন সে বলেছিলো আমাকে... কই, আমার ভয় করেনি তো! তারপর একবার, নিঝুম দুপুরে, গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে বাঁশঝাড়ে... অনেকে ছিলো ওরা ওখানে, ঘোলাটে লালচে চোখ তাদের। ঘরে ফিরে সে কথা বলতেই সবাই কি ভীষণ আঁতকে উঠলো! অথচ ওরকম আমি কত দেখেছি! কত ভর সন্ধ্যায় দিব্যি ঘুরে বেড়িয়েছি জঙ্গলে জঙ্গলে, কখনও ভয় করতো না আমার। অথচ আমার ভাইবোনরাই কত ভয় পেতো ওসব।

আমি শুধু ভাবতাম, এত ভয়ের কি আছে এতে?

এখনও আমার ভয় করে না। আগে বুঝতাম না আমার এরকম অস্বাভাবিক কোনও ক্ষমতা আছে, সেদিনের পর থেকে বুঝতে পারি। আর এটাও বুঝি যে, এই ক্ষমতার কোনও নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। সেদিন কেন এমন হয়েছিলো আমি জানি না। ভবিষ্যতে কখনও হবে কিনা, বা হলেও কবে হবে কিভাবে হবে তাও জানি না।

সমস্ত বোধগুলো এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আচ্ছা... ওরা কি খাবারে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলো? নইলে আমার এত অনুভূতিহীন লাগে কেন? দিন যায় রাত আসে, রাত যায় আসে দিন, আর বোধশক্তিহীন এক টুকরো জড় মাংসপিন্ডের মত আমি কুঁকড়ে পড়ে থাকি বদ্ধ এই ঘরটার এক কোণায়। আর কোনও চেতনা অবশিষ্ট নেই এখন।

শুধু একটা কষ্ট। আমার বাচ্চা দু'টো কেন অমন অদ্ভুত চোখে তাকায় আমার দিকে? আমি জানি ওরা এখনও দুধের শিশু, এমন অস্বাভাবিক কিছু দেখলে তো তারা ভয় পাবেই, তবু... কেন? আমার সমস্ত অন্তরাত্মা কেবল হাহাকার করে বলে "ওরে তোরা এভাবে তাকাসনে আমার দিকে... নাহয় আমি ডাইনী, তবু আমি যে তোদের মা! ডাইনী বলে তো আর আমার ভেতরের 'মা'টা এখনও মরে যায়নি! সে তো এখনও তীব্রভাবে বেঁচে থাকতে চায়! আর কিছুর জন্য নয়, আর কারও জন্য নয়! শুধু তোদের নিষ্পাপ মুখ দু'টির দিকে তাকিয়ে!... ... হে প্রভু, দিলেই যদি তবে কেন এমন অভিশপ্ত জীবন দিলে! আর কিছু তো চাইনি আমি তোমার কাছে... শুধু আমার শরীরের, আমার আত্মার ঐ ছোট্ট, অবোধ দু'টি অংশের ভালোবাসা ছাড়া!"

সেদিন শুনতে পেলাম, গাঁয়ের লোকেরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ফতোয়া দিয়েছে।

মারুক, আর কিবা এসে যায়! এভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার চেয়ে জীবন্ত আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া হাজারগুণে শ্রেয়।

শুধু একবার সাধ ছিলো ছেলেমেয়ে দুটোকে শক্ত করে বুকে আঁকড়ে ধরার। মাত্র একবার। সেই সাধও কি পূরণ হবে না?...

একেকটা মুহূর্ত এখন একেকটা যুগের মত লম্বা মনে হয়।

কবে আসবে সেই মুহূর্তটা?

মৃত্যুর মহূর্ত?

এখন শুধু প্রতীক্ষা মৃত্যুর।

ডাইনী এই আমি এখন নির্নিমেষ চেয়ে থাকি মৃত্যু নামক সেই গন্তব্যের দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৩৬
৭৪টি মন্তব্য ৭৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×