রাজনীতি, সামাজিকতা, ধর্ম অবমাননা, অশ্লীলতা ইত্যাদি কারণে (কখনো বা অকারণে) বিশ্বব্যাপী অনেক বই নিষিদ্ধ করা হয়। বই নিষিদ্ধ করার এই প্রথা শুরু হয় নন্দিত নরক ইংল্যান্ড থেকে। উইলিয়াল টেইন্ডেল ১৫২৬ সালে সর্বপ্রথম সরাসরি হিব্রু থেকে ইংরেজী তে বাইবেল অনুবাদ করেন। অশ্লীলতার দায়ে অষ্টম হেনরি সেই বইটির প্রায় ৬ হাজার কপি পুড়িয়ে ফেলেন আর নিষিদ্ধ করে দেন। বুদ্ধিজীবী সমাজ তখন কৌতুহলী হয়ে বইটির প্রতি ঝুকে পড়েন। এর নিষিদ্ধ হওয়ার পর বইটি এত জনপ্রিয়তা পায় যে বর্তমানে ৭০ ভাগ খ্রিস্টান এটিকেই অনুসরণ করেন (টেইন্ডেলের দেখানো পথেই কিং জেমস ভার্সন বাইবেল লেখা হয়)।
এরপর উল্লেখযোগ্য নিষিদ্ধ বই হল 'The Ramayana as Told by Aubrey Menen'. বই টিতে সনাতন দেবতাদের মানব চরিত্র দিয়ে কাহিনি বর্ণনা করা হয়। ১৯৫৪ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ হবার পর ভারতে এর চাহিদা বেড়ে যায়, আর ভারতের বাইরে এর প্রভাব পড়ে আরো বেশি। হুহু করে বেড়ে যায় জনপ্রিয়তা।
উল্লেখযোগ্য আরো নিষিদ্ধ বই হল, গ্যলেলিও গ্যলেলাই এর'Dialogue Concerning the Two Chief World Systems', মার্ক টোয়েনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ (১৮৮৪ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে শ্বেতকায় ছেলে এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বন্ধুত্ব দেখানো হয়, যা শ্বেতঙ্গ শাসক দের পছন্দ হয় নি), আরো আছে, আর্নেস্ট হোমিংওয়ের 'A Farewell to Arms', জর্জ ওরওয়েলের 'Animal Farm', লুইস ক্যারোলের 'Alice's Adventure in Wonderland', এরিক মারিয়া রেমার্কের 'All Quiet On The Western Front ' জে কে রাওলিং এর 'Harry Potter' সিরিজ ইত্যাদি।
যতদূর জানি এই ভূখন্ডে প্রথম যে বই নিষিদ্ধ হয় তা নজরুলের প্রবন্ধ সংকলন 'যুগবাণী'। একে একে নিষিদ্ধ হয় 'বিদ্রোহী' কবিতা, 'বিষের বাঁশি', 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থ । স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নিষিদ্ধ বই সম্ভবত তসলিমা নাসরিনের 'লজ্জা'(১৯৯৩)। ১৯৯৫ সালে নিষিদ্ধ হয় হুমায়ূন আজাদের অনুবাদ গ্রন্থ 'দ্বিতীয় লিঙ্গ'। এরপর প্রকাশ হয় মতিউর রহমান সেন্টুর 'আমার ফাঁসি চাই'। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তা নিষিদ্ধ করে। এরপর নিষিদ্ধ বই হিসেবে আলোড়ন ফেলেছিল হুমায়ূন আজাদের 'পাক সার জামিন সাদ বাদ' ও 'আমার অবিশ্বাস'। সমসাময়িক সময়ে তসলিমা নাসরিনের আরো ৫ টি বই নিষিদ্ধ হয়।
বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ বইগুলোর সবচেয়ে মজার দিক টা হল কোন বই নিষিদ্ধ করার পর তার জনপ্রিয়তা কম করে ১০ গুণ বেড়ে যায়। কথাটা শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের জন্যই সত্য। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। বর্তমান যুগে কোন শাসক কোন বই নিষিদ্ধ করে না। সাম্প্রতিক কালে অভিজিৎ রায়ের বই গুলো কে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল। সরকারের সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে যে নিষিদ্ধ হয় নি। হলে হয়তো 'লজ্জা' এর মতই জনপ্রিয়তা পেতো। এখন কোন বই নিষিদ্ধ হয় না, নীরবে সরে দাঁড়ায়। অনুধাবন করাই যায় বই কে আক্ষরিক অর্থে নিষিদ্ধ করা নিষিদ্ধ করার নামে একটি হাস্যকর প্রক্রিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৩৮