মানবতার আবক্ষ মূর্তি, শান্তির দূত অংসান সুকি। তার পাশে আছে সমাজতান্ত্রিক শ্রেণিবৈষম্য হীন দুই দায়িত্ববান দেশ রাশিয়া ও চীন। তাদের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকুক,ততক্ষণে আমরা একটু রাখাইন রাজ্য ঘুরে আসি।
ইতিহাসে গণহত্যা নতুন কিছু না। গণহত্যা আগে হয়েছে, সামনেও হবে। আর গণহত্যা কোন জাতি-ধর্ম মানে না। বার্মার রোহিঙ্গা ইস্যুকেও হয়তো সেরকমই এক সাধারণ গণহত্যা বলা যেতো তবে এখানে দুটো অভিনব ঘটনা ঘটেছে যা ইতিহাস আগে কখনোই দেখে নি। প্রথমত অং সান সুকি আমাদের চোখে ছিলেন এক দেবীর মত। গণতন্ত্রের মূর্তি সুকি সারাবিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আর সর্বোচ্চ নোবেল কমিটি তাকে পুরস্কৃত করেছে। এমনকি আমাদের দেশের নেত্রীরাও তার সাফল্যকে কিছুটা হিংসার চোখেই দেখতেন। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, সেই শান্তির দেবী সুকির হাত আজ রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের রক্তে রক্তাক্ত। নায়ক হঠাৎ খলনায়ক হয়ে গেছেন। ইতিহাস আগে কখনো এমন আকস্মিক পরিবর্তন দেখেনি। সুকির জীবনীকার পিটার পপহ্যাম, নোবেল কমিটিও সুকির এই স্ববিরোধী আচরণে অবাক।
দ্বিতীয় চমৎকার ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশে। লক্ষ লক্ষ লোক প্রতিদিন বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, বাঙালির খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। বাঙালি নিজেও গরীব। তাদের ১০ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি। তবু আপত্তি নেই। সরকারী সাহায্য ছাড়াও বাঙালি সাধারণ জনগণ নিজেদের টাকা, খাবার, ঔষধপত্র যে যা পারছে সাহায্য পাঠাচ্ছে। এখানে কোন বিএনপি-আওয়ামীলীগ, হেফাযত-গণজারণ মঞ্চ নেই। আস্তিক-নাস্তিক প্রতিটি মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অসহায় রোহিঙ্গা দের পাশে দাড়াচ্ছে। এমন স্বতঃস্ফুর্ততা, এমন মানবিকতা ইতিহাস আগে কখনো দেখে নি। কথায় বলে বাঙালি সব ইস্যুতে নাকি দুই ভাগ হয়ে যায়, কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে মানবতার প্রশ্নে পুরো জাতি আজ একতাবদ্ধ।
১৯৭১ সালে আমরাও ১ কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তবে সেখানকার ত্রাতা রা আমাদের এমনি এমনি খাবার-আশ্রয় দেন নি। এতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানেই পাকিস্তানের মুখে ভারতের লাথি মারা। তাহলে ১ কোটি লোক কে আশ্রয় দিয়ে ভারত এই চমৎকার সু্যোগ পেতে চাইবে না কেন? এই এককালীন সুবিধা ছাড়াও আছে চিরকালীন সুবিধা। বাংলাদেশের দ্বীপ, সমুদ্রসীমা, পানি, মাছ, নদী দখল, সীমান্ত হত্যা এসব হল চিরস্থায়ী সুবিধা। তাই শরনার্থীদের আশ্রয় দেবার পেছনে মানবিকতাবোধ যতটা কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে রাজনৈতিক প্রতিশোধ স্পৃহা।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ আমরা ভুলে যাই নি। কয়েক লক্ষ ইরাকি দেশ ছেড়ে চলে যায় মিশরে, তুরস্কে। তাদের সীমান্ত পারি দিতে দেওয়া হয় নি। তাদের মরে যেতে দেওয়া হয় ইরাকে। যারা কৌশল করে অন্য দেশে গিয়েছে তাদেরকেও বেছে নিতে হয়েছে মানবেতর জীবন।
মহান দেশ যুক্তরাজ্য। সাড়ে তিনশত বছরের বেশি সময় তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের শোষণ শাসন করেছে। আর আজ সাম্প্রতিক সিরিয়া গৃহযুদ্ধে শরনার্থীরা তাদের দেশে জীবন বাচাতে চাইলে তারা "ব্রেক্সিট" সাইনবোর্ড হাতে নিয়েছে। কারণ বাইরের দেশের লোক তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করবে, এটা তাদের অপছন্দ
জার্মানি, গ্রীস সিরিয়ান শরনার্থীদের জায়গা দিলেও চলছে দমন পীড়ন। স্থানীয়রা শরনার্থীদের সেখানে মানুষ বলেই মনে করে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ এর নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে। এমনকি শুধু মুসলিম না, মন্দির আর গীর্জা থেকেও সাহায্য আসছে। বাংলাদেশের শিখ সম্প্রদায় ৫০ হাজার শরনার্থীর খাবারের ব্যবস্থা করেছে। যে বৌদ্ধ ধর্মের বার্মিজরা পৈশাচিক কাজ করছে সে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বাংলাদেশিরাই ত্রাণ পাঠাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। সামনের প্রবারণা উৎসবে তারা ফানুস উড়ানো বাতিল করে চলতি ত্রাণ কার্যক্রমের পাশাপাশি উৎসব আয়োজনের সব টাকাও রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে।
তবে দুঃখের কথা হল আমরা তাদের যতই আশ্রয় আর খাদ্য দেই তাতে কোন সমাধান আসবে না, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে তাদের দেশে। এবং তা করতে হবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে যেন মনে হচ্ছে রোহিঙ্গারা এদেশেই থেকে যাবে।
- মুসলিম রোহিঙ্গা দের এই দুর্দশা বিষয়ে মুসলিম দেশগুলোর সংঘ ওআইসি মায়ানমারকে খোলা চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে।
- সাচ্চা মুসলমানের দেশ পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত একেবারেই চুপ।
- ভারত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে রাজী না। সুপ্রিম কোর্ট কে তারা জানিয়েছে,"রোহিঙ্গাদের সাথে আইএস এর সম্পর্ক আছে। রোহিঙ্গা দের সাহয্য করলে ভারত জঙ্গী আক্রমনের শিকার হবে"।
- ইউওরোপিয়ান পার্লামেন্ট, পার্লামেন্টে বসেই বসেই সুকির ১৪ গুষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছেন।
- মায়ানমারের দুই অস্ত্র বিক্রেতা দেশ রাশিয়া ও চীন গণহত্যার পক্ষে স্থান নিয়েছে।
- যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পাশে থাকার মহামূল্যবান আশ্বাস দিয়েছে
- ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে পোপ ফ্রান্সিস ও দালাই লামা মায়ানমারকে খোলা চিঠি দিয়েছেন
- ইতালি, ফ্রান্স ও জি এইট গ্রুপের অন্যরা আপাতত ঝিমুচ্ছেন
- শুধু তুরস্ক রোহিঙ্গাদের ১০০ টন খাবার পাঠিয়েছে, তাতে অবশ্য বাংলাদেশের সংকটের কোন উত্তরণ হয় নি।
এদিকে নিউ ইয়র্কে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের ৭২ তম সাধারণ অধিবেশন। অং সান সুকি তাতে আসেন নি। কোন মুখ নিয়ে আসবেন? নরেন্দ্র মোদিও বুদ্ধিমান লোক, নিউ ইয়র্ক আসলে শেখ হাসিনা, ইইউ বা ট্রাম্প তাকে রোহিঙ্গা দের সাহায্য করতে বলবেন। কূটনীতি রক্ষা করতে তখন মোদিকে অনুরোধে ঢেকি গিলতে হবে, রোহিঙ্গাদের সাহয্য করতে হবে। তাই না আসাটাই যুক্তিযুক্ত। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শেষে শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেন। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ আসলে ট্রাম্প দায়সারা ভাবে আশ্বাস দেন তিনি বাংলাদেশের পক্ষে থাকবেন। কারণ মুখের উপর তো আর বলে দেওয়া যায় না যে, সাহায্য করবো না। যুক্তরাষ্ট্র যখন উত্তর কোরিয়া বিষয়ে চীনের শি জিনপিংকে নিয়ে ব্যস্ত তখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মেতে যুক্তরাষ্ট্র সময় নষ্ট করতে চায় না। সবশেষে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেছেন,"মায়ানমারে সহিংসতা বন্ধে সুকি কে শেষ সুযোগ দেওয়া হল।"
এই শেষ সুযোগ যে সুকি ও মায়ানমার সেনাবাহিনী ভ্রুক্ষেপও করবে না তা সবাই জানে। আন্তনিও গুতেরেস নিজেও জানেন, জাতিসংঘ এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিলেও রাশিয়া-চীন ভেটো দিবে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ শুধুই কেবলা হাকিম।
অর্থাৎ বাংলাদেশ এর পাশে আছে বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশ্ববাসীর আশ্বাস (!)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:২০