চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিলো্ কিন্তু আল্রা আমাকে সেই তৌফিক দেন নাই। হতে পারি নাই চিত্রপরিচালক কিন্তু দীর্ঘদিন চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসোবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলো। অনেক পরিচালকের সাথে সহকারী চিত্র পরিচালক হিসাবে কাজ করেছিলাম্ আমার পরিচালকদের মধ্যে কমল সরকার, মাসুম পারভেজ রুবেল, মাসুদ পারভেজ, স্বপন রহমান অন্যতম। চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় নামের একটি ছবির দৃশ্যপটে নায়কের ছোট বোনের র্ধষনের দৃশ্য; সেখানে আমাকে পরিচালক আমাকে বললো এডিটিং প্যানেলে বজ্রপাত আর আগুন জলছে এমন কিছু দৃশ্যপট এর ছবি সংযোজন করে দিও। এডিটরকে জানিও । ও সংযোজন করে দিবে। অমার মনে প্রশ্ন জাগলো ধর্ষন এর দৃশ্যে কেনো বজ্রপাত এর ছবি দেবে। পরে অবশ্য জানতে পারলামে এই বিষয়টিকে ‘মন্তাজ’ বলে । কোন মানসিক আঘাত প্রাপ্ত জটিল বিষয়সমূহকে এই রকম রুপক অর্থে বোঝানো চলচ্চিত্রের একটি ভাষা। রুপক অর্থে মানসিক অবস্থাটা বোঝানো হতো। মানুষ ঘুমের যে স্বপ্ন দেখে তা ঠিক এমন কাটা কাটা প্রতিটিত্র এর সম্মেলন। কিছু কিছু এমন কাটা কাটা প্রতিচিত্র মানুষ তার ঘুমের মধ্যে দেখে। যাকে আমরা স্বপ্ন বলি। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো “মানুষ কেনো স্বপ্ন দেখে”? স্বপ্ন নিয়ে আধূনিক বিজ্ঞানের মতবাদ নাকি প্রাচীন মিশরীয়দের মতবাদ সত্য?
বর্তমানের আধুনিক বিজ্ঞানের “এক্টিভেশন-সিন্থেসিস” নামের একটি তত্ত্ব বলে যে স্বপ্নের আসলে কোন অর্থই নেই। ঘুমের সময় মস্তিষ্কে স্মৃতিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে একত্রীকরণ করার কাজ করবার সময় মস্তিক্সের বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে আমাদের স্মৃতি থেকে বিভিন্ন চিন্তা এবং আবেগ উঠে আসে। আর এগুলোই আমরা স্বপ্ন হিসেবে দেখি। একমাত্র ঘুম থেকে উঠার পর আমরা এই খাপছাড়া দৃশ্য, চিন্তা এবং আবেগগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করি। তখন তৈরি হয় এক বা একাধিক গল্প। এর আগে মস্তিষ্কে স্মৃতি একীভবন (প্রাথমিকভাবে কোন তথ্য পাওয়ার পর তার বিভিন্ন অংশ মস্তিষ্কে ধরে রাখার প্রক্রিয়া) ও অন্যান্য স্মৃতির সাথে সংযুক্ত করার জন্য ঘুম চক্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বপ্ন কোন না কোন ভাবে স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত। রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাথন উইনসন বলেন –“ স্বপ্ন আসলে ঘুমন্ত অবস্থায় স্মৃতি প্রক্রিয়াজাত করার একটি উপজাত মাত্র।” তিনি যুক্তি দেখান, অভিজ্ঞতাকে স্মৃতিতে পরিণত করার জন্য মস্তিষ্কের যে সম্পদ ব্যবহার করা লাগে তা যদি জাগ্রত অবস্থায় করা হয় তাহলে আমাদের কর্টেক্সের যে আয়তন তার চাইতে বেশি পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার করা লাগবে। এ কাজটি জাগ্রত অবস্থায় করতে গেলে একটা অচলাবস্থার তৈরি হবে। তাই মস্তিষ্কের যে সীমাবদ্ধ সম্পদ আছে আমাদের তার উপযুক্ত ব্যবহার করার জন্য রাত্রে ঘুমের মধ্যে স্মৃতী একীভবন ও সংযুক্ত করার কাজটি করি। আর এই স্মৃতি সংশ্লিষ্ট কাজ করার সময় ঘুমচক্র স্বপ্ন দেখায়ে থাকে।”
মানুষ ঘুমানোর পর ২ ঘন্টা মতো কোন প্রকার স্বপ্ন দেখে না।তখন মানুষের শরীর পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেয়।না সে সময়টাকে non rapid eye movement period বলা হয়। মানুষ যে সময়কাল স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্ন দেখার সময়কালকে rapid eye movement period বলা হয়। নিদ্রাকালে প্রায় প্রত্যেক ৯০ মিনিটে, প্রায় ১০ মিনিট সময় ধরে REM নিদ্রা দেখা যায়। ঘুমের মধ্যে ৪/৫ বার REM নিদ্রা হয়। অর্থাৎ প্রতিদিন মানুষ অন্তত ৪/৫ টি স্বপ্ন দেখে। অনেক আগে থেকেই জানা ছিলো, মানুষ ঘুমের একটা বিশেষ পর্যায়ে স্বপ্ন দেখে। ঘুমের একটা পর্যায়ে দেখা যায় মানুষের চোখের পাতা নড়ছে। এই পর্যায়কে বলে Rapid Eye Movement বা রেম ঘুম।জেগে থাকা,আধঘুম-আধা জাগরণ, গভীর ঘুম, উত্তেজিত ইত্যাদি অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্কের বিদ্যুতিয় তরঙ্গের বিভিন্ন রকমফের দেখা যায়। মস্তিষ্ক সাধারণত চার ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি করে – ডেল্টা, থেটা, আলফা ও বেটা।স্বল্প কম্পাংকের থেটা তরঙ্গের সময় কালটা আসলে রেম ঘুম। এবং এই সময়কালে মানুষ স্বপ্ন দেখে। রেম ঘুমের পর কাউকে ঘুম থেকে তুললে সে বলতে পারে কি স্বপ্ন দেখেছিলো, কতবার দেখেছিলো ইত্যাদি। পয়ষট্টিজন স্বেচ্ছাসেবকের উপর একটি গবেষনা করা হয়।স্বেচ্ছাসেবকদের ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণায় অংশগ্রহণ করা মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মাপা হয়।আর ঘুমের বিভিন্ন সময় স্বেচ্ছাসেবকদের জাগিয়ে তাদের স্বপ্নের বিভিন্ন তথ্য রেকর্ড করা হয়। তারা স্বপ্নে কি দেখেছিলো, কতবার দেখেছিলো,আদৌ কোন স্বপ্ন দেখেছিলো কি না ইত্যাদি তথ্য জোগাড় করা হয়।
কেন রেম ঘুমের পরেই মানুষ স্বপ্নের কথা মনে করতে পারে,এই বিষয়েও একটি গবেষণা হয়েছে। গবেষনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রেম ঘুমের পর যাদের মস্তিষ্কের “ফ্রন্টাল লোব” নামক অংশে স্বল্প কম্পাঙ্কের থেটা তরঙ্গ দেখা যায় – তারাই দেখা যায় স্বপ্ন বেশি মনে করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, যখন আমরা অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মরণ করি, তখনো মস্তিষ্কের এই অংশে স্বল্প কম্পাঙ্কের থেটা তরঙ্গ দেখা যায়। এরকম আরেকটি পরীক্ষাতে দেখা যায় উজ্বল, টাটকা এবং গভীর আবেগীয় স্বপ্নগুলো মস্তিষ্কের “অ্যামিগডালা” এবং “হিপ্পোক্যাম্পাস” নামের দুইটি জায়গার সাথে জড়িত। আমিগডালার কাজ হলো মানুষের আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ এবং তার স্মৃতি নিয়ে কাজ করা। হিপ্পোক্যম্পাস বিভিন্ন স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে একত্রীকরণ করে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে।
সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণায় ঘুমের সময় মানুষজনের মস্তিষ্কের বিভিন্নধর্মী সক্রিয়তা মাপা হয়েছে ব্রেন স্ক্যানার দিয়ে। স্বপ্নের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে সেসব গবেষণার ফলাফল দেখে নেয়া যাক। গল্প বলা স্বপ্নেরা রেম ও গভীর নন-রেম দুই ধরনের ঘুমেই দেখা দিলেও রেম-ঘুমেই এসব স্বপ্নের প্রাদুর্ভাব বেশি। তাই রেম ঘুমের সময়ে মস্তিষ্কে কি কি শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হয় তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গল্প বলা স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করবো আমরা। প্রাণীদের উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে আমরা জানি ব্রেনস্টেমে রেটিকুলার এক্টিভেটিং সিস্টেম রেম ঘুমের সময় সম্পূর্ণ সক্রিয় থাকে। এই সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত স্নায়ুদের সক্রিয়তা PET স্ক্যান করে দেখা সম্ভব। এই স্ক্যান থেকে পাওয়া ছবির একটা লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হলো স্বপ্নে গল্প বলা দৃশ্য দিয়ে ভরপুর হলেও প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সে তেমন কোন সক্রিয়তাই দেখা যায় না। কিন্তু দৃশ্যতথ্য নিয়ে উচ্চস্তরের বিশ্লেষন করে মস্তিষ্কের যেসব অঞ্চল (দৃশ্য তথ্য সম্পর্কিত স্মৃতি সঞ্চয় নিয়ে কাজ করে যারা — তাদেরকে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায় এসব পেট-স্ক্যান ছবিতে। এ থেকে সম্ভবত বলা সম্ভব যে স্বপ্নেরা প্রায়ই কেন অতীতের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি নিয়ে গড়ে ওঠে — বিশেষ করে সেসব দীর্ঘমেয়াদী দৃশ্য-স্মৃতি যারা মস্তিস্কের দৃশ্য-তথ্য বিশ্লেষণ সম্পর্কিত এলাকায় জমা থাকে।
রেম ঘুমের সময়ে মস্তিষ্কের আরেকটা লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হলো আবেগ নিয়ে কাজ করা এলাকাগুলোতেও বেশ সক্রিয়তা দেখা যায়। বিশেষ করে অ্যামিগডালা ও অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট অঞ্চলগুলো প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলগুলো ভয়, উদ্বেগ, ব্যাথা সংশ্লিষ্ট আবেগীয় প্রতিক্রিয়া এবং ভয় কিংবা ব্যাথা সম্পর্কিত উদ্দীপনার সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়। গল্প-বলা-স্বপ্নে ভয়, উদ্বেগ ও আগ্রাসনের যে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তার পেছনে এই দুইটি অঞ্চল দায়ী বলে মনে করা হয়। রেম ঘুমের সময় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কিছু অংশ (ডর্সোল্যাটারাল) একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আমরা জানি প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হচ্ছে মস্তিষ্কের সম্প্রতি বিবর্তিত অংশ। কর্টেক্সের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া অঞ্চলটি যুক্তি, বিচার-বিবেচনাবোধ আর পরিকল্পনার মতো কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্রয়েড স্বপ্নকে বলতেন অচেতনকে বোঝার রাজপথ। স্বপ্ন দেখে আমাদের যা মনে হয় স্বপ্নের আসল অর্থ ঠিক তেমনটা না। স্বপ্নমঞ্চের সামনে কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে, যা আমরা ‘স্বপনে‘ দেখি। আর পর্দার অন্তরালে কিছু বিষয়বস্তু থাকে, যা কিনা স্বপ্নের আসল মানে। মনোবিশ্লেষকের কাজ হলো স্বপ্নের এই প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করা। স্বপ্নে আমাদের সামনে যা যা আসে তার সবকিছুই বিভিন্ন রূপক বা প্রতীক। এই রূপকেরা অচেতন মনের গোপন কামনার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। যেমন ধরা যাক, কোন স্বপ্নে সাপ কিংবা তলোয়ার অথবা বন্ধ ছাতা থাকলে তা আসলে যৌনবিষয়ক ছদ্মবেশী স্বপ্ন! সাপ,লাঠি বা ছাতা সবই ধ্রুপদী ফ্রয়েডীয় রূপক,এরা সনাক্ত হতে দিতে চাচ্ছে না,তাই তার এরকমটা মনে হচ্ছে!স্বপ্নে অচেতন মন নিজেকে প্রকাশ করে। অচেতন মনের ”ইচ্ছেপূরণে‘-র হাতিয়ার হলো স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নমঞ্চের পেছনে না বলা বাসনাটা এতো অস্পষ্ট কেন? কেন অদ্ভূত সব প্রতীক আর খাপছাড়া দৃশ্যকল্প দিয়ে স্বপ্ন জড়ানো থাকে?
স্বপ্নের সময় মস্তিষ্কের গহীন স্নায়ুবর্তনীসমুহে ঘটে যাওয়া সব খুঁটিনাটির খবরাখবর আমাদের জানা নেই। তবুও, স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সক্রিয়তার ধাঁচ দেখা যায়, তা থেকে আমরা স্বপ্নের অনেক লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করতে পারি। স্বপ্ন আমরা কেন দেখি, স্বপ্ন দেখে জীববৈজ্ঞানিক কোন উদ্দেশ্য সাধিত হয় কিংবা স্বপ্নের বিষয়বস্তু কেন আমাদের কাছে এতো অর্থবহ বলে মনে হয় – উপরের ব্যাখ্যা দিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে ঠিকমতো ধরা যায় না। তো, আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? এক কথায় উত্তর হলো, দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো জানি না। তবে শুধু মাত্র আমরা ভিন্ন কয়েকটি পথে ভিন্ন তদন্তের খবরাখবর জানাতে পারি।স্বপ্ন মানুষদেহের একটি আবশ্যিক ধরনের উপাদান। ম্বল্প মাত্রার থেটা কম্পাংকের রেম ঘুম কম হলে (অর্থাৎ স্বপ্ন কম দেখলে) মানুষের জীবনের জটিল আবেগগুলো বোঝার ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্ষমতাটা মানুষের সামাজিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। “ক্যারকট-উইলব্রান্ড সিন্ড্রোম” নামের একটি বিরল রোগে দেখা যায় মানুষ স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্কের যেই অংশ আমাদের দৃষ্টির অনুভূতির সাথে জড়িত, সেখানে ক্ষত সৃষ্টির কারণে এ রোগ হতে পারে।
(পরবতীতে ধারাবাহিকভাবে দেখবেন ২য় পর্বে পরের অংশটুকু প্রকাশিত হবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৮