[সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি বিভাগে ভর্তির বিভিন্ন শর্ত আরোপের মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হল সেসব বিভাগের প্রবেশ দুয়ার। আমার এই লেখাটি মূলত এই প্রসংগ নিয়ে। তবে সে আলোচনায় যাবার আগে কিছু পূর্বকথা বলাটা প্রয়োজনীয় হোম ওয়ার্ক বলে মনে করছি।]
বাংলাদেশে মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতি নাক উচু প্রগতিশীলদের বৈরী মনোভাব নূতন কিছু নয়, বরং প্রথাগত। যতই মেধার পরিচয় দিক না কেন, তাদের দৌড় মাদ্রাসা পর্যন্তই - এই বিদ্রুপাত্মক মনোভাব পোষন করে থাকেন আমাদের প্রগতিশীল গ্রুপ। এটা অবশ্যই সত্য যে, প্রগতিশীলদের সাথে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীসহ অন্যান্য ধর্মীয় গ্রুপগুলোর বিদ্বেষ বিনা কারনে কিংবা একদিনে তৈরী হয় নি। বিশ্বাস ও অনুভূতির পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে আজকের এই পারস্পরিক মুখোমুখি অবস্থান। নিউটনের সূত্র "এভরি একশন হ্যাজ এন অপোজিট রিএকশন" ফর্মূলায় বিদ্বেষ যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রগতিশীলদের অভিযোগ, তাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চায় অন্যায় অযৌক্তিক বাধা হয়ে দাড়িয়েছে স্বল্প বুদ্ধির মধ্যযুগীয় মানসিকতার এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা দাবী করে আসছে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতিশীলদের সুস্পষ্ট অবজ্ঞাকে - মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল নন। যার ফলে ঘুনে ধরা বিশ্বাস নিয়ে দুই পক্ষ রয়েছে একটা কঠোর মুখোমুখি অবস্থানে। আরো হতাশাব্যন্জ্ঞক হল, কোন পক্ষই এখন পর্যন্ত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেন নি সম্পর্কের এই বরফ গলানোর জন্য। বিশেষত প্রগতিশীল গ্রুপ এদের কোন ছাড় দিতে একবারে প্রস্তুত নন, বরং সম্পূর্ন প্রতিহত করার পক্ষপাতী। যুদ্ধ ঘোষনার যে আহ্বান তাতেও ধ্বনিত হয় একই সুর, "আমাদের যুদ্ধ এমন এক গোষ্ঠীর সাথে ওরা বোঝে না ফুল কি, সংস্কৃতি কি, গান কি, কবিতা কি"। তবে সে যুদ্ধে কোন পক্ষই যে পুরো সফল হতে পারেন নি, তা নির্বাচন সহ অনেক ইস্যুতে ইতিমধ্যেই প্রমানিত।
মাদ্রাসর বিরোধীরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে এই শিক্ষাকে কলুষিত করতে। এই বিরোধিতা যত না পাশ্চাত্য থেকে এসেছে, তার চেয়ে বেশী এসেছে মুসলিম দেশ থেকে। মাদ্রাসাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয় সন্ত্রাসবাদের সাথে। জংগিবাদসহ আরো অনেক অপরাধের সাথে। দাবী করা হয় বাংলাদেশ সহ মুসলিম দেশগুলোতে হাজারে বিজারে গড়ে উঠা মাদ্রাসাই নাকি জংগীবাদের মূল কারন। অথচ এর কোনটিই প্রমানিত সত্য নয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সেই বিখ্যাত আর্টিক্যাল "দ্য মাদ্রাসা মিথ" (Click This Link) লেখায় সুস্পষ্ট ভাবে দাবী করা হয়, মাদ্রাসা নয় বরং সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যেই রয়েছে বেশী সন্ত্রাসী। (We examined the educational backgrounds of 75 terrorists behind some of the most significant recent terrorist attacks against Westerners. We found that a majority of them are college-educated, often in technical subjects like engineering)। মাদ্রাসা শিক্ষাকে জংগিবাদের কোন হুমকি নয় বলে দাবী করা হয়। জলন্ত আগুনে যেন পড়ে পানি। আর কোন ভাষা থাকে না মাদ্রাসা বিরোধীদের।
এই সব ইতিহাস কারো অজানা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এমন কিছু শর্ত দেয়া হল যার ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা অনেকগুলো বিভাগে আবেদন করার যোগ্যতা হারাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বিভাগ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বন্ধ সংক্রান্ত সংবাদটি পড়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে এসেছে তা হল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শর্তারোপ কি সে চিরায়ত মাদ্রাসা বিরোধী মনোভাবের বহিপ্রকাশ মাত্র? মাদ্রাসা বিরোধী এই সর্বশেষ পদক্ষেপ কি অতি পরিচিত সে ধারাকেই অনুসরন করেছে?
এই প্রশ্ন আরো বদ্ধমূল হয় যখন পত্রিকায় প্রাক্তন ভিসি মনিরুজ্জামান মিয়ার বক্তব্য পড়ি : ৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের অপব্যাখা করা হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ঠেকানোর জন্যে। আমি যখন ভর্তি বন্ধের সংবাদটি পত্রিকায় পড়ছিলাম তখনই কেন যেন আমার মনে পড়ে যায় আয়েন্দেসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নেতাদের অনুসৃত নীতির কথা। এসব সমাজতান্ত্রিক দেশে মাঝারী মানের কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিকশিত হতে পারে না কারন সরকারের বেধে দেয়া হাজারোটা শিকলসম নীতিমালার কারনে। যার ফলে উঠে দাড়াতে পারে না কোন ব্যবসা শিল্প, বিকশিত হতে পারে না পুজির পথ। আমেরিকা সহ মুক্ত বিশ্বের দেশগুলো যার সম্পূর্ন বিপরীত অবস্থান নিয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে এসব দেশ হয়ে উঠেছে মুক্ততার প্রতীক, অপার সম্ভাবনাময়। যোগ্যতা প্রমান করতে পারলে মুক্ত বিশ্বের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র এক গ্রেড টপকে সহসাই চলে যায় পরের গ্রেডে। যে কেউ যে কোন স্কুল থেকে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে যদি স্যাট বা অন্য স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট গুলোতে ভাল করতে পারে। পাবলিক, প্রাইভেট, হোম স্কুলিং - সবগুলোই স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা। এডমিশন টেস্ট থাকে না তবে শিক্ষা ব্যবস্থার এই বিচিত্রতা পরীক্ষিত হয় স্যাট বা সেরকম স্ট্যান্ডার্ড টেস্টের মাধ্যমে। যাকে বাংলাদেশের এডমিশন টেস্টের সাথে তুলনা করা যায়। মেধার বিকাশের সবরকম সহায়তা প্রদানে রাষ্ট্র যেন অংগীকারাব্দ্ধ।
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য কি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বন্ধ করা হল তা আরেকবার দেখা যাক। যুক্তি দেখানো হয়েছে সাধারন শিক্ষা থেকে আসা ছেলে মেয়েরা যেখানে ২০০ নম্বরের বাংলা, আর ২০০ নম্বরের ইংরেজী পড়ে আসে, সেখানে মাদ্রাসা ছাত্ররা ১০০ নম্বরের বাংলা এবং ১০০ নম্বরের ইংরেজী কোর্স পড়ে আসে। কিন্তু এসব যুক্তি কি ধোপে টেকে? এই প্রিরিকুইজিটের অর্থ কি? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন প্রি রিকুইজিট দেয়া হয়? প্রিরিকুইজিট দেয়ার কারন কি এই নয়, যে ছাত্ররা যাতে সফল ভাবে এই কোর্স কমপ্লিট করতে পারে?
আমার কথাই ধরা যাক। আমি যখন আমেরিকাতে একটি স্কুলে ভর্তি হই তখন একটি কোর্স নেই। পরে আমাদের পারফরম্যন্স দেখে সেই কোর্সে পরবর্তীদের জন্য প্রিরিকুইজিট আরোপ করা হয়। আমাদের যেহেতু সেই কোর্স বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল এবং টিচারকে যেহেতু অনেক ব্যাকগ্রাউন্ড বুঝাতে হচ্ছিল, সে কারনে পরবর্তীতে প্রিরিকুইজিট দেয়া হয় সিনিয়র লেভেলের একটি কোর্স। প্রিরিকুইজিট দেয়ার মানে এই নয় যে কেউ সেই কোর্স নিতে পারবে না বা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে না। প্রিরিকুইজিটের অর্থ আমাদের আগে সেসব কোর্স নিয়ে পরবর্তী কোর্সের প্রিপারেশন শেষ করতে হবে।
মাদ্রাসা ছাত্ররা এতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছে। তারা কি রকম পারফরম্যান্স করে আসছে তার উপর নির্ভর করে আদৌ শর্ত আরোপের কোন প্রয়োজন আছে কিনা। যে ইংরেজী নিয়ে এত কথা, মজার ব্যপার হল ২০০৬-২০০৭ শিক্ষাবর্ষে সেই ইংরেজীতে ৩০ পয়েন্টে ২৮.৫ পেয়ে "গ" তে ফার্স্ট এবং "খ"তে সেকেন্ড হয় আবদুল্লাহ আল আমীন নামে এক মাদ্রাসার ছাত্র। সুতরাং এখন পর্যন্ত এমন কোন যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না যাতে মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য শর্ত আরোপ করে বিশ্ব বিদ্যালয়ের দুয়ার বন্ধ করতে হবে।
আরো ব্যাখা করছি। আর্কিটেকচার এডমিশন টেস্ট যারা দিয়েছেন তারা জানেন কি পরিমান ড্রইং লাগে এডমিশন টেস্টের জন্য। এই বিভাগের পড়ার অন্যতম যোগ্যতা হল ড্রইং এ পারংগমতা। এডমিশন টেস্টের প্রশ্ন সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই করা হয়। অথচ একে পরীক্ষার শর্ত হিসেবে রাখা হয় নি। আমি ড্রইং এর কিছুই জানতাম না। অথচ আমিও টে্স্টে অংশ গ্রহনের যোগ্য ছিলাম। কিন্তু যেই বুঝতে পেরেছি এডমিশন টেস্টে গোল্লা ছাড়া কিছু কপালে নেই (ড্রইং জানি না বলে), অমনি আর পরীক্ষা দেই নি। সুতরাং যেখানে এডমিশন টেস্ট রয়েছে, সেখানে কেন নূতন করে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করতে হবে? মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য কিনা তা দেখার জন্য তো এডমিশন টেস্ট নামের ফিল্টার তো রয়েছেই। অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করা কি বৈষম্যের পর্যায়ে পড়ে না? অথচ বৈষম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলনীতির বিরোধী।
মাদ্রাসা শিক্ষা সরকার অনুমোদিত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেদের জন্য ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়, যেটি কিনা জনগনের অর্থে পরিচালিত, বন্ধ করে দেয়া শুধু অযৌক্তিক নয়, বরং অন্যায়ও বটে। সেই শুভ বুদ্ধির প্রত্যাশায় রইলাম।
সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৮:৪৯