"দেরী হয়ে যাচ্ছে.......... জামারাহ পাব কিনা কে জানে?" অনেকটা আর্তচিৎকারের মত কথাগুলো বের হল আমার গলা থেকে।
শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে পাহাড়ী রাস্তার উপরে যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে উঠার চেষ্টা করছি। ক্লান্ত বিপর্যস্ত শরীর যেন তাতে সায় দিচ্ছে না।
তবুও পরিশ্রম সার্থক। গোধুলির আগেই জামারাতে পৌছে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। এবার পাথর মারার পালা। সবচেয়ে সুষম পাথরগুলো বেছে বেছে আলাদা করে নেই। এক .. দুই .. তিন .. চার ... পাচ....ছয় ....সাত। থেমে যাই তারপরে। এগিয়ে যাই পরের জামারাতের দিকে।
কি চমৎকার প্রশান্তিময় অনুভব!
এত চমৎকার মুহুর্ত কি আর কখনও আমি পেয়েছি! ভবিষ্যতেও বা কি পাব!
জীবনের প্রথম প্রেম কিংবা মাতৃত্ব যেমন জলছবির মত মনে সেটে থাকে, প্রথম হজ্জও তেমনি আপন মহিমায় চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নেয়।
হায়। কেন এই তুলনাটা মাথায় এল? এতো সঠিক তুলনা নয়।
প্রথম প্রেম শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকে।
কিন্তু প্রথম হজ্জ শুধু স্মৃতিই নয়, হৃদয়ের আলোও বটে। যে স্মৃতি আমি ধরে রেখেছি হৃদয়ের মাঝে......ভাবনার গভীরে........... তার পবিত্রতা যে অতুলনীয়।
এখনও ঘুম ভেংগে নির্বাক হয়ে বসে মদীনার সেই মসজিদের কথা ভাবতে থাকি।
কাজের ফাকে আনমনা হয়ে ভাবতে থাকি মিনার তাবুর কথা, আরাফাতের দিনের কথা।
ফ্ল্যাশ ব্যাক ...........ফ্ল্যাশ ব্যাক ......... ফ্ল্যাশব্যাক
আবারও স্মৃতির জাবর কাটি।
যেন সময়টাকে টেনে পেছনে নিয়ে যাই..............................।
যেভাবে শুরু হজ্জের পথে যাত্রা
আর দশজন মুসলমানের মতই হজ্জের প্রতীক্ষা আমার বহু দিনের বহু বছরের। গত সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে আমি ও আমার পরিবারের সবাই রওয়ানা দেই সৌদি আরবে মদীনার পথে। কত বছরের প্রতীক্ষার পরে হজ্জ পালনের সুযোগ পেলাম। সৌদী এয়ারলাইনস এর যে ফ্লাইটে মদীনায় যাচ্ছি, তা একটি হজ্জ ফ্লাইট। শুধু হজ যাত্রীদেরকেই বহন করে। এদিকে প্লেন ভ্রমনে পড়ার জন্য হজ্জের উপর বইগুলো নিয়ে এসেছিলাম। হজ্জের আগে নানান ব্যস্ততায় সেভাবে হজ্জের নিয়ম কানুন দোয়া দরুদগুলো দেখা হয় নি। এবার প্লেনে মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলাম। ভ্রমনের ক্লান্তি দূর করতে চাইলাম নিজেকে অধ্যয়নে ব্যস্ত রেখে।
মদীনা যখন পৌছি, তখন পড়তি সকাল। আমাদের হজ গ্রুপের সবাই বাসে চড়ে চলে আসি হোটেলে। বিশ্রাম শেষে শুরু করলাম মদীনার মসজিদে নববীর দিকে যাত্রা। এত চমৎকার এই মসজিদটি!! চমৎকার এক ধরনের ছাতা পুরো মসজিদটিতে রয়েছে। এই ছাতাগুলো দুপুর বেলায় স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে যায় মুসুল্লিদের ছায়া দিতে। আর বিকেলে কিংবা রাতে বন্ধ হয়ে থাকে। এত বিশাল আয়তনের মসজিদ তবুও লোকে লোকারন্য। মসজিদের বাইরেও কয়েক কাতার নামাজ হয়ে থাকে।
মসজিদে নববীর যে বিষয়গুলো আমার সবচেয়ে বেশী ভাল লেগেছে তা হল, নামাজ কিংবা খুতবায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করা। আমাদের আমেরিকাতে যখন খুতবা শুরু হয় তা সাধারত হয় বেশ দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু মসজিদে নববীতে তা ততক্ষন ধরে হয় না। ছোট কিন্তু হৃদয়গ্রাহী। আরো একটি বিষয় চমৎকার লাগল। তা হল, আজানের সাথে সাথে সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া।
মদীনার মূল আকর্ষন রাসুল (সা) এর রওজা মোবারক। রাসুল (সা) এর কবর ও তার দু পাশে আবু বকর এবং উমর (রা) এর কবর। আমার মেয়েকে পাঠালাম রওজা মোবারক জিয়ারতে। বললাম,
"প্রথমে নিজে রাসুল (সা)কে সালাম দিবি। তারপর আমার পক্ষ থেকে সালাম জানাবি। পরবর্তীতে বলবি, হে রাসুল নিশ্চয়ই আপনি উম্মার কাছে দাওয়াত পৌছিয়ে আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন।"
ভীড়ের কারনে বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হবার পরে রওজা মোবারক জিয়ারতের সৌভাগ্য অবশেষে তার হল।
মদীনার শহরটি জুড়ে রয়েছে রাসুল(সা) এর অসংখ্য অসংখ্য স্মৃতি। ১৪০০ বছর আগের সেই সময়গুলো মদীনাতে প্রানবন্ত দলীল হয়ে রয়েছে। সেই মসজিদে কুবা কিংবা কিবলাতাইন মনে করিয়ে দেয় সাহাবাদের নিঃশর্ত আনুগত্যের কথা। মসজিদে কুবা হল সর্ব প্রথম মসজিদ। আর কিবলাতাইন মসজিদটি দুই কিবলার মসজিদ। মুসলিমরা প্রথম দিকে আকসাকে কিবলা করে নামাজ পড়ত। তো নামাজের মাঝে নাজিল হয় নীচের কেবলা পরিবর্তনের আয়াতটি।
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর।
(সুরা বাকারা ১৪৪)
নাজিল হবার সাথে সাথে রাসুল (সা) কিবলা ঠিক করে নেন কাবার দিকে। সেজন্যে এটি হল দুই কিবলার মসজিদ।
মদীনার আকর্ষন বড়ই তীব্র। এই তীব্র আকর্ষনে যারা বিদ্ধ হয়েছিলেন তাদের একজন অটোম্যান কমান্ডার ওমর ফরিদ পাশা । যিনি ইতিহাসে "ডিফেন্ডার অব মদীনা" নামে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি মদীনা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে তুরষ্কের খলিফা তাকে আরব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলেও তিনি তা অমান্য করেন। নিজের সেনাদলকে নির্দেশ দেন ফরিং খেয়ে বেচে থাকতে তবুও সারেন্ডার না করতে। মসজিদে নববীতে দাড়িয়ে বলেছিলেন, "হে রাসুল। আমি আপনাকে ছেড়ে কখনই যাব না।" কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি শেষতক রাখতে পারেন নি। ৭২ দিন অবরোধের পরে তিনি ধরা পড়ে যান আরবদের হাতে। পরাজিত এই সেনানায়ক ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন মদীনায় এই অনমনীয় যুদ্ধের কারনে।
মদীনার আরো একটি দর্শনীয় স্থান হল ওহুদ পাহাড় এবং হামজা (রা) এর কবর। ওহুদ পাহাড় মদীনাকে ঘিরে রয়েছে। আমরা সেখানে হামজা(রা)র কবরের কাছে গিয়ে দোয়া পড়লাম। যেন ফিরে গেলাম সেই ১৪০০ বছর আগের দিন গুলোতে।
নববীর নামাজ আর দর্শনীয় স্থান ভ্রমনের এই ব্যস্ততার মাঝেই ফুরিয়ে গেল মদীনার মেয়াদ। এরপরে মক্কায় যাবার পালা। আমরা মদীনা থেকে রওনা হলাম মক্কার দিকে।
পরবর্তী পর্বে মক্কার কথাগুলো বলতে চাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৫৮