কয়েকটি পর্বের এই সিরিজের লেখাটিতে আমি ইবনে রুশদের দর্শন, জীবন ধারা ও চিন্তাধারার পরিচিতি দেবার চেষ্টা করছি। এই প্রথম পর্বটি গল্পের আকারে লেখা, যা কিছুটা কল্পনা মিশ্রিত। পরের পর্বগুলো হবে তথ্যমূলক নিবন্ধ। সিরিজটির সাথে থাকার আমন্ত্রন রইল, তথ্য বা মন্তব্য দিয়ে সহায়তা করার ধন্যবাদ রইল।]
=============================================
এক.
খলিফা ইয়াকুবের দরবার। জ্ঞানী গুনী পরিবেষ্টিত খলিফা আজ বেশ চিন্তিত। চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। তার উজিরদের মাঝে শুরু হয়েছে গুন্জ্ঞন। অবশেষে একজন শুরু করলেন:
"আমিরুল মুমিনীন। আমায় ক্ষমা করবেন। আপনাকে আজ বেশ পেরেশান মনে হচ্ছে।"
"ঠিকই ধরেছ ইবনে তুফায়েল। আমি আজ কিছুটা বিভ্রান্ত।"
"বেয়াদবী না নিলে জানতে পারি এর কারন?"
"ভাবছিলাম এরিস্ততলের বইগুলোর কথা। কি কঠিন, জটিল। সাধারনের বোধগম্যের বাইরে। কেউ যদি এর সারবত্তাটুকু সাধারনের জন্য সহজ ভাষায় লিখে দিত তবে তা আমজনতার জন্য কতই না কল্যানকর হত। তুফায়েল, সেরকম কারো সম্পর্কে তুমি কি কিছু জান?" খলিফা তার উজির তুফায়েলের দিকে চাইলেন।
"আমিরুল মুমিনিন। আমি আপনার উজির, আমার কাজ আপনাকে পরামর্শ দেয়া। সেরকম মানুষ একজনই আছেন এই আন্দালুসিয়াতে।" থামলেন ইবনে তুফায়েল।
"আছে সেরকম কেউ? অথচ আমি জানি না। কে তিনি আবু বকর?" উদ্বিগ্ন হয়ে খলিফা জানতে চান।
"তিনি অপরিচিত কেউ নন। স্বনামধন্য কাজী আবুল কাসিমের পুত্র। তার নাম আবু ওয়ালিদ।"
"আবুল কাসিম? যিনি মোরাবিতদের বিচারক ছিলেন?"
"জ্বি তিনিই।" ইবনে তুফাইল জানালেন।
"ঠিক আছে। তাকে আমার সাথে দেখা করতে বল।"
"তিনি এই দরবারেই আজ হাজির রয়েছেন, আমিরুল মুমিনিন। আপনি চাইলে তিনি আপনার সাথে একান্তে আলাপ করতে পারেন।" ইবনে তুফাইল ইংগিত করলেন নূতন আগন্তুকের দিকে। দরবারের তখন মনোযোগ সে আগন্তুকের প্রতি।
খলিফা দৃষ্টি দিলেন আগন্তুকের দিকে। একটু থেমে আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, "দার্শনিকরা এ বিশ্বের সৃষ্টির বিষয়ে কি বলে? তা কি শ্বাশত, নাকি সময়ের শুরুতে তৈরী করা।"
আগন্তুক বুঝতে পারলেন প্রশ্নটা তাকে উদ্দেশ্য করে করা। খুব খুশী বলে মনে হল না। তিনি জানেন এসব বিষয় আমজনতার মাঝে কতটা বিতর্ক তৈরী করেছে। আমতা আমতা করে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল। খলিফা ফিরলেন ইবনে তুফায়েলের দিকে।
"দেখো তুফায়েল। প্লেতো কিন্তু আরিস্ততলের ঠিক উল্টোটা বলেছেন। আরিস্ততল যেখানে বিশ্বকে অনাদি দাবী করেছেন, প্লেতো দাবী করেছেন তা সৃষ্ট।" আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কি কিছু জানেন?"
আগন্তুকের দ্বিধা কাটতে শুরু করল। খলীফাকে একজন সত্যিকারের সমঝদার বলে মনে হল তার। মহাবিশ্ব নিয়ে দার্শনিকদের এসব ধ্যান ধারনার সাথে আগন্তুক খুব ভালভাবেই পরিচিত। অনেকটা নির্ভয়ে শুরু করলেন আলোচনা। ধীরে ধীরে খুলতে লাগলেন দর্শনের নানা জট। নিবিষ্ট শ্রোতার ভূমিকায় খলীফা শুনতে লাগলেন।
খুশী হলেন খলীফা। "তুফায়েল আপনার বিষয়ে ঠিকই বলেছে। আপনার পক্ষেই আরিস্ততলের সারাংশ লেখা সম্ভব। আর প্লাতোর রিপাবলিকের মুখবন্ধ আপনি লিখুন, তাও আমি চাই। এ গুরু দায় আপনাকেই দেয়া হল। এছাড়া সেভিলে কাজীর পদ অলংকৃত করবেন। বংশ পরষ্পরার এ ধারায় আপনিই তার যোগ্য উত্তরসূরী। বংশ পরষ্পরায় মোরাবিতদের বিশ্বস্ত ছিলেন বলে ভাববেন না আমি আপনার উপর বীত শ্রদ্ধ। আপনি আপনার পেশাগত দায়িত্ব সম্পূর্ন স্বাধীন ভাবে পালন করবেন।" খলিফার আচরন আশ্বস্ত করল আগন্তুককে।
আগন্তুকের আশংকা কেটে গেল। উৎফুল্ল চিত্তে তিনি খলীফার দরবার ত্যাগ করলেন।
দুই.
পয়ত্রিশ বছর পরের কথা।
সেদিনের সেই আগন্তুক আজ বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ, যার জীবনী শক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। স্মৃতিচারনে তিনি ভুলে যেতে চান তিক্তময় অতীত, তবু তা দুঃসহ যন্ত্রনা হয়ে বার বার বুকে আঘাত করে। ভেবেছিলেন ইসালার নির্বাসন থেকে ফিরে এসে হয়তবা মর্ম বেদনা কম হবে। কিন্তু তিল তিল করে গড়ে তোলা বইগুলো যে তার জীবনের আরেক পিঠ, সে ধ্বংসের বেদনা এই মৃত্যু প্রহরের বেদনার চেয়েও অন্তর্ঘাতী।
আপনি কাফের .............। মুসলমানের বাচ্চা এসব করতে পারে না, মুসলমান ভাবতে পারে না, লিখতে পারেনা .................। চাবুকের মত বাক্যগুলো বৃদ্ধকে আবারো আঘাত হানে। সব কি ভুলে যাওয়া যায়। কল্পনায় ভেসে উঠে সেই সালিশ ........। যে মানুষটি নিজেই সারা জীবন বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন, জীবনের শেষ আদালতে কিনা তারই বিচার হয়েছে....। ভাগ্যের কি পরিহাস। জীবনের ফোটা ফোটা ঘাম ঝরানো অতন্দ্র প্রহরের সাধনার সব লিপির আগুন পড়া ছাই মনের ভেতর আবার আগুন হয়ে দাউ দাউ জ্বলে। একটা জীবনের সাধনা ......। কতই না মূল্যহীন .............।
স্বপ্নের কর্ডোভাতে হাজারো মানুষের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে খলীফা তাকে একদিন সম্মানের সাথে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন, সেই তিনিই কিছু উন্মত্ত অন্ধ মানুষের কাছে আত্ম সমর্পন করতে দ্বিধা করলেন না। হায়রে রাজনীতি .......। যে দর্শন ছিল গর্ব অহংকারের বিষয়, তাই শেষে হয়ে গেল গলার কাটা।
জিহাদ শেষ হয়েছে। রক্ষনশীলদের প্রয়োজন খলীফার কাছে ফুরিয়েছে ...। মনে হয়েছে সেই নির্বাসিত বৃদ্ধ দার্শনিকের কথা। হয়ত বা কিছুটা অনুতপ্তও............... নির্বাসন দন্ড স্থগিত করে আবার তাই ফিরিয়ে আনা হয়েছে মারাকেশে। সমাজে তার মুসলমানিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ নেই। হারানো সম্মান আবার তার আপন ঠিকানা খুজে পেয়েছে।
তবুও শুধু হাহাকার। বিষন্নতা তার পিছু ছাড়ে না। হঠাৎ পড়ার ঘরটায় ঢুকলে যেন রাশি রাশি বই চোখে পড়ে। আবারো নেচে উঠে মন প্রান। ঐ তো তার সব লেখা বই......, নিজের হাতে লেখা......... দিনের পর দিন বছরের পর বছরের সাধনা। কিছুই নষ্ট হয় নি। সব অকৃত্রিম রয়েছে।
না কোথায়। হতাশ হন তিনি। সব ভুল, চোখের ধাধা। সে সব বই যে সব ছাই হয়ে গিয়েছে। বুক শেলফটা রয়েছে ঠিকই। নেই তাতে প্রান।
দূরে মসজিদের প্রাঙ্গন থেকে ভেসে আসে আজান। ভগ্ন প্রান বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নামাজে দন্ডায়মান হবার প্রস্তুতি নেয়। দখিনের এক ঝাপটা বাতাস তাকে এলোমেলো করে দিয়ে যায়। সে বাতাসে যেন তিনি ফিসফিস শুনতে পান, "হতাশ হবে না। তোমার সব সম্পদ এই পৃথিবীতেই রয়েছে। পৃথিবী একদিন সে গুপ্তধন খুজে নেবেই।"
============================================
http://www.renaissance.com.pk/jagletf98.html
Click This Link