বোকারা আসলে সাহসী হয়। কোথায় ভয় পেতে হবে না বুঝলে সাহস দেখানোটা অবশ্য বাহাদুরির পর্যায়ে পড়ে না। তবুও, এ হিসেবে আমি বেশ সাহসীই ছিলাম! মৌচাকে ঢিল মেরে দুদ্দাড় ছুটে বেড়ানোদের দলের একজন। লাল ঝুঁটি কাকাতুয়ার কাছে লাল ফিতে আর আয়না চাইবার সময় কোথায়, মারুফের রোলার স্কেট জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে দুবাহু মেরে মাঝরাস্তা ধরে উড়ে বেড়ানোটা যে অনেক জরুরী ছিলো সে সময় গুলোয়! এরপরে সেই রাস্তায় কতো নতুন নুড়ি পাথরের আমদানি হয়েছে না জানি কতো গ্যালন ফুটন্ত পিচের সাথে! তাও রাস্তার ধুলো হাতে নিয়েও সেই ৭ বছরের আমার হাসিমুখ দেখতে পাওয়া যায় অনায়াসেই, চোখ বন্ধ করি বা না করি!
বিকেলের একটা সময় আছে না? যখন অদ্ভুত মায়াভরা নরম একটা আলোয় ঢাকা পড়ে চারপাশ? কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন আলো? পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবতে গেলে সব স্মৃতির ব্যাকগ্রাউন্ড লাইটিং যেন সে রকমের হয়, মায়াময়, সবরকম কর্কশতা ছাড়া! পরা বাস্তব অনুভূতি, বা সুগারকোটেড বাস্তবতা!
এখনকার আমি বেশ ভীতু। কোথায় কখন, কী নিয়ে ভয় পেতে হবে তার শিক্ষায় টাল আমার আজকাল মনে হয় সেই অশিক্ষিত সাহসী আমিই ভালো ছিলাম! নাহয় দুটো হাঁটুর একটার নুন ছাল নাইবা থাকলো, কপালে থাকলো দুয়েকটা টুব্লু! কী এসে যায়! হৃদয়টা তো আদিগন্ত বিস্তৃত ছিলো। অকারণ অহেতুক ভয় আর ভাল্লাগেনা!
সে যাকগে, নাহয় সেই আলোমাখা সময়টাতেই ফেরত যাই। স্মৃতির জানালা ধরে ছোট্ট একখানা উঁকি মারি! এক্কেবারে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড স্মৃতিচারণ! ফরোয়ার্ড মার্চ! থুড়ি ব্যাক ওয়ার্ড! হাসি
ঘুম ঘুম ভোর সাতটা, আম্মুর ঝাড়ি, উদাস মনে আধবোজা চোখ নিয়ে প্রকৃতির ওয়েক আপ কল ধরা! এরপরে রোজকার মারামারি-কাটাকাটি, উহু, রাজ্য নয়, রাজপুত্র নয় সামান্য একখানা ডিমপোচ নিয়ে! যুদ্ধে জয়ী মাতা এরপরে পরাজিত কন্যার চুলে বাঁধে দুই ঝুঁটি, টান টান চিরুনির আঁচড়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে আরামদায়ক ঘুমের শেষ রেশটুকুও। এরপরে ফ্যাকফ্যাকা সাদা শার্ট আর ভুশ ভুশে নীল স্কার্ট পরে বিরস বদনে হেঁটে যাই ঐ দেখা যায় আমার স্কুলে!
মিনিট পাঁচেকের হাটায় দৃশ্যপট বদলে যায়। রাস্তার এপিঠ আর ওপিঠের আড়ালে আমার বাসা আর ইশকুল! দুটোই সমান প্রিয়! গেট দিয়ে ঢুকেই তড়িঘড়ি ব্যাগ ক্লাসে রেখে অ্যাসেম্বলির লাইনে দাঁড়ানো, ছোট থেকে বড়, উচ্চতা অনুসারে ক্লাস আর সেকশন ভেদে! কম্প্যাক্ট সাইজের আমি থাকি লাইনের শুরুর মাঝেই, সামনে পিছনে হরহামেশা আদিবা, প্রমা, পিঙ্কি। বৃহস্পতিবারে অ্যাডেড যন্ত্রণা হিসেবে থাকে পিটি। সেদিন একমিনিট দেরী হলেই সব্বোনাশ! সুফিয়া টিচারের চিকন গলার তুমুল ধমকের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের একগাদা বদগুণ মিলিয়ে নেয়া! সে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড! হাতের নখ ঠিকমতো কেটেছি কী না, জামাকাপড় ধুয়ে, মাড় দিয়ে কড়কড়ে করে ইস্তিরি দিয়ে ঘষেছি কীনা, জুতোজোড়া চক দিয়ে আগাপাছতলা মেজে ধবধবে করেছি কী না, দুই-ঝুঁটির মাঝখান ধরে ঝুঁটির পুরুত্ব স্লাইড ক্যালিপার্স দিয়ে ঠিকঠাক মেপে তবেই মুক্তি! চেপে রাখা দম ঠিকঠাক ছেড়ে আমরা রওনা হই ক্লাসের উদ্দেশ্যে!
এই যাহ! তার আগের কথাতো বললামই না! জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া আর শপথ করা নিয়ে কী আর কম কাণ্ড হতো? যেদিন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে গাইবার পালা থাকতো সেদিন তুলির বদমায়েশি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসি চাপতে গান গাইতাম চোখ বুজে। আর ডান হাত সামনে ধরে, "আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব, স্বধর্মের প্রতিবিধান মানিয়া চলিবো... " ইত্যাদি বলতে বলতে কখন যে হাতটা উঠে সামনের জনের ঝুঁটির কাছে গিয়ে টানাটানি শুরু করতো তা কি আর আমি জানি? খাইছে আর একেকজন পেটে বেমক্কা গুঁতোর কথা আর নাই বললাম!
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমাদের সাথে ছেলেরা পড়তো। বেচারাগুলো! মেয়েদের স্কুলে ছেলে হয়ে পড়ার মানসিক যন্ত্রণার কথা বাদই দিলাম, এই এতো এতো মেয়েদের মাঝে একটা মেয়েও যে তাদের এলিজিবল বয় ফেরেন্ড ভাবতো না এই দুঃখেই একেকজনের চোখ ছলোছলো করতো বলাই বাহুল্য! আসলে তখন এই পেম-পিরিতি-বালুভাসার যুগ ছিলোনা! আমরা কত্তো নক্ষী ছিলাম! খাইছে
ছেলেদের সাথে মারামারিও যে হতো না তা নয়। পাড়ার মাস্তান হিসেবে আমারওতো কিছু দায়িত্ব ছিলো! সেটা অগ্রাহ্য করি কী ভাবে? মেয়েরা ছেলেদের চাইতে হ্যান-ত্যান কোনও এক কাজে কম পারদর্শী এই কথাটা মাটিতে পড়তে যেটুকু দেরী, তারপরেই ইয়া ভিশুমাইক! সত্যি সত্যি মাইর, নো ফাজলামি! আমি সিরিয়াস! খাইছে
এইযে, ঝামেলা শুরু হয়েছে। স্লুইস গেট উপচে স্মৃতির বান এই ডাকলো বলে! বারো বছর একই স্কুলে পড়ে আর যাই হোক, মাথার মেমরি কার্ডের স্লটে মেমরির কমতি নেই! এখন যখন সেগুলো হাতড়াতে বসলাম তখন ঝাঁকে ঝাঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো! এ বলে আমাকে দেখ তো আরেকজনে জামা ধরে টানে! যত্তোসব!
আচ্ছা একে একে আসি, দেখি কী কী মনে পড়ে... প্লে গ্রুপ, উহু, ফাইল ওপেন হচ্ছেনা! কেজি ওয়ান, টিফিন পিরিয়ডে টিনের দোচালা থেকে লাফ, কন্সট্রাকশন গ্রাউন্ডে ল্যান্ড ৪ ইঞ্চি লোহার শলাকে জুতা-মোজা সহ পায়ে গেঁথে, স্কুলের পিওনের আমাকে কোলে নিয়ে বাসায় দৌড়, অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়া ডাক্তারি পড়তে থাকা বড়মামার সাঁড়াশি দিয়ে সেই লোহা টেনে বের করা। পুরোটা সময়ে আমার সেই চিৎকারে এখনও কানে যে তালা লেগে যাচ্ছে! ক্লাস ওয়ান, বনানী ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ভাইয়া আর দোলায় সাথে চড়ুইভাতিতে কেরোসিন দিয়ে পোলাউ রেঁধে পরের দিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া! ক্লাস টু, তারেক আর দ্বীপ কে তুমুল প্রহার, ফলাফল-মেয়েদের গায়ে হাত তুলবেনা এই ভদ্রতা দেখানো দ্বীপের শার্টের ছেঁড়া পকেট আর তারেকের একগোছা চুলের সাথে মাটিতে পড়ে থাকা দুধদাঁত! ক্লাস থ্রি, ক্লাস জোকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া, জান্নাত মহল টিচারের পিছনেই তাকে নকল করে দেখানোর আস্পর্দা দেখানো! ক্লাস ফোর, ... ইয়ে মানে, ইয়ে মানে... আরে ধুর, এম্নে পুরান কথা মনে আসে নাকি? তার চেয়ে বরং আরেকটু সুলু যাই। হাসি
ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্মৃতিগুলোকে অবশ্য আর সাল আর ক্লাসের হিসেবে আনতে পারছিনা, শর্ট টাইম মেমোরি হলে যা হয় আর কী! কতোগুলো টুকরো ঘটনা মনে পড়ছে... তুলির পেন্সিল বক্স নিয়ে ঘর ঘর খেলা, জুলির সাঈদ আনোয়ার নিয়ে আর বাবলীর শহিদ আফ্রিদি নিয়ে ম্যানিয়া, ক্লাস ভর্তি মানুষজনের ব্র্যান্ডন জুলিয়ান দেখতে বেশী ভালো নাকি ড্যানিয়েল ভেটোরি এই নিয়ে ভোটাভুটি, বাংলাদেশের আইসিসি কাপ জেতার পরের দিন সকালে স্কুলের সবার উদ্দাম মিছিল, রঙ ছিটাছিটি! অ্যানিকে ম্যাবসের বোরহান স্যারকে নিয়ে সকাল সন্ধ্যা খেপানো, আহসান মঞ্জিল ভ্রমণ, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে প্রথমবারের মতো যাওয়া-এই একটা স্মৃতি কখনও ভুলতে পারা যাবে না! চারমাসের সেই বাচ্চাটার জামা, আর এক বীরাঙ্গনার লাশের ছবি দেখে চোখের পানি আটকানো যায় নি। এরপরের আগের কতো স্মৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এই মিছিল থামানো আজ মনে হয় অসম্ভব!
ক্লাস এইটে থাকতে প্রিয়াংকার বাবা মারা গেলেন, তার কিছুদিন পরে ফারীনের বাবা, তার অল্প কিছুদিন পরেই আবার লিসার বাবাও! আগে কখনও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে হয়নাই এভাবে! সেইই প্রথম! রূপার সাথে ঝগড়া, নাসরীনের প্রথম প্রেম, মাহিনের বয় ফ্রেন্ড বিষয়ক জটিলতা- প্রতিদিন নতুন দিন, নতুন নতুন সমস্যা! তখন মন আমার বাচ্চাদের মতো, মাথায় তিন গোয়েন্দা-কাকাবাবু-ফেলুদা-ব্যোমকেশ-কিকিরা-কিরীটী রায়, এদের দেয়া সমস্যার চাইতেও জটিলতর সমস্যা? বিগ ট্রাবল! ভেরি বিগ ট্রাবল ফর অ্যা লিটল গার্ল লাইক মি!
কুইজ, বিজ্ঞান মেলা এইসব নিয়ে সেইন্ট জোসেফের সাথে রেষারেষি, জিতলে উল্লাস, হারলে দুয়ো, সামান্য কারণে অনুভূতির চরম প্রকাশ ছিলো নিয়মিত! মাকে মনে হতো মরিয়াট্রির মতো ধুরন্ধর, ভাই ছিলো শুঁটকি টেরীর চাইতেও বিরক্তিকর, আর চাচা ছিলো মাইক্রফট হোমস-আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ! এনার কাছেই আমার আঁকাআঁকিতে হাতেখড়ি! এর মাঝে আমার দুটো নাম প্রচলিত ছিলো সবার মাঝে! "পাগলা দিশা"- অদ্ভুত সব প্রশ্ন আর উদ্ভট সব জবাবের জন্যে, আর "দিশাদিশ্চন্দ্র"- আজিব সব জিনিস্পাতি মিশায়ে ল্যাবে ভ্রুম-ভ্রাম-ধ্রুম-ধ্রাম শব্দের উৎপত্তিকারক বলে! খাইছে
প্রচণ্ড প্রশ্ন করতাম বলে ক্লাসে টিচাররা রেগে যেত মাঝে মাঝে, তবে এই কারণেই হয়তোবা আমি তাদের আদরও পেয়েছি অনেক বেশীই! দুষ্টামির কারণে সেই ছোট্টবেলার বিহারী স্কুলের আয়াও এখনও চেনে আমাকে, যার কানে ক'টা দুল এটা ছিলো একসময়ের হট টপিক! ইসলাম শিক্ষার ক্লাসে একবার বলেছিলাম এটা কেন আমাদের ফোর্থ সাবজেক্ট হয়না, পদার্থ বিজ্ঞানের ক্লাসে বাবার পুরনো বই ঘেঁটে আসতাম কামাল স্যারকে আটকে দেবার জন্যে, আর ক্লাসের শেষে ইংরেজির রাজ্জাক স্যারের সাথে চলতো আলোচনা-লর্ড অফ দ্যা রিংস নাকি হ্যারি পটার!
মনে আছে দিনা অ্যাসেম্বলির সময়ে ক্লাসে লুকিয়ে থেকে সবার উপাদেয় টিফিন খেয়ে ফেলতো রসিয়ে রসিয়ে! একবার আদিবার টিফিনের মুঠি কাবার খেয়ে শেষ করে তাতে ভরে রেখেছিলো সিফাতের আনা পেঁপের হালুয়া! খাইছে আরেকবার আমার সাথে বাজী ধরে ৩৯ জনের ক্লাসের ২৫ জনের টিফিন একা খেয়েছিলো মেয়েটা, অথচ চেহারা দেখলে ওকে মনে হতো কোনও দুর্ভিক্ষের দেশ হতে আগত কেউ! আমি বলতাম ওর পেটের সাথে ইন্টার গ্যালাক্টিক কানেকশন আছে, যা খায় পাচার হয়ে যায়! খাইছে
টিফিন পিরিয়ডে হঠাৎই একবার গানের কলি খেলবার ধুম পড়লো। ৩০০ পৃষ্ঠার একটা খাতা ভর্তি করে গানের প্রথম লাইন লিখেছিলাম, আজও মনে আছে! সেই থেকে এই খেলায় আমি এবং আমরা অপ্রতিরোধ্য! দীনেশ স্যারের কথাও মনে পড়ে প্রায়েই, উনার বাসায় কোচিং শেষে প্রত্যেকদিনই আমরা ১২ জন হাত পাততাম, "স্যার, খিদা লাগসে, টাকা দ্যান!" খাইছে একদিন টাকা নিয়ে মোহাম্মদপুর বাজারের হোটেলে সার দিয়ে বসে খেয়েছিলাম আমরা একডজন নচ্ছার দুষ্ট মেয়ে! হাসি এরপরে স্কুলেও শুরু হলো এই অত্যাচার! শেষদিকে স্যার আমাদের দেখলেই বাথরুমে লুকাতেন কোনওরকমে! খাইছে এরকম কতো শত স্মৃতি! আজকাল হঠাৎ খোমাখাতায় পুরনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে সেইসব স্মৃতির ঝালাই চলে! উড়ে বেড়ানোর দিনগুলি সবসময়েই যেন তাল মিছরির মতো, টু মাচ মিষ্টি, তাও খেতে ভালো! হাসি
ইশকুল জায়গাটাই আসলে আজব! যখন ছিলাম তখন সহ্য হতোনা আর এখন সেই ক্যাম্পাসের জন্যে কিরকম বিচ্ছিরি রকমের "প্যাটপুড়া!" হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় সেইই সকাল সাড়ে সাতটার অ্যাসেম্বলিতে গিয়ে হাজির হই, ডান হাত উঁচিয়ে সবার সাথে বলি, "আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে... ... ... "