সাদাত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তার নাম দাঁতভাঙা রফিক কিনা আমি জানি না । পুরো নাম রফিক আহমদ । টিকাটুলিতে আপনারা একসাথে এক মেসে থাকতেন ।
আমার টিকাটুলির কোন রফিকের কথা মনে পড়ছে না । মনে করতে ইচ্ছেও করছে না । ব্রেনের নিওরোনে চাপ দিয়ে লাভ কি ? এখন ‘চিনি না’ বললে সাদাত সাহেবের কাছ থেকে বিরাট উপাখ্যান শুনতে হবে । ইতিহাস শোনার ঝামেলা এড়ানোর জন্য দ্রুত চিনে ফেলতে তো দোষ নেই । রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ‘অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে ?’ । তাছাড়া রফিক আহমদ প্রেসিডেন্ট ওবামা না যে তাকে চিনতেই হবে । আমি না চিনেও চেনার মত একটা ভঙ্গী করে বললাম, ‘ও আচ্ছা ।’
‘আপনি বোধহয় এখনও চিনতে পারছেন না ।’
‘আরে কি বলেন চিনবো না কেন ? ওকে না চিনলে কাকে চিনবো ? খুবই ক্লোজ সম্পর্ক ছিল আমাদের । প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মেয়েদের স্কুলের সামনে যেতো হাঁটাহাটি করতে । একবার শিষ বাজিয়ে ধরা খেল । এক বয়াম মুভ মাখতে হলো পিঠে । ওর নাম হয়ে গেলো ‘পোংটা রফিক’ ।’
‘কি রফিক ?’
‘পোংটা । পোংটা রফিক । ক্যারেক্টার একটু ডাউন ছিল তবে লোক ভালো ।’
সাদাত সাহেব প্রসঙ্গ বদলে মুখ কালো করে বললেন, ‘হিমু সাহেব । আমার উচিত এখন আপনাকে কনভিন্স করা । কিন্তু সেটা কিভাবে করব বুঝতে পারছি না । আমি অপটিমিস্ট ধরনের মানুষ । ‘hundred mad men throughout thirteen capitals’ আর্টিকেলের নাম যা আছে তা-ই থাকবে । আমি জানি, আপনি সাথে থাকলে আমার কাজটা আরও সহজ হয়ে যেতো । ইন ফ্যাক্ট আপনি এই কাজের জন্য পারফেক্ট লোক । সব পাগলদের সাথে আপনার ভালো যোগাযোগ । সেক্ষেত্রে আপনাকে শেষবারের মত ভেবে দেখবার জন্য অনুরোধ করছি । আই বেগ ইউ ।’
আমি বিশাল বড় হাই তুলে বললাম, ‘লেনদেনের বিষয়ে আসেন । আমি এক সপ্তাহ আপনাদের সাথে থাকলে কত ডলার পাচ্ছি ?’
‘আমি আপনাকে সাত’শ ডলার দিতে রাজি আছি । জার্নি এলাউন্স আলাদাভাবে দেয়া হবে । ছবি তোলার জন্য সাথে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দেয়া হবে । কন্ট্রাক্ট সাইনিং মানি হিসেবে আপনাকে আগে থেকে অর্ধেক টাকা দেয়া হবে । কাজ শেষ হলে পুরোটা ।’
‘অর্ধেক মানে সাড়ে তিনশ ডলার ?’
‘জ্বি ।’
আমার চোখ কপালে উঠে গেলো । এক সপ্তাহের জন্য সাত’শ ডলার । বাজারে এখন ডলার কত করে চলছে ? আশি করে হলে ছাপ্পান্ন হাজার টাকা । আমার সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে গেল ।
সিগারেট যেটা ছিল সেটা একটু আগে শেষ করেছি । আমি সাদাত সাহেবকে বললাম, ‘আপনি সিগারেট খান ?’
‘ছেড়ে দিয়েছিলাম । আবার ধরেছি । কমিয়ে কমিয়ে খাচ্ছি । দিনে তিনটা ।’
‘একটা সিগারেট খাওয়াতে পারবেন ?’
‘সিওর ।’
সাদাত সাহেব বাংলাদেশের পতাকার মত কভারওয়ালা একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিলেন । গাঢ় সবুজের উপরে লাল বৃত্ত । তবে দেশি জিনিস যে না, বোঝাই যাচ্ছে । বিদেশী দামী কোন সিগারেট । প্যাকেটের লাল বৃত্তের মধ্যে একটা কালো জংলীর ছবি । জংলীটা সম্ভবত বাঁশি বাজাচ্ছে । প্যাকেটের উপরে লেখা ‘ন্যাচারাল আমেরিকান স্পিরিট’ । ও আচ্ছা । এটা তাহলে জংলী না । সত্যিকার আমেরিকান আত্মার ছবি । আমেরিকান আত্মা তো ফরসা হওয়ার কথা । এটা কালো কেন? কোম্পানীর মালিক সম্ভবত রেসিস্ট । নিগ্রো ভুত ছাপিয়ে মজা লুটছে । আমি বিদেশি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে কষে একটা টান দিতে না দিতেই একটা ঘটনা ঘটলো ।
ভৌতিক চিৎকার করে এক তরুনী হুড়মুড় করে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল । পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেস । চোখে সানগ্লাস । সে সাদাত সাহেবকে জাপটে ধরে, ‘পাপা, পাপা’ জাতীয় শব্দ করছে । ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মুখ থেকে সিগারেট পড়ে গেলো । সাদাত সাহেব তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘কি হয়েছে মা ? কি হয়েছে ?’
বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে । বাবাকে এতোদিন ভিলেন বন্দি করে রেখেছিল । আজ মেয়েকেও ধরে বন্দি করে ফেলেছে । বন্দী কারাগারে দুজনের মিলন দৃশ্য । জোর করে তুলে আনার পরও মেয়ের চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে যায় নি । কিছুক্ষনের মধ্যেই নায়কেরও আবির্ভাব ঘটবে ।
দরজার কাছে দাঁড়িওয়ালা শুকনা-মত আরেকজন লোকও দাঁড়িয়ে আছে । চেহারা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ । আমি তাকে ইশারায় ডেকে বললাম, ‘তোমার নাম শামসু ?’
‘জ্বি ।’
‘শামসু যাও, নিচ থেকে শন পাপড়ি কিনে নিয়ে আসো । সাথে পেপসি-কোক’ও আনতে পারো । টাকা আছে না ?’
‘জ্বি আছে ।’
‘হুইলচেয়ার পাওয়া গেছে ?’
‘আপা হুইলচেয়ার, ডাক্তার সব-ই সাথে করে নিয়ে আসছেন । নিচে এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ায়ে আছে ।’
‘এ্যাম্বুলেন্স এনেছে কেন ?’
‘আপা ভেবেছিল স্যার এ্যাকসিডেন্ট করেছেন ।’
‘তোমার স্যার এ্যাকসিডেন্ট করেছেন এমন কোন কথা কি তোমাকে ফোনে বলা হয়েছিল ?’
‘জ্বি না । তবে আপা ভেবেছেন আমি তার কাছ থেকে স্যারের কথা মত এ্যাকসিডেন্টের খবর গোপন করেছি । এ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে কার ?’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমার । তুমি শন পাপড়ি নিয়ে আসো । তারপর কথা হবে । যাও । আসার সময় হুইল-চেয়ারটা ওপরে নিয়ে এসো ।’
শামসু চলে গেল । বাবা-মেয়ের মিলন পর্ব বোধহয় শেষ । দুজনের মুখই এখন হাসি হাসি । সাদাত সাহেব লজ্জিত মুখে বললেন, ‘হিমু সাহেব, এই হচ্ছে আমার মেয়ে রুনি । এই মেয়ে মনে করেছে আমার কোন একটা দূর্ঘটনা হয়েছে । আমি তার কাছে লুকিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি । হাহাহা ।’
আমি রুনির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার বাবার কিছুই হয় নি । আপনার দুশ্চিন্তা অমূলক ।’
সাদাত সাহেব বললেন, ‘মা, রফিক সাহেব যে লোকের কথা বলেছিল, ইনি সেই হিমু । ইনি আমাদের সাথে কাজটা করবেন । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজ দুপুরবেলা হঠাৎ করেই তার প্যারালাইসিস হয়েছে । হুইল-চেয়ার ওর জন্যেই চেয়েছিলাম । ’
আমার ব্যাপারে রুনিকে তেমন চিন্তিত মনে হল না । সে হাসিহাসি মুখ করে বলল, ‘পাপা, আমার ময়না পাখিটা আজ প্রথমবারের মত কথা বলেছে ।’
‘ফোনে তো একবার বলেছো সে কথা ।’
‘দুবার বললে কি সমস্যা ? এক্সাইটিং কথা দুবার বলা যায় । এতে আনন্দ বাড়ে ।’
‘মা, আমার আজ চারটায় ফ্লাইট । আমাকে এখান থেকেই এয়ারপোর্ট চলে যেতে হবে । হাতে বেশিক্ষন সময় নেই ।’
‘তোমার ব্যাগ নিতে তো বাসায় যেতে হবে । আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি ।’
‘তা ঠিক । আমি বাসায় নামবো না । তুমি নিয়ে এসে গাড়িতে তুলে দেবে । আর হিমু সাহেবের অসুস্থ্যতার ব্যাপারটা তোমাকে সামলাতে হবে । আমি চাই এক সপ্তাহের মধ্যে ওর হেল্প নিয়ে তুমি আমাকে চমৎকার একটা আর্টিকেল সাজিয়ে দাও । পারবে না ?’
রুনি ঘাড় কাত করল । রুনির স্বভাবে বাচ্চা মেয়েদের মত কিছু ব্যাপার আছে । তার চেহারাও বাচ্চা-বাচ্চা । তাকে দেখে মনেই হয় না সে পি এইচ ডি’ও করে ফেলেছে । মনে হয় এইট-নাইনে পড়া বাচ্চা একটা মেয়ে । যার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ । এখন মহানন্দে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে । সারাক্ষন অকারনে ছটফট করছে ।
সাদা গাউন পড়া এক মহিলা হঠাৎ দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, ‘নিচে এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে । একটু তাড়াতাড়ি করুন ।’
শামসুও দুহাতে ঠেলে ঠেলে হুইল-চেয়ার নিয়ে এসেছে । আজ সকাল থেকে একের পর এক বিপত্তি লেগেই আছে । আজ কি বুধবার নাকি ? খনার বচনে আছে -
“থাকে বুধ বিষয় করায়,
গুরু শত্রু বহু ধন পায় ।।”
আমি মনে হচ্ছে আঁতেল পিতা-কন্যাকে পেয়েছি শত্রু হিসেবে । সঙ্গে ধন হিসেবে সাতশ ডলার । আমার সুস্থ্য পা এরা মেডিকেলে নিয়ে এনাস্তেসিয়া দিয়ে কেটে না ফেললে হয় ! দেখা গেলো পা কেটে পলিথিনে মুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে । পা-হারা হিমু প্লাস্টিক পলিমারের নকল পা লাগিয়ে বিক্ষত পা খুঁজে বেরাচ্ছে । আমি বিখ্যাত কেউ হলে হয়তো পত্রিকার হেডিং’এও ঘটনা চলে আসতো । শিরোনামঃ ‘পা-হারা হিমু খুঁজে ফিরে একা...’ । আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘চল গোকুলবিহারী গোষ্ঠে চলো হরিমুরারি ...’
রুনি অবাক হয়ে বলল, ‘কি বললেন ?’
আমি নকল হাসি হেসে মিষ্টি করে বললাম, ‘কিছু না । চলুন । হাসপাতালে যাওয়া যাক !’
(প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত । চলবে)
=========================================
উৎসর্গঃ
রাজশেখর বসুর বাংলা অভিধানে ‘কুম্ভীলক’ শব্দের অর্থ দেয়া আছে- ‘যে অপরের রচিত সাহিত্য হইতে ভাব ভাষা প্রভৃতি চুরি করিয়া নিজের বলিয়া চালায়’ । সেই হিসেবে কালিদাস-কাশীরাম দাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সবাই কুম্ভীলক । উদাহরন, কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘কচ ও দেবযানী’ । একই চরিত্র ঘুরে ফিরে অনেকের লেখায় এসেছে । সবটাই সেই আদিশ্লোক-ছন্দের অনুকরনে, নতুন ছন্দে নয় । তবে, রাজশেখর বসু এঁদেরকে plagiarist মানতে রাজী হন নি । তিনি বলেছেন, এঁরা plagiarist এর ঠিক উল্টোটা । যাঁরা অপরের তৈরী চরিত্র নিয়ে লিখেই খুশি । কবিযশঃপ্রাপ্তি এঁদের কারোরই লক্ষ্য ছিল না ।
এতোসব কথার সারমর্ম একটাই । ‘হিমু’কে নিয়ে লিখবার দায়মুক্তি । ফ্রান্সিসকো মেলজি ‘মোনালিসা’র কপি এঁকেছিলেন । ক্যানভাসের সাইজটা বদলে পুরোটাই কপি করা । সেই ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু ক্রিটিকরা এর দাম দেন নি । না দেওয়ারই কথা । সৃজনশীলতা এক, নকল করা অন্য । হিমুর স্রষ্টা আজ নেই । তিনি আজ অন্য কোন ভুবনে । আমি তাঁর পদধূলিকণা । তাঁর মত করে কখনই কেউ লিখতে পারবে না । আমিও পারিনি । পারার ইচ্ছাও নেই । অনেকের এই লেখা দেখে সঙ্গত কারনে খারাপ লাগতেই পারে । তাদের কিছু বলবার নেই । অন্যভুবনের জোছনা-পাগল মানুষটির কাছে দায়বদ্ধতা আছে । অন্যের লেখা ‘হিমুর পাশে তিনটি ছায়া’র উৎসর্গপত্রে তাঁর নামটাই থাকুক ।
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি—
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥
পরম শ্রদ্ধাষ্পদেষু, হুমায়ূন আহমেদ ।
===========================================
আগের পর্বের লিংকঃ
হিমুর পাশে তিনটি ছায়াঃ পর্ব (১)
হিমুর পাশে তিনটি ছায়াঃ পর্ব (২)