
মেমরিস্টর [স্মৃতিধারক রোধ] প্রাক-কথনঃ
আপনার অফিসের বস ২৪ বছরের অভিজ্ঞ কোন রোবট - কিংবা আপনাকে ফাইল এগিয়ে দিচ্ছে আপনার ধাতব সহকারী … কল্পকাহিনীতে হরহামেশাই এসব দেখা গেলেও বাস্তবতা হল , আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্স এখনো খেলনার পর্যায়েই আছে । অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে এমন কিছু এখনো গবেষকদের কাছে মিথ বা সায়েন্স ফিকশান হয়েই আছে । তবে এ শতাব্দীর একটি আবিষ্কার এই গবেষনাতে নতুন আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে ।
১৯৭১ সাল । এদিকে বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ , ভূমিকম্প , টর্নেডো , মিলিটারি ক্যু সব মিলিয়ে ঝঞ্ঝা – বিক্ষুদ্ধ একটি বছর । এর মাঝে ক্যালিফোর্নিয়া বার্ক’লে ইউনিভার্সিটির Leon Chua [লিও চুয়া] তার পেপারে ভবিষ্যত বানী করলেন তড়িৎ ব্যাবস্থা [ Circuit system] এর নতুন এক সদস্য কে , নাম দিলেন মেমরিস্টর ।
চার্জ (Q) , তড়িৎ প্রবাহ (I) , বিভব (V) , চৌম্বক ফ্লাক্স (F)[এখানে ফ্লাক্স কে গ্রীক ফাই এর পরিবর্তে F দিয়ে প্রকাশ করা হল ] – এই চারটি হল সার্কিট ভেরিয়েবল । বিদ্যুত সম্পর্কিত যেকোন ব্যবস্থাকে এই চারটির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় । আমরা দৈনিন্দন জীবনে যত বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করি , সবগুলো এদের একটি বা একাধিকের ফাংশন হিসেবে কাজ করে । একটি তড়িৎ ব্যবস্থায় থাকতে পারে তিনটি উপাদানঃ রোধ (R) , আবেশক বা Inductor (L) , ধারক বা Capacitor (C) .
বিদ্যুৎ প্রবাহ ও বিভবের ফাংশান হল রোধ , বিভব ও চার্জের ফাংশান হল ধারক বা capacitor ; ফ্লাক্স ও বিদ্যুতের ফাংশান হল আবেশক বা Inductor .
R = V/I ; L = F / I ; C = Q / V ;
লিও চুয়া প্রথম করেন , এখানে চার্জ ও ফ্লাক্স কে সম্পর্কিত করে এমন কোন ফাংশান নেই ।

এজন্যে তিনি নতুন একটি ফাংশন বা সার্কিট উপাদান কল্পনা করেন , যা চার্জ ও ফ্লাক্স কে সম্পর্কিত করবে । এর নাম দিনি দিলেন মেমরিস্টর , M . এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও ধারনা দিলেন । তবে তা আক্ষরিক অর্থেই কাগজে ও কলমে অর্থ্যাৎ কেবলি গাণিতিক ভাবে ।
দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে ২০০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল HP ল্যাবে মেরিস্টর আবিষ্কার হল । দেখা গেল , এর বৈশিষ্ট প্রায় সবটুকুই মিলে যায় লিও চুয়ার ধারনার সাথে ।
**গাণিতিক বিশ্লেষনঃ
মেমরিস্টরকে বলা হয় , চার্জ নির্ভর ফ্লাক্স পরিবর্তনের হার । যদি M(q) মেমরিস্টেন্স (memeristance) হয় , তাহলে ,
M(q) = dF / dq . . . . . . . (1)
ফ্যারাডের ম্যাগনেটিক ইনডাকশন সূত্র থেকে আমরা জানি ,
V = dF / dt
(1) থেকে , M(q) = [ dF / dt ] / [dq / dt]
= V / I . . . . . . (2)
(2) থেকে বলা যায় , মেমরিস্টর বা মেমরি রেজিস্টান্স হল চার্জ নির্ভর রোধ ।
R(t)= V(t) / I (t) . . . . . . (3)
(2) ও (3) থেকে দেখা যাচ্ছে , যদি M[q(t)] ধ্রুব (constant) হয় তাহলে (2) ও (3) সমতুল্য । তখন (2) বিভব (voltage) ও তড়িৎ প্রবাহের (current) মাঝে সরলরৈখিক সম্পর্ক দেখাবে ।
কিন্তু q(t) সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল এবং একই সেজন্যে M[q(t)] । (2) কে লেখা যায় ,
V(t) = M[q(t)] * I(t) . . . . . . (4)
(4) থেকে বলা যায় , মেমরিস্টর ততক্ষন v ও I এর মাঝে linear সম্পর্ক দেখাবে যতক্ষন চার্জ পরিবর্তন হচ্ছে না ।
কিন্তু বিদ্যুত প্রবাহ শূন্য না হলে চার্জের একটি পরিবর্তন থাকবেই । [I = dq / dt] এটাকে সাধারন রোধের সাথে স্মৃতি-রোধের [memristor] এর পার্থক্য বলা যেতে পারে ।
AC (alternating current ) এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু ভিন্ন । মেমরিস্টরের একটি বৈশিষ্ট্য হল , একদিকে চার্জের প্রবাহ এর রোধ বৃদ্ধি করে আর বিপরীত দিকে প্রবাহ এর রোধকে কমিয়ে দেয় । ফলে এটা বলা যায় যে মেমরিস্টর চার্জের প্রবাহকে ‘মনে রাখে’ ।
(4) থেকে দেখি , যখন বিদ্যুত প্রবাহ থেমে যাচ্ছে , তখন M[q(t)] =ধ্রুব । এখান থেকেই একে মেমরী হিসেবে ব্যবহার করার প্রসংগ চলে আসে । কারন যখন পাওয়ার চলে যাচ্ছে , তখন মেমরিস্টর তার শেষ অবস্থা ধরে রাখে ।
মেমরিস্টরের সুবিধাঃ
১) খুব কম জায়গা দখল করে ।
২) একবার পাওয়ার চলে গেলে মেমরিস্টর তার আগের অবস্থা ধরে রাখে ।
৩) খুব কম জায়গাতে অনেক বেশি মেমরি তৈরি করা যায় ।
৪) এর তথ্য প্রবাহের গতি অনেক বেশি বলে RAM হিসবেও ব্যবহার করা যাবে ।
সম্ভবনাঃ
মেমরিস্টর কে কাজে লাগাতে পারলে , দ্রুত bootable , হাইস্পিড , উচ্চধারন ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব । বর্তমানে কম্পিউটার গুলোতে যে RAM ব্যবহার করা হয় , তাতে প্রতিবার কম্পিউটার অন করলে RAM এ নতুন করে লোড করতে হয় সিস্টেম কে । মেমরিস্টর যেহেতু আগের অবস্থা কে ধরে রাখতে পারে , তাই কম্পিউটার সরাসরি আগের অবস্থায় চলে যাবে । [আমাদের দেশে বিদ্যুতের যে অনস্থা , তাতে এই জিনিস এখনি প্রয়োজন !]
RAM ও Hard-Disk এর বিকল্পঃ
এখন কম্পিউটারে দুই ধরনের মেমরি ব্যবহার করা হয় । বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা কাজ করার জন্যে RAM এবং স্থায়ী সংগ্রহে জন্যে হার্ড-ডিস্ক । কোন কাজ করার জন্যে hard-disk থেকে প্রথমে RAM এ আসে অস্থায়ী ভাবে , এর পরে প্রগ্রাম অনুযায়ী কাজ হয় । হার্ড-ডিস্কে তথ্য আদান প্রদান করার কাজটা পর্যাপ্ত দ্রুততার সাথে করা যায় না , অন্যদিকে RAM এর মেমরি যথেষ্ট বেশি নয় – এই দুইটি কারনে দুই ধরনের মেমরি প্রয়োজন হয় ।
মেমরিস্টর এই দুইটিকেই প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম । মেমরিস্টর ব্যবহার করে উচ্চ-ঘনত্বের মেমরি তৈরি করা সম্ভব , যার তথ্য প্রবাহের গতি অনেক বেশি । উদাহরন হিসেবে বলা যায় , একক বর্গ সেন্টিমিটারে মেমরিস্টরের ব্যবহারে ১০০GB মেমরি তৈরি করা যায়, যা সর্বশেষ আবিষ্কৃত ফ্লাশ ড্রাইভে 32 GB মাত্র । অচিরেই আমরা কেবল এক ধরনের মেমরির কম্পিউটার দেখতে পাব বলে আশ করা যায় ।
Artificial Intelligence:
মেমরিস্টর আবিষ্কারের ফলে মানব মস্তিষ্কের অনুরূপ কিছু তৈরি করা সম্ভব বলেই গবেষকরা আশা করছেন । বর্তমানে অনেক বড় আর অসম্ভব রকমের প্রোসেসিং পাওয়ার ব্যবহার করে কোডিং বা প্রোগ্রামিং করে যতটুকু অগ্রগতি এসেছে , তা আসলে মানব মস্তিষ্কের অতি নগন্য অংশ মাত্র । আসলে সিমুলেশন প্রোগ্রাম করে মস্তিষ্কের মত কিছু তৈরি করা এখন পর্যন্ত সায়েন্স ফিকশান হয়েই আছে ।
হার্ডওয়্যার-ও যদি সাহায্য করে তবে এই ক্ষেত্রে জটিলতা কমে আসবে । এখানেই আবারো মেমরিস্টর পালন করতে পারে গুরূত্বপূর্ন ভূমিকা । কারন সেই অতীতকে মনে রাখার ক্ষমতা । মেমরিস্টরের ব্যবহার তাই হয়ত কল্পকাহিনী গুলোকে অচিরেই বাস্তবতার পর্যায়ে নিয়ে আসবে ।
অন্যান্যঃ
Signal Processing , Neural Network , Programming Logic , Control System – এসব ক্ষেত্রে মেমরিস্টর ব্যবহার করে এর মাঝেই কিছু পেটেন্ট নেওয়া হয়ে গেছে । আশা করা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এই খাত গুলো আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে ।
শেষের কথাঃ
মেমরিস্টরের ধারনা এবং ব্যবহার এখনো শিশুকাল অতিক্রম করেনি । এখনো প্রচুর গবেষনা বাকি । মেমরিস্টর নিয়ে এখনো তেমন সার্কিট ডিজাইন হয় নি , মডেল তৈরি হয় নি । বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় টুলস এখনো তৈরি হয় নি । তবে বিজ্ঞানের এই যুগে এসব সমস্যা মেমরিস্টরের বিশ্ব জয়ে তেমন কোন বাধা হয়ে না দাড়ানোর ই কথা । সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন মেমরিস্টরের সফল ব্যবহারে গুরূত্বপূর্ণ কাজে সিদ্ধান্ত দিবে কম্পিউটার , নিজের ভুল শুধরে নিবে নিজেই , কাজে লাগাবে অভিজ্ঞতাকে । আমরা পাব instant-bootable হাই-স্পীড কম্পিউটার ; যা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে আমাদের সহকারী । আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম ।
[
নতুন আবিষ্কার কে সহজ ভাবে উপস্থাপনা করাটাই এই লেখাটির উদ্দেশ্য । সেজন্যে কেবল মূল ধারনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ।
এই লেখাটি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক ম্যাগাজিনের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল । কিন্তু আমরা ম্যাগাজিনটি প্রকাশ করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত । মেমরিস্টর সম্পর্কে পোস্টে দেওয়া কোন তথ্য যদি আপডেট হয়ে থাকে তাহলে জানাবার জন্যে বিনীত অনুরোধ করা হচ্ছে । ]
সূত্রঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Memristor এবং IEEE অফিসিয়াল সাইট