তুমি পাঠক?
উত্তর যদি হ্যা হয়, তবে তোমাকে চিমটি। বই পড়ার একটা পার্শ্বপতিক্রিয়া হল, যে বই পড়ে সে চায় সবাই তার মত বই পড়ুক। সবাই আনন্দ পাক, জ্ঞান পাক, যা আমি পাচ্ছি, তুমি পাচ্ছো। কিন্তু সমস্যা হল, পাঠ্যবই গুলো মানুষকে ছোটবেলা থেকেই জ্বালায়। শুধু জ্বালায় না, জ্বালিয়ে কয়লা করে। অতিষ্ঠ করে ফেলে জীবন। ফলে বই এর প্রতি মানুষের এমন এক বিতৃষ্ণা তৈরী হয় যে, বই দেখলেই কারো কারো পেটের ভাত চাউল হয়ে যায়। তুমি গিয়ে তাকে বই পড়ার আহ্বান জানালে, প্রথমেই সে মনে মনে তোমার চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করবে। তারপর একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলবে,"ক্লাসের বই পড়েই সময় পাই না, আর তুমি বল এসব ফালতু আউট বই পড়তে! ", আর সে যদি কর্মজীবী হয় তবে ৯০% নিশ্চিত থাকো সে বই পড়ার আহ্বানে সাড়া দিবে না। বেশিরভাগ কর্মজীবী-পেশাজীবী দের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা থাকে যে তার বিকাশ যা হবার হয়ে গেছে। বর্তমানে এখন সে যে অবস্থানে আছে সেটাই তার নিয়তি (destiny)। আর বিকাশ হবে না, তাই বই পড়া, নতুন কিছু করা, নতুন কিছু শেখার স্পৃহা তাদের জাগে না।
এখন চিন্তার বিষয় হল, আমাদের এই বৃহৎ ছাত্র-জনতার মিছিল যদি বই না পড়ে তাহলে আমরা সুন্দর মানুষ পাবো না, আর সুন্দর মানুষ ছাড়া সুন্দর দেশ অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে মার্কিনিদের কথা মনে পড়ে গেল। কোন পরিসংখ্যান এর দরকার নেই, আমরা প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করি যে মার্কিনিরাই বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতি। মজার ব্যাপার হল শুধু উন্নতিতেই না, পরিসংখ্যান বলছে এই জাতিই সবচেয়ে বেশি বই পড়ে (গড়ে প্রত্যেকে ২ মাসে ১ টি বই পড়ে)। উন্নতি আর পাঠভ্যাস, দুটোতেই একত্রে শিরোপা পেয়ে যাওয়া কি কাকতালীয় ঘটনা? নাকি উন্নতি আর পাঠের নিবিড় সম্পর্ক আছে?
এখন, আমাদের দেশে আলোকিত মানুষ তৈরী করতে হলে আমরা কি করব? যদিও ধৃষ্টতা তবু আমার নিজের কিছু মতামত তুলে ধরছি।
প্রথমে একটা টার্গেট বাছাই করতে হবে, যাকে তুমি বই পড়ার অভ্যাস করাতে চাও। তার ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতাকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা কর। এখন খুজে দেখ তো, এমন গল্প-উপন্যাস কি আছে যার মধ্যে তার মত একটা চরিত্র খুজে পাওয়া যায়? যদি তার মত চরিত্র কোন বইয়ে পাওয়া যায় তবে তাকে সেই বইটা দিয়ে জোর করে ২ পৃষ্ঠা পড়াও।
যদি এমন হয়, তুমি টার্গেটের সাথে বঙ্কিমচন্দ্রের (যিনি বেশ কঠিন বাংলা লেখেন) সৃষ্ট চরিত্রের মিল পেয়েছ তবে সেই বই ভুলেও তাকে দিও না। দিলে সেই বই তো পড়বেই না বরং 'ছেড়ে দে মা, কেদে বাচি' অবস্থা দাঁড়াবে। খেয়াল রেখো, বইটা যেন তাকে আনন্দ দেয়, ক্রুশবিদ্ধ না করে। দুটো পৃষ্ঠা পড়ার সাথে সাথেই সে যেন আনন্দ পেতে শুরু করে। বই এর লেখার ধাচ এমন হওয়া চাই যেন নতুন পাঠক কে পড়তে না হয়, বরং সে হাওয়ায় ভেসে ভেসে বই তে ঢুকে যাবে, বই ই তাকে দিয়ে পড়িয়ে নিবে। এই বই গুলোর ক্ষেত্রে শরৎ বাবু আর বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ কে স্মরণ না করে পারছি না। উনারা যে সহজ বাংলায় হালকা লেখনী দিয়ে গেছেন, তা না থাকলে বর্তমান বাংলায় নতুন পাঠক বলতে আদৌ কিছু থাকতো কিনা সন্দেহ।
তোমার টার্গেটের বয়স ৪৫ এর বেশি হলে তাকে ধর্মীয় বই দাও। যেখানে নবী-রাসুলের কাহিনী বেশ আকর্ষণীয় ও সঠিক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লোকটা আমুদে হলে তাকে ভ্রমণ কাহিনী দাও। যেমন, হুমায়ূনের 'পায়ের তলায় খরম'।
টার্গেটের বয়স ২০ এর বেশি হলে হালকা একটা হুমায়ূনের বই ধরিয়ে দাও। 'কৃষ্ণপক্ষ', 'কবি', 'এলেবেলে' ইত্যাদি। আর সে যদি একটু ক্লাসি হয়, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড শিক্ষিত হয় তবে হুমায়ূন-শরৎ দুটোই দেওয়া যায়। শরৎ এর ক্ষেত্রে 'দত্তা' ধরণের বই না দিয়ে 'মেজদিদি', 'রামের সুমতি', 'মহেশ' ধরণের গল্প-উপন্যাস দেওয়া যায়। এগুলো তুলনামূলক সহজ। এখানে কাহিনী গুলো ছোট আর তরতরিয়ে এগিয়ে গেছে।
পাঠকের বয়স ১৬ এর বেশি হলে তাকে জাফর ইকবাল সাহেবের 'রাতুলের দিন রাতুলের রাত', 'আমি তপু', 'আমার বন্ধু রাশেদ', চার্লস ডিকেন্সের 'অলিভার টুইস্ট' দাও।
বয়স ১১ এর বেশি হলে তাকে জাফর সাহেবের,'মেকু কাহিনী','বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার' দাও।
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠকদের পালা। টার্গেটের বয়স ১২ এর কম হলে তাকে কাছে ডাকো, আদর করে কোলে বসাও। চিপস, চকলেট দাও। সময় নিয়ে তাকে 'ঠাকুরমারঝুলি' থেকে গল্প শোনাও। বাংলা রূপকথা শেষ হলে 'আরব্য রজনী', 'হান্স ক্রিশ্চিয়ান','গ্রিম ব্রাদার্স' শোনাও। তাকে ছবির বই কিনে দাও, কমিক দাও। তবে বই দেবার চাইতেও গল্প শোনানো জরুরি। একদিন নিশ্চিত ভাবে সেই বাচ্চাটা কোন এক রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক সংবর্ধনায় দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলবে,"অমুক ভাইয়া/আপু আমাকে শৈশবে গল্প শুনিয়ে যে জ্ঞানের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তার হাত ধরেই আজ আমি আপনাদের সামনে দাড়াতে পেরেছি"।
নিজের উপর বিশ্বাস রেখো, তুমি অবশ্যই ভালো পাঠক বানাতে পারবে। এক বিখ্যাত মনীষী (খুব সম্ভবত আমি) বলেছেন, "জীবনে অন্তত ১১ জন পাঠকও যদি তৈরী করতে না পারো, তোমার পাঠক জীবন বৃথা গেছে"।
এতক্ষণ আলোকিত মানুষ তৈরী করার আলোচনা করলাম, এবার বলি কিভাবে মানুষ কে বিশেষত বাচ্চাদের খুন করা যায়। ইদানীং অনেক বাচ্চাকে চোখের সামনে খুন হতে দেখি, সেখান থেকে শিখেছি। একটা অভিজ্ঞতা বলি -
'সেদিন আমার এক ধনকুব বা ধনবেকুব আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেলাম। উনার ৭ বছরের ছেলের হাতে ট্যাবলেট ফোন আর ল্যাপটপ দেখে আমি জানতে চাইলাম, এত ছোট বাচ্চার হাতে ফোন কেন? তাও তার নিজস্ব! উত্তরে মালকিন মুখে বললেন,"ঐ ফোনে সিম নাই, কোন সমস্যা হবে না", আর অঙ্গভঙ্গিতে বললেন, "আমার টাকা পয়সা কম নাকি, যে বাচ্চাকে একটা ফোনও কিনে দিতে পারব না!" । আমি আর কথা বাড়ালাম না, উলোবনে মুক্তা ছড়ানো অর্থহীন।
যদিও তিনি বললেন, সিম নাই তাই কিচ্ছু হবে না। কিন্তু উনার বাসার রাউটার টাই সিমের বাবার কাজ করে দিচ্ছে। সাধারণত বাবা-মা সন্তানকে ফোন দিতে ভয় পান যে, কবে আবার সন্তান প্রেম করা শুরু করলো, না আবার নোংরা ছবি দেখা শুরু করলো। সত্যটা হল, প্রেম আর নোংরা ছবি শিশুর মানসিকতায় যতটা ক্ষতি করে তা ফেসবুক ও আজাইরা গেমিং এর ক্ষতির সামনে কিছুই না। শিশু যখন দেখে বাস্তব জীবনের চাইতে গেম বা ফেসবুক অনেক বেশি উত্তেজনাকর, তখন সে বাস্তব জীবনের প্রতি মোহ হারিয়ে ফেলে। তার চিন্তা-চেতনা সংকুচিত হয়ে লাইক পাবার জন্য আগ্রাসী হয় আর সমস্ত জগৎ টাই ছোট হয়ে আসে। তার সৃজনশীলতা সমূলে ধ্বংস হয় (যদি আমি দৈত্য-দানব দেখতে কেমন তা মোবাইল স্ক্রিনে দেখে ফেলি, তাহলে কষ্ট করে পরী-দৈত্য-দানব কল্পনা করবো কেন?)। এদের ৪০% শিশুই শিকার হয় anti social psychopath এর। যার ফলে শিশু হয় অহংকারী। সে সমবয়সী অন্য শিশুদের মানুষ বলেই গণ্য করে না, আধিপত্য বিস্তার ও তথাকথিত স্মার্ট হওয়া আর লাইক পাবার প্রতিযোগিতায় তার মানবতার খুন হয়ে যায় তখনই।
আমি উপদেশ দিচ্ছি না, অনুরোধ করছি না, বাবা-মা দের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি আপনাদের সন্তান কে নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলবেন না। জন্মের পর পরই কান্না থামাতে তার হাতে ফোন তুলে দিবেন না। অন্তত ১৩ বছরের আগে তার হাতে স্মার্টফোন দিবেন না। তাদের খেলনা কিনে দিন, গল্প পড়ে শোনান, ঘুরতে নিয়ে যান। আর সবচেয়ে জরুরি, তাকে সময় দিন। সে যেন একাকীত্বে না ভোগে। পাঠ্যবই এর যাতাকলেই হোক বা স্মার্টফোনের আগ্রাসনেই, তাকে খুন করবেন না। আপনার সন্তান আপনারই অংশ। তাকে ভালোবাসুন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৮