শারীরিক যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যার কথা তেমন একটা শোনা যায়না, আত্মহত্যার মুখ্য কারণ গুলো মানসিক। শরীরের কষ্ট সহ্য করতে পারলেও মানব প্রজাতি কি মানসিক কষ্ট সহ্য করতে পারেনা?
শারীরিক সমস্যা ঔষধ খেয়ে ঠিক করে ফেলা যায়, কিন্তু মানসিক বিষয়াদি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। আবার শারীরিক সমস্যা গুলো সাধারণত দীর্ঘ দিন ভোগায় না, ভোগালেও একসময় মানুষ তার সাথে মানিয়ে চলতে শিখে যায়। কিন্তু মানসিক ব্যাপার গুলো অনেক পীড়া দেয়, মানুষ কখনোই এর সাথে মানিয়ে চলতে পারেনা, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যা গুলোর অন্যতম হল বিষাদগ্রস্ততা বা ডিপ্রেশন।
ইদানীং কিশোর কিশোরীদের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা যায় অনেক বেশি। এর শুরু টা হয় এভাবে, একটা ছেলে বা মেয়ে চিন্তা করতে শুরু করে, তার জীবন টা কি স্কুল কলেজ করেই শেষ হবে?
সকালে কলেজ, বিকালে কোচিং। ভালো রেসাল্ট করতে হবে, হেন ত্যান। শুরু হয় "আমার কিছু ভাল্লাগেনা" রোগ। এই একঘেয়ে জীবনে ছাত্রছাত্রী অতিষ্ঠ হয়ে জীবনের মানে খুজতে শুরু করে। তবে এটা মুখে স্বীকার করেনা, কেউ সচেতন ভাবে আর কেউ বা অচেতন ভাবে কিশোর বয়সে জীবনের মানে খুজে। কিন্তু অনেক ভেবেও উত্তর পায়না। ওফ জীবন এতো একঘেয়ে কেন?
তারা ভাবে মুক্তির পথ বুঝি ফেসবুক...কয়দিন চালানোর পর সেটা ভালো লাগেনা, হয়তো গীটার বা দামী ফোন...কিন্তু এসবও কয়দিন পর আর ভাল্লাগেনা। তাহলে হয়তো মুক্তির একমাত্র পথ প্রেম। এমন একজন থাকবে আমার, যে আমাকে বুঝতে পারবে, আমার এই ডিপ্রেশনে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। আমি তার বুকে মাথা রাখবো, বা সে আমার বুকে মাথা রাখবে...
কিন্তু তাতেও কাজ হয়... হয় চেহারা খারাপ হবার কারণে কাওকে পটাতেই পারেনা। নাহয় প্রেম করার পরেও মনের মিল হয়না, ৩ মাসে ব্রেকাপ হয়। তারা মুক্তি খুজে পায়না।
"ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে ভালোবাসা
মন দিয়ে মন পেতে চাহি। ওগো কেন,
ওগো কেন মিছে এ দুরাশা"
ফেসবুক, গীটার, মেয়ে বা ছেলে পটানো (তার সাথে যদি যুক্ত হয় খারাপ রেসাল্ট তাহলে গোদের উপর বিষফোড়া) এসব করেও কিশোর কিশোরী যখন শান্তি পায়না, আর যখন সে প্রায় মেনেই নেয় যে জীবন দুঃখের, আমি একা...তখন শুরু হয় ডিপ্রেশন। ছেলেদের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ারের চিন্তা যুক্ত হয়ে এই ডিপ্রেশন প্রকট আকার ধারণ করে। তখন শুরু হয় অসুস্থ মানসিকতার প্রতিযোগিতা। কেউ রাতের পর রাত একা কাদে, কেউ ভেতরে ভেতরে নিজের কষ্ট বুকে পুষেই আধমরা হয়ে যায়। কেউ দিনে ১৪ টা ফেসবুক পোস্ট দেয়, মনের কথাটা বলতে চায় কিন্তু পারেনা।
সে এই দুঃখের কথা তার বেস্ট ফ্রেন্ডকেও বলতে পারেনা। কি বলবে? কিছু বলার নাই বলেই তো ডিপ্রেশন, যা নাই তা কি করে বলবে? কারে বোঝাবে মনের দুঃখ? এসব মানসিকতা আস্তে আস্তে জন্ম দেয় বিকৃতির।
সাধারণ এক বিকৃতি হচ্ছে ব্লেড দিয়ে হাত কাটা। আমার এক বান্ধবী নিয়মিত হাত কাটেন, ধরে নিই তার নাম নিষ্প্রতিভা। আমি নিষ্প্রতিভাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি হাত কাটো কেন?
সে বলল,"আমি যখন অনেক মানসিক চাপে থাকি, তখন হাত কাটলে আমার মাথা থেকে টেনশন নেমে যায়"
তার এই কথা আমার গাজাখুরি মনে হয়েছে। কিন্তু আজ প্রত্যক্ষ করলাম পুরো সিস্টেম টা কীভাবে কাজ করে। ছবিটা আমার হাতের।
কলেজ থেকে আজ বাসায় ফেরার সময় মাথায় টেনশন ছিল, হঠাৎ কাচ ভেঙে হাতে ঢুকে গেল। এতক্ষণ আমার যে মস্তিষ্ক টেনশন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, এখন সে ব্যস্ত কেটে যাওয়া রক্তাক্ত হাত সামলাতে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, মস্তিষ্ক বার বার নার্ভে সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করল যে ক্ষতস্থানে অনুচক্রিকা পাঠাও, এর সাথে নার্ভ ব্যস্ত হয়ে গেল ক্ষত থেকে যন্ত্রণা বহন করে মস্তিষ্কে পৌছে দিতে। আরেকটি ব্যাপারও হচ্ছিলো।রক্তের রঙ খুব সুন্দর, টপ টপ করে সাদা টাইলসের উপর রক্ত পড়ছে এর মধ্যেও যে শৈল্পিক ব্যাপার আছে তা উপভোগ করতেও মস্তিষ্ক ব্যস্ত। পুরো ব্যাপারটায় মস্তিষ্ক এত ব্যস্ত যে টেনশন আর ডিপ্রেশন নিয়ে কাজ করার সময় নেই।
নিষ্প্রতিভা ঠিক এ বিষয় টাই কাজে লাগায় ডিপ্রেশন দূর করতে। যার চূড়ান্ত পরিণতি আত্মহত্যা।
এই যে পাঠক! এখানেই থামুন!!! আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি নিষ্প্রতিভা একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ্য ব্যক্তি। হাত কেটে ডিপ্রেশন দূর করলে জীবনেও দূর হবেনা, রক্ত পড়া বন্ধ হলেই ফিরে আসবে।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে ডিপ্রেশন কাটানোর উপায় কি? এর উত্তর আমি ১৪ বার দিলেও তুমি কানে তুলবেনা, যে কানে তোলার সে ডিপ্রেশনে পড়বেও না। তাও বলি, আবারো বলি। আলাদা মানুষ হও। নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলো। কখনো শাহাবাগ থেকে মিরপুর খালি পায়ে হেটে গিয়েছ? গিয়েই দেখনা...ডিপ্রেশন কই পালায়।
কখনো ফুলওয়ালা সেজে এক বালতি ফুল কিনে তালতলায় গিয়ে বিক্রি করেছ? করেই দেখ...কেমন লাগে ফুল বিক্রেতার জীবন!!
বিড়াল-কুকুর যে কথা বলতে পারে, সেটা জানো? মানুষ চাইলে কিন্তু তাদের সাথে মৌলিক আলাপ আলোচনা করতে পারে। বিড়াল দের সাথে কথা বলাও খুব মজার, একবার বলেই দেখ।
পৃথিবী অনেক বড়, আর জীবন মোটেও একঘেয়ে না। যদি একঘেয়ে মনে হয় সেটা তোমার সৃজনশীলতার অভাব। এই অভাবে তুমি নিত্য নতুনত্ব চোখে দেখতে পাওনা। রবীন্দ্রনাথ প্রেমের ডিপ্রেশন বিষয়ে বলেছিলেন, "ভালোবেসে সুখ নাহি..."
সেই রবীন্দ্রনাথই সমাধান দিয়েছেন গানের শেষ দিকের লাইনে,
" আপনি যে আছে আপনার কাছে,
নিখিল জগতে কী অভাব আছে।
আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ,
কোকিল-কূজিত কুঞ্জ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:০৩