যাওয়ার পথের অসাধারন সকালটা উপভোগ করার পাশাপাশি স্কুল কেন্টিনে বিক্রীর জন্য রাখা গল্পের বইগুলো ফ্রি'তে পড়তে পাওয়া ছিলো বোনাস, এস্যাম্বলির আগে ফেরত দেবার শর্তে কতো কতো বই যে কেন্টিনের মামু'র কল্যানে পড়েছি!! আবার সবার আগে খেলার কোর্টগুলোর দখলও নিতাম আমরা বাসওলীরা। বাস্কেটবলের কোর্টটা থাকত খাঁ খাঁ, পিটিম্যাম জোর করে না আনলে তার ধারে কাছে ঘেষতো না কেউ, যদিও হাডুডু, চি-বুড়ি, কুতকুত- এর কোর্টগুলো দখল নেয়ার জন্য কত্তো কাড়াকাড়ি পড়ত।
বাসায় ফেরার সময়টা ছিলো দুনিয়ার মজার, গোমড়া মুখে সিট আকড়ে বসে থাকা নয়, সারাটা পথ সিট ধরাধরি মারামারি লেগেই থাকত, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল সিট আর মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী থাকত সবসময়। ছোটকালে খারাপ লাগত, দাড়িয়ে ঘুমাতে দারুন অপছন্দ আমার, কিন্তু ওই কাজটাই করতে হতো অগত্যা। সেই ভোর ছয়টায় উঠে সারাটা সময় হুটোপুটি (লেখাপড়া বললাম না) সেরে সাড়ে তিনটায় বাড়ি ফিরলে বাসে তো ঘুম আসাই স্বাভাবিক। অথচ এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতো না সিনিয়র আপুগুলো, খোচাঁখুচিঁ চলত তুমুল। তাদের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে সুন্দর মন্তব্য হলো - "এই আসছে টাট্টুঘোড়া ম্যারাথনে নামতে"। অনেক বিরক্ত হতাম, তখন কি ছাই জানতাম ঘোড়া দাড়িয়ে ঘুমাতে পারে!!! ঘুমের ঘোরে কতদিন যে আমাকে নির্দিষ্টের চেয়ে পরের স্টপেজে নামতে হয়েছে। আমাদের বাস ড্রাইভার ছিলেন বিহারী একজন, যার মুখটাকে এখন আমি মেলাই হিন্দীছবির অভিনেতা ওমপুরি'র প্রথমকালের সাথে, যখন তার মুখে দেড়'দু কেজি মাংশ অনায়াসে লাগানো যেতো দাগ পূরন করতে। অনেক কড়া ছিলেন ভালোই ধমক দিতেন আমাদের। আমার উল্টোপাল্টা কান্ডে হুমকি দিতেন অহরহই - "আব্বে! এ কল্লামপুরিয়া, থোমার নামে হামি ম্যাডোমের কাছে রাপোট করিবো", যদিও সে রিপোর্টের কার্যকারিতা দেখিনি কখনও। আমাদের রুটটাতে বাসে কোন টিচার আসতেন না, তাই উনিই আমাদের শাসনে আদরে আগলে রাখতেন, "মেয়েরা এমন করে না! এই চেচাঁমেচি বেশি হচ্ছে! ওমুক সিটের ওমুক, জানালা দিয়ে আর ঝুকবে!!!"
আস্তে আস্তে বড় হলাম, বাসায় ফিরে আসার সময়টা তখন মজাই মজা। কতো কতো দুষ্টুমি, শেষের সিটগুলো দখল করে বেসুরো গানের হুল্লোড়। আমাদের খুব ইচ্ছে করতো বাসের দরজায় দাড়িয়ে হেলপারি করার, হেলপাররুপি বুয়াটাকে একটু সাহায্য করার। কিন্তু যতবারই বলতে যেতাম ধমক অনিবার্য ছিলো। তাও তাও জিজ্ঞাসা করতাম, আশা ছিলো একবার না একবারতো হ্যা বলতেই পারেন, আর আমরাও আদমজী'র ছেলেগুলোর মতো নিজেদের বাসের দরজায় ঝুলবো, ধমাধম বাসে চাপড় দিবো। আদমজী'র বাসের সাথে কিযে অদ্ভুত দ্বন্দ ছিলো! আমাদের বাস দেখলেই তাদের স্পিড হয়ে যেত তুমুল, আর আমাদের বেরসিক ড্রাইভার দিতো আমাদের বাসের স্পিড কমিয়ে। তবে একবার জাহাঙ্গীর গেটটার কাছে জ্যামে পড়ে আমাদেরটা ছিলো সামনে আর ওরা পেছনে আর জ্যাম ছাড়তেই দেখা গেল আমাদের বাস স্টার্ট হচ্ছে না, আমাদের প্রেস্টিজের চৌদ্দটা বেজে গেল, কিছুপরেই আমাদের খুশি দেখে কে যখন বুঝলাম ছেলেরা বাস না ধাক্কা দিলে সামনে যেতে পারবে না। অনেক গাইগুই করে রাগিমুখ নিয়ে ওদের বাসধাক্কা আর পেছনের জানালা দিয়ে আমাদের মুখ ভেংচি - অনেকদিনের মজার টপিকস ছিল আমাদের।
অনেকপরে জেনেছিলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে অন্যতম বৃষ্টি ভেজার আর বাসের হেলপারি করার (ক্লাশ টেনের শেষদিন ওই সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা) স্মৃতিময় ওই বাসের ড্রাইভার ছিলেন আমাদেরই এক ক্লাশমেটের নানা। আমাদের প্রতি তার আদরের কারনও কি তাই ছিল কিনা কে জানে, তবে এখনও মনে পড়ে ওনার আদুরে ধমক - "আব্বে! এ কল্লামপুরিয়া, থোমার নামে হামি ম্যাডোমের কাছে রাপোট করিবো"।