১।
- "আসসালামু আলাইকুম"
- "ওয়ালাইকুম"
- "বড় ভাই, খুব জরুরী কিছু কথা ছিল, একটু বাইরে আসবেন কি?"
এর উত্তরে কি বলবেন তা খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন শহিদুল্লাহ কায়সার। ছেলেগুলো এই সময় কি চায় তার কাছে? এমনি বাইরের অবস্থা খুব খারাপ, পাঞ্জাবীরা ঢাকার প্রত্যেকটা অলিগলি প্রতিদিন সার্চ করে। এর মধ্যেই প্রতিদিন তিনি সুফিয়া কামালের বাড়িতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার আর মেডিসিন দিয়ে আসেন, পাঞ্জাবীরা টের পেলে নির্ঘাত মেরে ফেলবে, তবুও তিনি যান। মুক্তিসেনাদের সেবা করতে গিয়ে মরলেও আফসোস নেই। তাকে সবাই বলল, ভারতে চলে যেতে, কিন্তু ক্যানো যাবেন তিনি? এই দেশ ছেড়ে কোথাও গিয়ে ভিখারিদের মতন আশ্রয় নিবার প্রশ্নই উঠে না।
- "কি হল ভাই? খুব জরুরী দরকার, আসেন, আসেন"
- "আচ্ছা, তোমারা একটু দাড়াও, আমি আসছি"
পান্না কোথায় গেলো? এই মেয়েটা তাকে বিয়ে করার পর থেকে খুব কষ্টে আছে বলতে হবে। সারাদিন তিনি থাকেন কবির বাড়ি, মেয়েটা সারাদিন তাকে নিয়ে ভয় করে। তাদের একটা ছোট্ট পরীর মতন মেয়ে আছে, শমী। শমীটা কোথায় গেলো, পরীটাকে কেন যেন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে এখন।
-"পান্না, কোথায় তুমি, আমার একটু বাইরে যেতে হবে যে"
- "এই সন্ধ্যায় কোথায় আবার যাচ্ছ, বাইরের অবস্থা তো ভাল না"
- "এই তো এখনি আসছি, ছোট ভাইরা একটু কাজে ডাকছে। শমীটাকে একটু ডাক তো, কি করছে ও?"
-"পুতুল খেলছে বোধহয়। তোমার মেয়ে যা বাপ ন্যাওটা হয়েছে না, তুমি বাইরে গেলে সারাটাক্ষণ
বাবা বাবা বলে ঘ্যান ঘ্যান করে"
- "আহহা, এভাবে বলছ ক্যানো, আমার মেয়ে হচ্ছে সব চাইতে লক্ষ্মী মেয়ে। তাড়াতাড়ি ডাক ওকে, যেতে হবে আমার"
মায়ের ডাক শুনে শমী আসল। কায়সার পরীটাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে পরম মমতায় চুমো একে দিলেন। এরপর গায়ে চাদরটা জড়িয়ে বের হয়ে গেলেন, বাইরে যা শীত।
-"ভাই, আপনাকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে, গাড়িতে উঠুন।"
-""আমি আবার কোথায় যাব, যা বলার এখানেই বল, কি জরুরী দরকার?"
- "নাহ, এই মুনাফিক হিন্দুর বাচ্চাটা বেশি কথা বলতেসে, এইটারে একটু ঠাণ্ডা কর তো"
হঠাৎ মাথায় প্রবল আঘাতে আঁধার নেমে আসে শহিদুল্লাহ কায়সারের সামনে।
২।
মাথায় পেছনটায় প্রচণ্ড ব্যাথা। সামনে সব অন্ধকার। হাত পা কিছুই নাড়ানো যাচ্ছে না। চোখ, হাত, পা সবকিছুই বেধে ফেলেছে ওরা। কিন্তু ওরা এমন করল কেন? কি চায়? কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না কায়সার। হঠাৎ চারপাশে উর্দু কথা শুনতে পেলেন তিনি। নিশ্চয়ই পাঞ্জাবীরা এসেছে। তাকে টেনে হেঁচড়ে উঠানো হল। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে? তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে সোজা করে দাড় করিয়ে একটা খুঁটির সাথে বাধা হল।
-"কালেমা পাড় হিন্দুকা বাচ্চা, কালেমা পাড়"
হঠাৎ সবকিছু বোধগম্য হল তার কাছে। তাকে এখানে ছেলেগুলো ধরে এনে পাঞ্জাবীদের হাতে তুলে দিয়েছে। তার মৃত্যুর ডাক এসে গেছে, খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারলেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুভয়ের চাইতে বিস্ময় আর অবিশ্বাস দ্যাখা দিল কায়সারের মনে। এই ছেলেগুলো তাকে এভাবে মৃত্যুর মুখে এলে দিতে পারল কিভাবে? তারা কি বাঙ্গালী নয়? তারা কি মানুষ নয়?
তবে তিনি ছেলেদের উপর থেকে সকল রাগ ঝেড়ে ফেললেন। তিনি তো এইটাই চেয়েছিলেন। এদেশের মাটির বুকে চিরশান্তিতে ঘুমাতে। শমী আর পান্নার ব্যাপারে তেমন দুশ্চিন্তা লাগছে না তার। জহির আছে, সে ঠিকই সামলে রাখবে তাদের। তবে স্বাধীন বাংলায় ছোট্ট শমীকে নিয়ে একটু ঘুরতে পারলে মন্দ হত না। মেয়েটার মুখে আর বাবা ডাক শোনা গেল না, নিশ্বাস নেওয়া গেলো না স্বাধীন বাংলায়।
-"ফায়ার"
একটা বুলেট এসে বিঁধল ঠিক শহিদুল্লাহ কায়সারের কপালে। মাটির কোলে ঢলে পড়লেন এদেশের এক সূর্যসন্তান, এই মাটির পরম মমতামাখা স্পর্শে মৃত্যু হল তার। যে মাটির মুক্তির জন্য জীবন দিলেন তিনি, আর দুই দিন পরই মুক্তি হল সেই মাটি। কিন্তু আফসোস, এই মাটিতেই রয়ে গেলো সেই সকল হৃদয়হীন অমানুষগুলো, যারা এই মাটির সন্তান হয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল এই মাটির সাথে, মায়ের সাথে.........