খরস্রোতা পদ্মা হারিয়েছে তার গতি, ভাঙ্গনের তীব্রতা বলতে গেলে সঙ্কীর্ণতায় রূপ নিয়েছে। নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও ধরে রাখা যায় না। সময়ের আবর্তনে পদ্মা শুকিয়ে যায় আবার বর্ষা এলে ফিরে পায় তার যৌবন। এই পদ্মার পাড় ঘেষেই নিজ অবস্থানে ঠাঁই দাঁড়ানো শিবচর উপজেলার বাহেরচর গ্রামটি। এই গ্রামের একুশ বছরের সহজ সরল তরুন শাহিন। চেহারা হাবা টাইপের হলেও বুদ্ধিতে নিজেরটা যোল আনা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত জন। তিন বোন, দুই ভাই আর মা-বাবা। বড় বোন দু’টোর বিয়ে হয়ে গেছে আর বড় ভাইও বিয়ে করে বউ নিয়ে ঢাকায় চাকুরী করে। পরিবারে এখন ছোট বোন সাথি আর মা-বাবাকে নিয়ে ভালই দিন যাচ্ছে তার। নিজেদের যেটুকু জায়গা জমি আছে সে টুকু চাষ বাস করে যে ফসল হয় তাতে বছর চলে যায়। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী জমিতে নিজেদের পাওয়ার পাম্প দিয়ে পানি দিয়ে ভালই আয় হয়। শাহিনের বাবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, প্রতিদিন বাজার করে যে লাভ হয় তাতে সংসারের টুকি টাকি প্রয়োজন মিটে যায়। শাহিন লেখা-পড়া তেমন করেনি, প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত ব্যাস, তারপরই ক্ষেতে খামারে কাজ। শাহিন তার ইচ্ছে মত এ দিক সে দিক চলা ফেরা করে। কোন সময় কারও কথা সহজে আমলে নেয় না এমন কি প্রতি বেলার খাবারওটাও সে সবার আড়ালে খেতে পছন্দ করে। এজন্য সবাই তাকে আলাদা চোখে দেখে। বড় ভাইতো সারাক্ষন তাকে নিয়ে একথা সে কথা বলে বেড়ায়। সারা দিন কাজ করে আর সন্ধ্যা হলেই ছুটে যায় পার্শ্ববর্তী চান্দের বাজারে। সেখানে চায়ের দোকানে চা পান করে লেগে যায় কেরাম খেলায়, রাত দশটা কিংবা এগারটা পর্যন্ত চলে এই খেলা।
শাহিনের মা-বাবা সংসারের কথা চিন্তা করে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে কারণ শাহিনের মায়ের এখন বয়েস হয়েছে ছেলেকে বিয়ে করালে একটু শামিত্ম পেতে পারে। চারদিকে মেয়ে দেখা শুরু হলো। অনেক মেয়েই দেখলো কিন্তু পছন্দের কোন মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। শাহিনের দূর সম্পর্কের এক ফুফু তাদের এলাকায় একটি মেয়ের সন্ধান দিলে চুপি চুপি সে তাকে দেখতে যায়। প্রথম দেখাতেই মেয়েকে তার বেশ ভাল লাগে। মেয়ের পরিবারের সবার সাথে সে কথা বলে এমন কি মেয়ের সাথেও। মেয়ে তার সাথে মোবাইল ফোনে অনেক কথাই বলে। এবার মেয়েটির কথা তার মা-বাবাকে বলায় তারাও মেয়ে দেখতে গেল।
মেয়েটির নাম তাহমিনা, বয়স বড় জোর পনের কি ষোল, দেখতে শ্যামলা বর্ণের। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে লেখা-পড়া করে। তাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছয় জন, তিন বোন এক ভাই আর মা-বাবা। বাবা কৃষি কাজ ও অবসর সময়ে অন্যের কাজ কর্ম করে সংসার চালায় আর বড় বোন শারমিন ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে চাকুরী করে। এখানে আরেকটি কাহিনী না বললেই নয় তাহমিনার মা-বাবার প্রথম প্রথম কোন সমত্মান হচ্ছিল না তাই পাশের গ্রামের এক আত্নীয়ের কাছ থেকে শারমিন নামের একটি মেয়েকে দত্তক আনে। এর কিছুদিন পর তাহমিনা তার মায়ের পেটে আসে, এরপর এক ভাই ও এক বোন। গ্রামের সহজ সরল মেয়ে তাহমিনা। বিয়ে কি জিনিস তাই সে বুঝেনা। বয়সের চঞ্চলতায় সে মোবাইল ফোনে ভালই কথা বলতে পারে। প্রায় সময়ই শাহিন মোবাইলে তাহমিনার সাথে কথা বলে। একথা সে কথা এক সময় ভাল লাগা ভালবাসা হয়ে যায়। তাহমিনার মা-বাবা শাহিনদের বাড়িতে দেখতে যায়। তাদের বাড়ি ঘর, পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে মেয়েকে এই বাড়িতে বিয়ে দিতে সম্মতি জানায়। কারণ মোড়ল বাড়ির সুনাম তারা এলাকার লোকজনদের কাছ থেকে বেশ শুনতে পেয়েছে। দু’পক্ষের কথা বার্তা ঠিক হলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় মেয়ের বয়স ব্যাস এখানেও চিরাচরিত ছোট্ট জালিয়াতি। উপজেলা পরিষদ থেকে মেয়ের জন্ম নিবন্ধন কার্ডে বয়স বাড়িয়ে আঠার বছর করে দেওয়া হলো। আর কাজী সাহেবও এই বিষয়টি আমলে না নিয়ে এলাকার মাতববর টাইপের লোকদেও নিয়ে কাবিন নামায় স্বাক্ষর নিলেন। যথা সময়ে বিয়ে হলো। শ্বশুর বাড়ির লোকজন সবাই পছন্দ করল তাহমিনাকে। বিয়ের এক রাত পার হতেই দেখা দিল নতুন বিপত্তি। তাহমিনা শাহিনের সাথে তেমন কোন কথা বলে না। কথা বলে শাহিনের মামাতো ভাই হানিফের সাথে। হানিফ উঠতি বয়সের তরম্নন। মেয়েদের কিভাবে পটাতে হয় তা ভাল ভাবেই জানে। ভাবি লাগে তাই তার সাথে কথা বার্তা বলতেই পারে তাই এই বিষয়টি কেউ আমলে নেয়নি। এলাকার রীতি অনুযায়ী পরদিন মেয়ের বাবা এসে জামাই সহ মেয়েকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল।
বাদেরদিন যখন আসতে হবে তখন তাহমিনা শাহিনদের বাড়িতে আসবে না বলে জানায়। কারণ হিসেবে বলে ঐ বাড়িতে তার মন বসে না, ভাল লাগেনা। যা হোক অনেক বলে কয়ে আবার তাকে তার শ্বশুর বাড়িতে আনা হলো কিন্তু ঐ বাড়িতে এসেই শুরম্ন হলো নানা টাল বাহানা। ঠিক ভাবে খাবে না, রাতে স্বামীর কাছে যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। পরদিন তার বাবা এসে তাকে নিয়ে গেল মেয়ে ছোট তো তাই তাকে বুঝিয়ে তারপর পাঠাবে। এবার তাহমিনা আর ঐ বাড়িতে আসবে না আর তখন বের হতে থাকে নানা অজানা কথা। তাহমিনা বিয়েতে রাজি ছিল না, তার মা-বাবা তাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছোট বলে সে কিছু করতে পারেনি। পাগলের ভান করে বার বার অজ্ঞান হয়ে যায় আর বলে কি ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছ! সে কোন কিছু ঠিক ভাবে বুঝেনা, ভাল ভাবে কথা বলতে পারেনা। তখন তার মা-বাবা বলে- তাহলে তুই শাহিনের সাথে কথা বলছিলে কেন? তাহমিনা বলে মজা করে ছিলাম। এ ধরনের আরও কত কথা। অপরদিকে শাহিনের পরিবারে বউয়ের জন্য সবাই অস্থির। তার মা-বাবার কথা বিয়ে করিয়েছি কাজের জন্য এখন বউ যদি না আসে তবে এ বউ রেখে কি হবে! তাই তারা শাহিনকে তার বউকে তালাক দিতে বলে। কিন্তু শাহিন তার বউকে তালাক দিবে না। সে বলে বিয়ে করেছি কি ছেড়ে দেওয়ার জন্য? বউ যদি আমাকে পছন্দ না করে তবে সে চলে যাক, আমার কোন দুঃখ নেই কিন্তু আমি তাকে কোন দিনও ছাড়বোনা। এখন শাহিন ঠিক ভাবে খায় না, কারো সাথে কথা বলে না। দিন দিন সে পরিবর্তন হতে থাকে।
এদিকে তাহমিনাকে তার জামাই বাড়িতে পাঠানোর জন্য তার মা-বাবা নানা ধরনের কবিরাজের দ্বারস্থ হতে লাগল কিন্তু কোন কবিরাজীই কাজে আসছে না। তাহমিনাকে তার মা-বাবা যে-ই স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যায় তার সাথেই সে আবার চলে আসে। সে তার স্বামীর বাড়িতে থাকবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সে সাথে এও বলে যে যদি তাকে ঐ বাড়িতে জোরপূর্বক রাখা হয় তবে সে আত্মহত্যা করবে। তাই বাধ্য হয়ে তাকে তার মা-বাবা সাথে নিয়ে আসে। শাহিন অভিমান করে চলে আসে ঢাকায়। মোবাইল ফোনে যদিও যোগাযোগ রাখে কিন্তু সামনে গেলে তাহমিনা তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে অশান্তির আগুনে পুড়তে থাকলো দু’টি জীবন। কি তাদের সমস্যা সেটাও স্পষ্ট নয়। সিদ্ধামত্মহীনতায় ভুগতে থাকে তাদের পরিবার। শুধুমাত্র বয়সের হিসেবটা ঠিকমত করতে না পারায় দু’টি জীবনে নেমে আসছে অশোভ মেঘের কালো ছায়া।