আমাদের এখানে ওয়াজ শুরু হয় সন্ধার পর। তার একটু আগে গান-কুরান তেলোয়াত ইত্যাদি হয়। সেরকম ভাবেই একজন গান গাইলো ওয়াজের স্টেজে,
"ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শুনে না
দিনে রাইতে ড্যাং ড্যাং করে
নামাজ পড়ে না"
এরপর যে গান টা বাজানো হল তা ঠিক মনে নেই তবে তার সুর হিন্দি গান থেকে চুরি করা।
তারপর সন্ধ্যার পর ওয়াজ শুরু হল। হুজুর এর সব কথা শুনি নি, কিছু অংশ বিশেষ তুলে ধরছি।
".......চোরে এরপর দৌড় দিয়া ইমাম সাবের ঘরে পলাইলো। ঘরে তখন ইমাম সাবের বউ শুইয়া আছে। চোরের আওয়াজ পাইয়া সে ডাকলো, কে? চোর তখন ভয় পাইয়া ঘরে শুকাইয়া দেওয়া ছায়া (পেটিকোট) এর ভিত্রে লুকাইলো। ছায়ার ভিত্রে ঢুকসে বোলতা। চোরে কামড় খায় কিন্তু চিল্লাইতে পারে না। সারা রাত দাড়াইয়া থাইকা চোরে তওবা করে, ইয়া আল্লাহ!!! (চিৎকার দিয়েছিল হুজুর) আর চুরি করুম না....আর ঠকামু না....."
"......গু মাইখা গেল, গু মাইখা দিলে কি সেটা আর ভালো থাকলো? সেটা নাপাক হইয়া গেল। ঠিক না বেঠিক?...."
এখানে হুজুর আরব দেশের এক ঘটনা বর্ণনা করছেন, "......তোমারে এত আদর করলাম, সকালে গোশত খাওয়াইলাম, দুপুরে বড় বড় কই মাছ খাওয়াইলাম (আরবের কই!)...."
"...তারপর মুসা (আ) ওয়াজকুরুনি পাগলা রে জিগায়...(অথচ ওয়াজকুরুনির জন্মের ৪০০০ বছর আগে মুসা নবী মারা গেছেন)"
প্রশ্ন হল ওয়াজ গুলো থেকে আসলেই কিছু শেখার আছে?
থাক সেটা তোমার বিবেচনা, এবার একটু নস্টালজিক হই। অনেক বছর আগে, ২০০৪-২০০৫ এর কথা। প্রতিবছর শীত কালে বাসার একটু কাছেই ৩ দিন ব্যাপী ওয়াজ মাহফিল হতো। হুজুর কি বলতো তা জানতাম না, সম্ভবত ধর্ম নিয়ে কিছু একটা। তখন তথাকথিত ভদ্র পরিবারের ছেলে হিশেবে আমার জন্য বাইরে বের হওয়া বারণ। তাই ঘরে বসেই আবছা আবছা ওয়াজ শুনতাম। খুব একটা ধারণা ছিল না জিনিশ টা কি। তবে এলাকায় একটা উৎসবের ভাব আসতো। শৈশবের স্মৃতিতে তাই ওয়াজ গেথে আছে। তারপর,
দিনে দিনে ওয়াজ বেড়ে গেল। 'প্রতি এলাকায় বছরে একবার ওয়াজ হওয়া জরুরি' এই ধারণা পালটে গিয়ে নতুন এক ধারণা আসলো, 'প্রত্যেক মসজিদের বাৎসরিক সাফল্য হিশেবে একবার ওয়াজ হতে হবে'। এই নিয়ম আসার পর মসজিদ গুলোর কয়েকটা উদ্দেশ্য পূরণ হল,
প্রথমত, বাৎসরিক কার্যক্রম প্রদর্শন করা আর সমাজে সেই মসজিদের আলাদা এক নজর পাওয়া।
দ্বিতীয়ত, ওয়াজ উপলক্ষ্যে দান-সদকার উপলক্ষ্য তৈরী হওয়া
তৃতীয়ত, তথাকথিত ইসলাম প্রচার (বিধর্মীদের ওয়াজে আকৃষ্ট করার মত কোন ব্যবস্থা আমি দেখি নি)
এখন প্রায় সব মসজিদ ই এই নীতিতে চলে। তাই বাসার আশেপাশে ১২-১৫ টা মসজিদ (শুধু আমার বাসা থেকেই ১৩ টা কন্ঠে আজান শোনা যায়) যদি ৩ দিন করেও সময় নেয় ওয়াজ করতে তাহলেও লেগে যায় এক থেকে দেড় মাস। তাই নভেম্বর থেকে ওয়াজ শুরু হয়েছে, এখনও চলছে। সম্ভবত জানুয়ারি গড়াবে।
একটু যদি বিবেক দিয়ে চিন্তা করি প্রত্যেক টা মসজিদ মাত্র ৩ দিন সময় নেয়, মোটেও তা বেশি না। কিন্তু এই দেড় মাস তারা কিন্তু নতুন শ্রোতা পাচ্ছে না, ঘুরে ফিরে এক এলাকার লোক দের কাছেই দেড় মাস ওয়াজ করছেন। প্রথম দিকে জনগণ ভালোই ওয়াজ শুনতো, এখন আগ্রহ হারাচ্ছে। দেড় মাস ওয়াজ হয়ে ওয়াজের দাম কমিয়ে দিয়েছে। আগের ৩ দিনের ওয়াজে যে লোকসমাগম হতো, যে আনন্দ হতো, তা আর হয় না।
মজার ব্যাপার হল, এই দেড় মাসের প্রতিদিন ৩ জন করে হুজুর আসে। সেই হিসেবে হুজুর সংখ্যা (৩x৪৫) = ১৩৫ জন। প্রত্যেকেই নাকি আন্তর্জাতিক খ্যতি সম্পন্ন মুফাসসের এ কুরান। এটা খুব ই ভালো সংবাদ যে আন্তর্জাতিক মুফাসসের গণ সব ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ত্যাগ করে ঢাকার অখ্যাত এলাকা দনিয়ায় জমায়েত হয়েছেন। আমরা বড়ই সৌভাগ্যবান তাদের পেয়ে। এই সৌভাগ্য পেয়ে আমার অসুস্থ নানী জান বাচিয়ে তার বাড়িতে পালিয়ে গেলেন। আশপাশে বিয়ে হলেই তিনি পালান, দেড় মাসের ওয়াজ সহ্য করার কথাও না, রাতে তিনি ঘুমাতে পারেন না। এদিকে আমার আম্মুর শুরু হয়েছে মাইগ্রেনের ব্যথা। আর আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক খেয়াল করলেন রাতে আমার বাসায় পড়ানো আর অংক বোঝানো অসম্ভব। তাকে দুপুরেই আসতে হবে। বড় বোন কাল বেড়াতে এসেছে। সে ঠিক সময় মনে করে ভাগ্নি কে বিকালের আগেই ঘুম পাড়ায়। একবার ওয়াজ শুরু হলে তো বেচারি আর ঘুমাবে না। আশা করি জানুয়ারি তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
শেষ প্রশ্ন, এরা সবাই জীবনে একবার হলেও সৌদি যায়, তারা কি খেয়াল করে না, আরবের মুফতী রা নাকি গলায় গান না গেয়ে সাবলীল ভাবে যুক্তিগত ভাষণ দেন!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫১