সিসিলিয়া আমি কিতাজিমা। জাপানি এই তরুণ চিত্রপরিচালক রিকশার টানে একাধিকবার এলেন বাংলাদেশে। মুগ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশের রিকশা দেখে। ঠিক করেছেন, আগামী বছর আয়োজন করবেন এক রিকশা-উৎসবের। এ ছাড়া নির্মাণ করবেন রিকশা নিয়ে তথ্যচিত্র
সিসিলিয়া আমি কিতাজিমা বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলেন গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। জাপানের এই তরুণ চিত্রনির্মাতার পরিকল্পনা ছিল, এশিয়ার কয়েকটি দেশ নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করবেন। নানা কারণে সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। খানিকটা হতাশই হয়েছিলেন কিতাজিমা। তবে সেই হতাশা ভুলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের রিকশা দেখে! এত কিছু থাকতে রিকশা! পুরান ঢাকায় রিকশায় করে ঘুরতে ঘুরতে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন কিতাজিমা, ‘জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো। জীবনযাপনের মান অনেক উন্নত। কিন্তু সেখানে আনন্দ খুঁজে পাই না আমি। অথচ বাংলাদেশ দারুণ আনন্দ-জাগানিয়া একটা দেশ। বিশেষ করে এখানকার রিকশাচালক আর রিকশা দেখে মনে হয়েছে, এখানে অনেক রং! অনেক দুঃখ-কষ্ট থাকলেও এখানে প্রাণ আছে!’
প্রাণের স্পন্দন পেয়েছেন বলেই বাংলাদেশের রিকশাচালক, রিকশা আর রিকশাচিত্র নিয়ে কাজ করতে চাইছেন কিতাজিমা। কী ধরনের কাজ? রিকশায় প্রবল ঝাঁকুনি, তার পরও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই রেস, মানে দীর্ঘ দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের টোকিও ম্যারাথনের কথা বলতে পারি। এটা খুব বিখ্যাত হয়ে গেছে। এ রকমই একটা রেসের আয়োজন করতে চাই। এই রেস হবে রিকশার। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা থেকে একজন করে রিকশাচালক তাঁদের রিকশা নিয়ে অংশ নেবেন এতে। মোট কথা, একটা রিকশা-উৎসবই করতে চাইছি আমরা।’
জানিয়ে রাখা ভালো, জাপানি এই পরিচালক প্রথমে একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বাংলাদেশের রিকশা নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছিলেন। তবে এখন তাঁর পাশে অনেকেই দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) চাইছে কিতাজিমার সঙ্গে থাকতে। আগামী বছর বাংলাদেশে জাইকার উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করার ৪০ বছর পূর্তি হবে। এ উপলক্ষে নানা কার্যক্রমও হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই তারা কিতাজিমাকে প্রস্তাব দিয়েছে আগামী বছরের মার্চ মাসে তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও জাপানের দুই দূতাবাস এবং জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনও যুক্ত আছে কিতাজিমার উদ্যোগের সঙ্গে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন কিতাজিমা। আমাদের সঙ্গে কথা হলো ২৭ সেপ্টেম্বর। জন্ম আর্জেন্টিনার বুয়েনেস এইরেসে, বেড়ে ওঠা জাপানেই। বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রের এই নির্মাতা কাজ করছেন জাপানের টেলি ইউজ ইনস্টিটিউট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। ২৯ সেপ্টেম্বর জাপানে ফিরে যাওয়ার আগে জানালেন, কেবল রিকশা রেসই নয়, ওই রেসের সময় সব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করবেন তিনি। সেটা দিয়েই হবে তথ্যচিত্র। এ ছাড়া পরে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরিরও পরিকল্পনা আছে তাঁর। ‘তথ্যচিত্র তৈরি করব ঠিক করেছি। আর ঠিক করেছি, ৬৪টি জেলার রিকশাচালকেরা তাঁদের এলাকার চেয়ারম্যানদেরও নিয়ে আসবেন সঙ্গে। ওই রেসের সময় চেয়ারম্যানরা বসে থাকবেন রিকশায়। তাঁদের হাতে থাকবে নিজ নিজ এলাকার অধিক উৎপাদিত ও বিখ্যাত সব পণ্য। যেমন ধরুন, টাঙ্গাইল থেকে যিনি আসবেন, তাঁর হাতে থাকবে টাঙ্গাইল শাড়ি। বগুড়া থেকে যিনি আসবেন, তার হাতে থাকবে দই।’
এমনটা কেন করবেন? ব্যাখ্যা করলেন কিতাজিমা, ‘এই রেসের মাধ্যমে রিকশাওয়ালা ও সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যে দূরত্ব, সেটা ঘোচানোর ইঙ্গিত থাকবে। এ ছাড়া যিনি দই নিয়ে আসবেন, তিনি সবাইকে বলবেন, “দেখো, এটা আমাদের এলাকার দই, অনেক বিখ্যাত।”’
তার মানে এই উদ্যোগে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণও আছে? মাথা নাড়লেন কিতাজিমা, ‘হ্যাঁ, আছে। কারণ, রেসের সময় আমরা বাংলাদেশিদের পাশাপাশি অনেক জাপানিকেও আমন্ত্রণ জানাব। তাতে করে রিকশাচালকদের এলাকার পণ্যের প্রচার হবে। পাশাপাশি রিকশাও যে পর্যটনশিল্পে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা দেখানো যাবে।’
একইভাবে রিকশাচিত্রের ব্যাপারেও সমাজের দুই স্তুরের শিল্পীদের একসঙ্গে করতে চান কিতাজিমা। রিকশা-উৎসবে রেসের পাশাপাশি বাংলাদেশের নামজাদা চিত্রশিল্পীদের পাশে বসে ছবি আঁকবেন রিকশাচিত্রকরেরাও। এসব মিলিয়ে হবে উৎসব।
পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো! রিকশা থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে কিতাজিমা বলেন, ‘আগামী নভেম্বর মাসে আবার বাংলাদেশে আসব। তখন সবার সঙ্গে বৈঠক করে ঠিক করব, উৎসবটা কীভাবে হবে না-হবে। তবে রেস হবে জাতীয় সংসদের সামনে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতিও মিলেছে। আসলে এই দেশের সবাই এত ভালো, প্রথমবার এসেই মুগ্ধ হয়ে গেছি। বিশেষ করে এই রিকশাওয়ালাদের দেখুন, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কত কষ্টই না করছেন! কিন্তু মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই আছে।
সূএ: