নবজাগরণে যেমন রাষ্ট্র পেয়েছে নতুন প্রজন্মের মুক্তিকামীদের তেমনি পুরনো শকুনেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার এদেশকে মৃত্যুকূপে পরিণত করতে।বধ্যভূমি বানাতে মত্ত হয়েছে তারা আবার নবরূপে,নব উদ্যমে।
গোচরে কিংবা অগোচরে হিটলিস্ট হচ্ছে মুক্তিকামীদের যেখানে রক্ষা নেই সত্যসন্ধানী ব্লগার কিংবা প্রগতিশীল আলেম-সমাজের।
চোখের সামনেই ঝরে পড়ছে কিছু তাজা প্রাণ, ভূলুণ্ঠিত মানবতা,এক নীবর শংকায় জাতি দেশ ফিরে যাচ্ছে '৭১-এর নব সংস্করণে।
কিন্তু জাতির কাছে হিটলিস্ট নেই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের।লিস্ট নেই মুক্তিকামীদের ভীরে যারা হারিয়ে যাচ্ছে লাশের স্রোতে।
লিফটম্যান জাফর মুন্সী থেকে সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ___ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল।
মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ ওয়াহেদুল আলম জুনু অথবা মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মোহাম্মদ ত্বকি __ কেউই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের/চোরাগোপ্তা হামলার আওতামুক্ত হতে পারেনি এখনও।
লাশের মিছিলের সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্বনামধন্য সংগীতব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মিরাজ উদ্দিন আহমেদের লাশ।
আমরা কেউই জানি না এর শেষ কোথায় লাশের মিছিলে সংখ্যাটা আসলে কততে গিয়ে থামতে পারে!
আবার '৭১ এর প্রেক্ষাপট কিংবা মুক্তিকামী মানুষের মৃত্যুকূপ এই স্বদেশ__কোনটার জয় হবে সেটা পরবর্তী ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে।
প্রথম থেকে শুরু করি এক এক করে :
ঘটনা #১ :
১৩ই ফেব্রুয়ারি,বুধবার মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন জাফর মুন্সী।কর্মরত ছিলেন লিফটম্যান হিসেবে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ।
বিকেলে অন্যদের মত শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ব্যাংকের সামনে তিন মিনিট নীরবতা পালন করছিলেন।
এতেই স্পটটি টার্গেটে পরিনত হয়।শিবির ক্যাডাররা দলবদ্ধ হয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সামনে আসে। তারা ব্যাংকের সামনে টানানো 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই'সংবলিত ব্যানারটি ছিঁড়তে টান দেয়। এ সময় ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতো জাফর মুন্সীও ছুটে আসেন। শিবির ক্যাডারদের হাতে হাতে লোহার রড আর দেশি অস্ত্র দেখে অন্য কর্মকর্তারা প্রাণভয়ে চলে গেলেও নড়লেন না মুন্সী। একাই তাড়া করেন ক্যাডার বাহিনীকে। প্রায় এক শ গজ দূরে পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথের ডান কোনায় গেলে শিবির ক্যাডাররা ঘিরে ফেলে মুন্সীকে।
'মুক্তিবাহিনীর রক্ত চাই। জাগরণ মঞ্চে সংহতি জানানোর পরিণতি কী, দেখ এবার।' লোহার রডের আঘাতে আঘাতে জাফর মুন্সীর মাথা থেঁতলে দেওয়ার সময় এভাবেই পাশবিক উক্তি করছিল জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সেদিন।এরপর সেই আঘাতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে পরদিন মারা গেলেন জাফর মুন্সী।
হয়ে গেলেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ।
ঘটনা #২
সন্ধ্যা ৯ টার দিকে।ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন ফিরছিলেন তার মিরপুরের পল্লবীতে তার পলাশনগরের বাসায়।বাসার কাছেই ক্রিকেট খেলছিল কিছু যুবক।
পায়ে হেঁটে নিজেদের বাড়ির সামনে পৌঁছামাত্র তাকে উপর্যুপরি কুপাতে শুরু করে।গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেই তারা পালিয়ে যায়।
আশেপাশেরর লোকজন টের পেয়ে খবর দেয় পুলিশে।তার পরিবারের স্বজনেরাও জড় হয় সেখানে।খবর পৌঁছে যায় শাহবাগে।ফুঁসে উঠে পুরো দেশ ক্ষোভ আর ঘৃণায়।
ময়না তদন্তে ৮টিআঘাতের চিহ্নের আলামত পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬টি গুরুতর আঘাত।
নানা মহল থেকে অপচেষ্টা করা হয় এই হত্যাকান্ডকে জায়েজ বানিয়ে মুলতঃ সারাদেশে চলমান আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেবার।
১৬ ই ফেব্রুয়ারি হত্যার ৫ আসামীকে ধরা হয়।
৩ মার্চ জানা যায় ঘটনার লোমহর্ষক বিবরণ।বেরিয়ে আসে স্বাধীনতাবিরোধীদের সুক্ষ ষড়যন্ত্রের চাল।
ঘাতকদের ৭ জনের দলটির ৫ জন সক্রিয়ভাবে হত্যাকাণ্ডে সংঘটিত করে।এদের এর মাঝে রাজীবকে পাওয়ামাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ চাপাতি দিয়ে দেহ থেকে মস্তক আলাদা করার জন্য প্রথম কোপ দেন। এতে আহত হয়ে রাজীব চিৎকার দিয়ে দেয়ালের ওপর পড়ে যান। পরে ফয়সাল রাজীবকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি অনিকও তার হাতে থাকা ছোরা দিয়ে এই হত্যাকান্ডে অংশ নেন। এ সময় কেউ একজন 'খুন খুন' বলে চিৎকার করলে আসামিরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
হত্যার পেছনের কারণ হিসেবে জানা যায় শাহবাগ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন রাজিব।যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যারা নতুন যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তাদের অন্যতম ছিলেন রাজীব। ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনীতি হয় তার বিরুদ্ধে ব্লগে তীর্যক লেখালেখি ছিল তার। ফলে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রথম টার্গেটে পরিণত হন রাজীব।হত্যার কয়েকদিন আগে জামায়াত-শিবির পরিচালিত সোনার বাংলা ব্লগে শাহবাগ আন্দোলনের নেপথ্য নায়কদের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই উস্কানিমূলক পোস্টের প্রথমেই ছিল রাজিবের নাম।
যার সত্যতা হিসেবে পড়ে বেরিয়ে আসে শিবিরের এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করা নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের সাথে যুক্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ছাত্রের স্বীকারোক্তি।
*** রাজীবকে খুন করা ছিল ধর্মব্যবসায়ী স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির অন্যতম চাল।যেন রাজীবের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জাতিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কে দেওয়া যায়।ফলে এই গণজাগরণ দুর্বল হয়ে পড়বে,দেশ অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হবে।আর সাথে সাথে বাধাগ্রস্থ হয়ে যাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে গঠিত ট্রাইব্যুনাল।
সেই চাল বাস্তবায়ন করতেই ২১শে ফেব্রুয়ারি,বৃহস্পতিবার গণজাগরণমঞ্চে সারাদেশে বিশাল জমায়েতের পরপরই যখন ঘোষণা আসে সময় বেঁধে সামাবেশ করার তখন ৭১-এর কুচক্রী স্বাধীনতা অপশক্তি তাদের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায় শুক্রবার জু'মা নামাজকে কেন্দ্র করে ধর্মের নামে কুৎসা রটিয়ে দাঙ্গা বাধাবার।
২২ ফেব্রুয়ারি তারা জু'মা নামাজের আগেই বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের ব্যানারে ছদ্মবেশে সারাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী তাণ্ডব শুরু করে দেয়।
ধর্মের নামে অধর্ম কায়েম করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।চারিদিকে ব্যাপক ধংসযজ্ঞ চালায় তারা।যার চৌম্বক অংশ হিসেবে থাকে :-
ঢাকা : বায়তুল মোকাররম মসজিদে নামাজের জন্য পাতা গালিচায় আগুন এবং মসজিদের ভেতর থেকে গুলি ও জুতা নিক্ষেপ।
চট্টগ্রাম : প্রেসক্লাব চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানার-ফেস্টুন ও ভাস্কর্যে আগুন ও ভাঙচুর ও এই তাণ্ডব শুরুর আগে "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" স্লোগান দেয়া হয়।
সিলেট : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও শহীদ মিনারে অবস্থিত গণজাগরণ মঞ্চে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।এতে পুড়ে যায় ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ফুল।
নোয়াখালি : সোনাইমুড়িতে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে শিবিরের মিছিল।
** জাতীয় পতাকায় আগুন দেওয়া হয় চাঁদপুর,পাবনাসহ বিভিন্ন স্থানে।
** শহীদ মিনার ভাংচুর ও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় সিলেট ও ফেনীতে।
এছাড়া যেসব স্থানে গণজাগরণ মঞ্চ ভাংচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে :-
সাভার,নারায়নগঞ্জ,আশুলিয়া,রাজশাহী,বগুড়া,গাইবান্ধা,জয়পুরহাট,মেহেরপুর, বরিশাল,পটুয়াখালী,কুড়িগ্রাম,ফেনী মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, পাবনা, ফেনী, গাইবান্ধা, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, হবিগঞ্জ,সুনামগঞ্জ,ছাতক,মৌলভীবাজার, সিলেট,গোপালগঞ্জ,গাজীপুর,চট্টগ্রাম,পাবনা,সিরাজগঞ্জ,মুন্সিগঞ্জ,ফরিদপুর,রাজবাড়ী,বাগেরহাট,খুলনা সহ শতাধিক স্থানে।
*** এর মাঝেই ৪ মার্চ জানা যায় ঘাতক ৫জনকে রিমান্ডে নিলে বেরিয়ে আসে ৮ ব্লগারকে হত্যা পরিকল্পনার চাঞ্চল্যকর তথ্য।রিমান্ডে নেবার পর তারা জানায় আরও আট ব্লগারকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল ঘাতকদের। রাজীবকে দিয়ে শুরু করার পর হিট লিস্ট অনুযাযী পরের ৭ জনকে হত্যার নানা পরিকল্পনা করছিলো ঘাতকরা। কিলিং মিশন সফল করতে কাজ করছিলো চারটি গ্রুপ।
ঘটনা ৩ #
২২ ফেব্রুয়ারি,শুক্রবার রাত সোয়া ১০টার দিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী মামলার সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীত শিল্পী সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জুনুকে।
দুইদিন আগে উনার সাথে কিছু লোক দেখা করতে আসে। বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর থেকে উনি নিখোঁজ ছিলেন। একজন অজ্ঞ্যতনামা মহিলা জনাব জুনুর ব্যক্তিগত ফোন থেকেই উনার বাসায় ফোন করে জানায়- "উনাকে মানা করা হয়েছিল সাক্ষী না দিতে। কিন্তু উনি শোনেন নাই। উনার লাশ চমেকে রাখা আছে। পারলে নিয়ে যান।"
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ সূত্র থেকে জানা যায়, হাসপাতালে একজন অজ্ঞ্যতনামা মহিলা এসে লাশ রেখে পালিয়ে গেছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য,আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জুনু। এ সময় আদালতকে তিনি ১৯৭১ সালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কর্তৃক সংঘটিত মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন। এরপর থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লোকজন তাকে প্রাণনাশের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
জুনুর মৃত্যুর পেছনে সাকার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জান্নাত আরা ফেরদৌস ওরফে রোখসানা নামে এক বিএনপি নেত্রীর সম্পৃক্ততা আছে বলে ধারনা করছে পুলিশ ও জুনুর পরিবার।কেননা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার এক বছর আগে থেকে রোখাসানা এবং তার ভাই আশরাফ তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে বারবার সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু এরপরও জুনু সাক্ষ্য দেয়ায় তাকে সুকৌশলে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ঘটনা ৪ #
২ মার্চ,শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেট শহরের আখালিয়া তপোবন এলাকায় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও সিলেট গণজাগরণমঞ্চের সক্রিয় কর্মী জগৎজ্যোতি তালুকদার তার প্রাইভেট কারে ফিরছিলেন সাথে ছিল তার বন্ধু জুয়েল আহমদ।
হঠাৎ পথে তাদের গাড়ী আটকিয়ে দাঁড়ায় ১০-১১ জনের একটি সসস্ত্র দল।এরা সকলেই ছিল ছাত্রশিবিরের সক্রিয় কর্মী বলে তারা চিনতে পারেন।এক পর্যায়ে গাড়ী থেকে নামিয়ে উপর্যুপরি কোপাতে থাকে তাদের দুজনকে।গাড়িতেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।জগতজ্যোতিকে হত্যাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে অপারেশন থিয়েটারেই মৃত্যু ঘটে জগতজ্যোতির।তার সঙ্গী জুয়েলের ভাষ্য ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উঠে আসে ছাত্রশিবিরের চিহ্নিত কিছু কর্মীর নাম।
২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জু'মার নামাযের পর জামাত-শিবির সিলেটসহ সারাদেশে ব্যাপক তান্ডব চালায়।তারা সিলেটের কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে,গুড়িয়ে দেয় গণজাগরণমঞ্চ।এমন কি শহীদ মিনারে রাখা ২১শে ফেব্রুয়ারির ফুলও জ্বালিয়ে দেইয়া হয়।এতে জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা আগুন লাগিয়ে দেয় ইসলামী ব্যাংক-সহ জামাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শাখাগুলোতে।জগতজ্যোতিও সহ অনেকেই ছিলেন এতে অত্যন্ত সক্রিয়।একই সাথে সাংস্কৃতিক কর্মী ও সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন সবার কাছে।এর ফলেই জমায়াত-শিবিরের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন তিনি।
ঘটনা ৫ #
৭ মার্চ রাত আটটার দিকে নাখালপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে ফার্মগেটে ‘ইটিসি পরিবহনে’ করে পল্লবীতে পূরবী সিনেমা হলের সামনে নেমে পোস্ট অফিসের গলি ধরে ইস্টার্ন হাউজিংয়ে প্রকৌশলী সানিউর রহমান তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় অজ্ঞাতপরিচয় দুইজন তাকে অনুসরণ করে। তিনি দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সময় অন্ধকারের মধ্যে একজন বলে ওঠে ‘এবার কোপ দে।সঙ্গে সঙ্গে একজন ধারালো চাপাতি ও ছুরি দিয়ে তার দুই পা, বাঁ হাত, মাথা ও পায়ে আঘাত করে। এরপর খোড়াতে খোড়াতে সানিউর উল্টো দিকে পূরবী সিনেমা হলের সামনে এগোতে থাকেন। একসময় চলে আসেন মূল রাস্তায়। পথচারী ও জনতার মধ্যে সন্ত্রাসীরা তার ওপর হামলা করার সাহস পায়নি, তারা পালিয়ে যায়।গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।এতে সাক্ষাত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তিনি।পরবর্তীতে ৯ মার্চ তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবিরের অপকর্ম প্রচার নিয়ে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন মিরপুরে হামলার শিকার সানিউর রহমান।সম্প্রতি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের অপকর্ম নিয়ে "রাজাকারের কীর্তিকথা" নামের একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশনা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এসব কারণেই আন্দোলনবিরোধীদের রোষানলে পড়ে হামলার শিকার হন।
ঘটনা ৬ #
৭ মার্চ রাত থেকেই নিখোঁজ ছিল গণজাগরণ মঞ্চ এবং গণআন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তার ছেলে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকি।অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল সে।সেদিনই তার এ-লেভেল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়।বরাবরের মতই তুখোড় ফলাফল হয় তার।বাসা থেকে বের হবার পর হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায় সে।চলে খোঁজাখুঁজি সারারাত ধরে।
এক পর্যায়ে শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় শীতলক্ষ্যা নদীর ৫ নম্বর ঘাটের উল্টো পাশের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের তীর থেকে ত্বকীর লাশ পাওয়া যায়।
কি দোষ করতে পারে এই মেধাবী ভদ্র ছেলেটি??
আসলে দুর্ভাগ্য,তার বাবা যে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী রফিউর রাব্বি।
সবচেয়ে বড় কথা নারায়ণগঞ্জে চলমান।এ ছাড়া তিনি যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের আহ্বায়ক, সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ এবং বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির জেলা শাখারও আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জে নাগরিক অধিকার আদায়ের অনেক আন্দোলন সফল হয়েছে।
তার ছেলে যে এই মুহূর্তে টার্গেটে পরিনত হতে পারে,এটাই তো স্বাভাবিক!!
রফিউর রাবি্ব শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ছেলের লাশ শনাক্তের পর শোকে পাথর হয়ে যান। ত্বকীর লাশ দেখে অন্যরা কান্নায় ভেঙে পড়লেও রাবি্ব ছিলেন শান্ত।তার শান্ত চোখেও ক্ষোভ আর সন্দেহের তীর তাদের দিকে যারা এই মুহূর্তে খুঁজে খুঁজে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে সারাদেশে কেননা জনগণের আন্দোলন তাদের জন্য এখন মরণকামড়।
ঘটনা ৭ #
এখন পর্যন্ত সর্বশেষ হত্যাকান্ড এটি।
১০ মার্চ,মধ্যরাত।প্রায় ১টার মত বাজে।হঠাৎই সংবাদ ঘুরাঘুরি করছে ফেসবুক ও বিভিন্ন পেজে।মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম সাক্ষী সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ আহমেদের লাশ পাওয়া গেছে খিলক্ষেত-কুড়িল ফ্লাইওভারের পূর্ব পাশ থেকে রেলওয়ের পাশে।একসময় মিডিয়াতেও চলে আসে এই খবরের সত্যতা।
ময়নাতদন্তের পর জানা যায় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।কি কারণ থাকতে পারে সেই অনুসন্ধানে কিছু সম্ভাব্য সত্য বেরিয়ে আসে তার ভাই ইমতিয়াজ বুলবুলের বক্তব্যে।গোলাম আজমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার কারণেই তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
উল্লেখ্য,গত ৪ অক্টোবর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের চতুর্দশ সাক্ষী হিসেবে বুলবুল আদালতে ১৯৭১ সালে ঈদ-উল-ফিতরের দিন সন্ধ্যায় পুলিশ কর্মকর্তা ছিরু মিয়া ও তার ছেলের সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা দেন।তিনি জানিয়েছিলেন, সেদিন পাকিস্তানি সেনারা ছিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ৩৯ জনকে কারাগারের বাইরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের গুলি করা হয়।
এরপর থেকে তাকে বিভিন্নভাবে প্রাণনাশের হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়।ভয়ভীতির প্রদর্শনের ফলে প্রায় ৭ মাস ধরে তিনি প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় জীবন-যাপন করছেন।তার দাবী তার সাক্ষ্যপ্রমানের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই তার ভাইকে খুন করা হয়েছে।
বিশেষভাবে এটা মাথায় রাখতে হবে যে ইমতিয়াজের বুলবুল ট্রাইব্যুনালকে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও প্রমানস্বরূপ।ফলশ্রুতিতে এই সাক্ষ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে রায়ে নিশ্চিতভাবে গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হতে পারে।
তাই সহজেই অনুমেয় ইমতিয়াজ বুলবুলকে ক্ষতিগ্রস্থ ও ভীতি প্রদর্শন করতে কাদের মূল শত্রুতে পরিনত হয়েছিল মিরাজ বুলবুল।
সর্বশেষ বলতে চাই এইসব হত্যাকান্ডের মোটিভ অনেকাংশেই সুস্পষ্ট ও সহজেই অনুমেয়।
তাই আর কোন লাশ পড়ার আগে পাড়ায়-পাড়ায় প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।এভাবে চলতে থাকলে দেশ মুক্তিকামী মানুষদের জন্য কেবল মৃত্যুকূপেই পরিনত হবে আর হায়েনারা আবার বধ্যভূমি বানাতে সক্ষম হবে বাংলার পবিত্র মাটিকে।কিন্তু দেশ ঘুরে দাঁড়াবেই এবার।৪২ বছর হয়ে গেছে,অনেক প্রতিশোধ জমে গেছে।সেই প্রতিশোধ আর এখন স্বাধীনতাবিরোধীদের নিতে দেওয়া হবে না,নেবে স্বাধীনতাকামীরা।
মনে রাখতে হবে,
"এ লড়াই বাঁচার লড়াই,
এ লড়াই জিততে হবে। "
জয়____________________________________বাংলা
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৬