খোকার বয়স সবে চার কি পাঁচ। স্কুলে যাওয়া হয়না এখনও। তাই পড়ালেখার কানমলাটা এখনও ছুঁতে পারেনি ওকে। বনে বাদারে ঘুরে ,নজুদের সাথে মার্বেল খেলে কিংবা কখনও ঘুড়ি উড়িয়ে কখনওবা ওপাড়ার ছেলেদের সাথে ‘জোলাভাতি’ খেলে খোকার দিন কাটে।
ইদানিং তো খোকাকে বাড়িতে পাওয়াই ভার। কোন কোনদিন হয় তো মা এটা ওটার লোভ দেখিয়ে ভরদুপুরটা ঘরে আটকে রাখতে পারে ওকে। অবশ্য বেশিরভাগ দিনই মায়ের চেষ্টা বৃথা যায়।
এতটুকু বয়সেই খোকার অমন পাড়া বেড়ানো দেখে বাবা বলেন , দেখ খোকার মা খোকা একটা বাঁদর হচ্ছে দিনদিন।
মা হেসে বলেন , কতটুকুই আর বয়স খোকার! এ বয়সে অমন একটু আধটু তো করবেই।
বারান্দায় বসে পান ছেঁচছিলেন খোকার দাদু।
তিনি ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন , তুইও তো আর ছোটকালে শান্তটি ছিলিসনা। বরং আমাদের খোকার চেয়ে ঢের বেশি বাঁদর ছিলিস।
দাদুর কথা শুনে বাবা চুপটি মেরে যান।
মা মাছ কুটতে কুটতে বলেন , এ বছরটি পেরোক , খোকাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেই পড়ার চাপে বাঁদরামো পালাবে।
কিন্তু যাকে নিয়ে এতলোকের ভাবনা সে কোথায় ?
এই তেতে রোদ্দুরের ভরদুপুরেও খোকা যে আজ বাড়ি নেই !
খোকাকে এখনও পাওয়া যাবে মাঠে ।
বড় বাড়ির রবিন কাকুকে একমাস ধরে বলে একটা মস্ত লাল প্রজাপতি ঘুড়ি বানিয়ে এনেছে ও । সেটাই আজ উড়ানো হবে। তার জন্যে সেই সকাল থেকে লাটাই সুতো আর ঘুড়ি নিয়ে মাঠে এসেছে খোকা। অথচ দেখ ,একটুও বাতাস নেই। ঘুমটি দিয়ে আছে কেমন। না নড়ছে পাতাটি না উড়ছে কুটোটি। বরং সূর্যটা খিল খিল করে হাসছে তো হাসছেই।
পাশে খেতে গরুর জন্য ঘাস খাটছিলো পাশের বাড়ির ভোম্বলদা ।
খোকা বলে , ও ভোম্বলদা আজ বাতাস বইবেনা নাকি ?
ভোম্বর ঘাস কাঁটা থামিয়ে বলে , আজতো বাতাসের বে রে। বে’র দিন বইবে কি করে ?
খোকা ঠোট উল্টায় , যাও ! তা আবার হয়নাকি ?
লোকে ঠিকই বলে। ভোম্বলদা সত্যিই একটা গাধা। প্রতিবছর এক্সামে মস্ত মস্ত সব গোল্লা পায়।
খোকাইতো কদিন দেখেছে মাস্টার মশায়ের ঠ্যাঙানি খেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে ।
খোকা বলে , তা তোমার দাওয়াত হয়নি ভোম্বলদা ?
ভোম্বলদা যেন ভারি মজা পায় ওর কথায়।
ফ্যাচ ফ্যাচ করে হেসে বলে , তুই তো ভারি বোকারে খোকা। বাতাসের বে’তে মানুষের দাওয়াত হয় বুঝি ?
খোকাকে বোকা বলাতে ওর ভারি রাগ হয়। আর কথাই বলেনা ভোম্বলদার সাথে।
নাহ! হাওয়ার বুঝি সত্যিই আজ বে। দেখাটি নেই।
ভাবে খোকা।
এখন আর রোদে পুড়ে লাভ নেই।
তারচেয়ে দুপুরে খেয়েদেয়ে আসা যাবেখন।
মাঠের পাশেই মস্ত একটা বিল। আলতা দিঘি নাম। তার পাড় ঘেসে আইলটা পেরিয়ে বড় রাস্তাটায় উঠতেই দেখে ওপাড়ার নজু একা একাই রাস্তার পাশে বসে মার্বেল খেলছে।
খোকাকে দেখেই নজু বলে , কিরে খোকা খেলবি নাকি ?
ওর যদিও ইচ্ছে হয় তারপরও আবার ভাবে দেড়ি করে ফিরলে মা আবার দুপুরে খাওয়ার পর বেরোতে না দেয় !
তাই বলে ,নারে খেলবনা !
নজু হয়তো ভেবেইছিলো খোকা খেলবে। হঠাত্ আশা ভঙ্গ হওয়ার সে যেন একটা দমে যায়।
তারপর আবার বলে , চলনা খেলি ! একদানই সই।
খোকা লাটাইসুদ্ধু ঘুড়িটা বগলে চেপে বলে ,উহু !
: বড় চাঁন গুলিটা তোকে দেব।
নজু এবার লোভ দেখায়।
খোকার তাও মন গলেনা। সে ঘাড় নেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
কিন্তু এরপর হঠাত্ করে যে কান্ডটা ঘটল তার জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিলনা।
নজুজে খেপে গিয়ে বগলে চেপে রাখা ঘুড়িটাতে অমন করে থাপ দিয়ে বসবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি।
দেখতে দেখতেই অমন সুন্দর প্রজাপতি ঘুড়িটার আধখানা ছিড়ে নিয়ে নজু দৌড়ে পালিয়ে গেল।
খুকু ছেড়া ঘুড়িটা হাতে নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইল।
সহসা খুকুর চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে যায়।
আর তারপরই দেখে মস্ত একটা মাঠে দাড়িয়ে আছে ও।
মিঠে মিঠে বাতাস বইছে চারপাশে । মাঠে কতরকমের ফুলগাছ। তাতে আবার রঙবেরঙের ফুল ফুটে আছে।
: কি হয়েছে খোকা ? কাঁদছে কেন ?
একটা মস্ত লাল রঙের ফুলের আড়াল থেকে একটা নকশিপাখার প্রজাপতি কথা বলে উঠে।
ও ভারি অবাক হয়ে যায়। মস্ত প্রজাপতিটার দেখাদেখি আরও ফুলের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আরও একঝাক রঙ বেরঙের প্রজাপতি।
খোকাকে চুপ দেখে তারা একসাথে সুর করে ছড়া কাটে।
ওকি খোকার কি হয়েছে ?
চোখযে ছলো ছলো
মন্ডা মিঠাই টাট্টু লাটিম
কি লাগবে বলো !
খোকা বলে , ওসব কিছুই চায়না । নজুর বিচার চাই।
: কি করেছে নজু ?
সবচেয়ে রঙিন আর পুচকে প্রজাপতিটা জিজ্ঞেস করে ।
: নিশ্চয় গাল দিয়ে ।
প্রজাপতির দল থেকে আরেকজন বলে।
: মেরেছে নিশ্চয়। ঐদেখ খোকার গালটা কেমন লাল টুকটুকে হয়ে আছে।
: বড্ড পাঁজিতো। খামচিও দিয়েছে নিশ্চয়। আহারে ! অমন মিষ্টি খোকাকেও কেউ কি মারে ? বকে ?
খোকা বলে , থাম তোমরা। নজু মারেওনি ,বকেওনি !
: তাহলে ? তাহলে ?
প্রজাপতির ঝাকটা সমস্বরে বলে ।
: আমার মস্ত লাল প্রজাপতি ঘুড়িটা ,একবারও উড়াইনি।
: দেখেছি ! দেখেছি ! ভারি সুন্দর ঘুড়িটার কি হয়েছে ?
খোকার গাল ফুলে যায় ,চোখটা আবার ছলো ছলো করে।
: পাঁজিটা ছিড়ে দিয়েছে !
: কি ?
হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠে প্রজাপতির ঝাঁকটা।
: বিচার করতেই হবে পাঁজিটার!
পুচকে ঝাকটা বলে।
হৈ চৈ থামাতে এগিয়ে আসে বড় প্রজাপতিটা।
সে বলে , থাম তোমরা। বিচার অবশ্যই হবে। তার আগে চল নেমতন্ন খেয়ে আসি ?
: নেমতন্ন ? কোথায় ?
খোকা অবাক হয়ে বলে।
আজজে বাতাসের বে ..
: তবে ভোম্বলদা যে বলে বাতাসের বে’তে নাকি মানুষের নেমতন্ন হয়না ?
প্রজাপতিরা ওর কথায় গা করেনা । ওকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে বাতাসের বিয়ের নেমতন্ন খেতে।
সে এক মস্ত আয়োজন।
হাড়ি হাড়ি পোলাও ,কোর্মা ,কালিয়া নিয়ে ছুটছে ফড়িং ,প্রজাপতিরা।
একপাশে মাথায় পাগড়ি পড়ে বসেছে বাতাস।
ভারি একটা খাওয়া হল সেখানে।
নেমতন্ন শেষে প্রজাপতিরা বলে ,এবার চল রাজার কাছে। নজুর বিচার চাইতে।
মস্ত মাঠটার পরে একটা ভারী চমত্কার নদী।
রুপোর জলে থৈ থৈ করছে।
খোকা বলে , এ নদীর নাম কি ?
ঝকঝকে ভাই রুপোর মত জল
এই নদীর আর নাম কি দেব বল
শীতল জলে নাইতে তুমি যদি
বলতে তুমি এযে রুপোর নদী
রুপোর নদীর ওপাড়েই প্রজাপতি রাজার মস্ত প্রাসাদ। হাজার হাজার প্রতিপতিরা ছুটছে ওদিক ওদিক।
মনিমুক্তা খচিত সিংহাসনে সোনার নকশাকাটা মুকুট আর ঝালরে পাখা পড়ে বসেছে প্রতিপতি রাজা ।
খোকার কথা শুনে বললেন ,
এতবড় সাহস নজুর
প্রজাপতি ছিড়ে ?
একুশ হাজার প্রজাপতি
আন পাজিকে ধরে !
আচ্ছা করে কান মলে দাও
ঠ্যাঙটা যেন ভাঙে
চুলগুলো নাও ছাড়িয়ে
ফেল রুপোর গাঙে ।
আচ্ছা আচ্ছা কিল ঘুসি সব
জোরসে মেরো সব
কতবড় সাহস পাজির
খোকার সাথে ঢপ !
রাজার আদেশ বলে কথা। তখুনি একুশ হাজার প্রজাপতি সৈন্য লাঠি সুড়কি ঢাল তলোয়াল নিয়ে ছুটল নজুকে শায়েস্তা করতে।
তাই দেখে খোকা খুশিতে হি হি করে হাসতে লাগল।
: কিরে খোকা অমন করে হাসছিস কেন ?
একি! মা আবার এলো কোথা থেকে ?
চোখ খোলে তাকায় ও।
চারপাশ ঘিরে বাবা,ছোটকাকা ,দাদু আর একপাশে টেথিসস্কোপ গলায় জসু ডাক্তার।
খোকাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই তিনি বললেন , বলেছিনা কিস্যু হয়নি ! এই রোদ্দেরে টো টো করে ঘুরে বেরোলে তো মাথা ঘুরিয়ে পড়বেই ।
শুনে বাবা বললেন , এখন অমন ঘুরে বেড়ানো বন্ধ। রোদ্দুরে তো না ই। রোজ সকালে আমার কাছে পড়তে বসবে। আগামী বছরই তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেব।
পরদিন ভোম্বলদার কাছ থেকে খোকা শুনল ,নজু নাকি পিছলে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছে !
খুকু ভাবে ,ছাই পিছলে পড়েছে। নিশ্চয় প্রজাপতিরা ওক ঠেঙিয়েছে !