সে আমার দেবর ছিলো ৷ আমাদের বিয়ে হয়েছে ছয়দিন সে এখনো বাসায় আসেনি ফোনও বন্ধ ৷ হয়তে নীলা জানে ও কোথায় নীলা ওর গার্লফ্রেন্ড ছিলো ৷ কিন্তু নীলাকেই বা আমি কোন মুখে ফোন করে ওর কথা জানতে চাইবো? আমার জন্যই তো ওদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেলো ৷ আমার শ্বশুড় বাড়ীতে সবাই চুপচাপ ৷ যেখানে বাড়ীটা সবসময় হইচই এ মাতানো থাকতো ৷
আটদিনের দিন ও বাসায় এলো ৷ চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা মনে হচ্ছে বিদ্ধস্ত কোন মানুষ ৷ কে জানে ছেলেটার বুকের ভেতরটায় কতোটা শূণ্যতা নিয়ে আছে ৷ ও ফেরার পর আমার শ্বাশুড়ি কান্নাকাটি শুরু করে দিলো আর শ্বশুর ওর দায়িত্ববোধ এ আঙ্গুল তুলে বকতে লাগলেন ৷ অনেক্ষন পরে ও ঘরে এলো ৷ আমি বুঝতে পারছিনা ওকে ঠিক কি বলবো ওর জীবনটা নষ্ট হলো তো আমার জন্যই ৷ আমি মানুষটাই কুফা সবকিছু এলোমেলো করে দেই ৷ যখন এসব ভাবছিলাম তখন ও নিজেই কথা বললো আমার সাথে,
-- খেয়েছো?
-- হুম ৷ তুমি?
-- খেয়েছি ৷ তোমার কিছু লাগবে?
-- না ৷
-- লাগলে বলবে কারণ আমি তোমার হাসবেন্ড আমার রিসপনসিবলেটি আছে ৷
-- আচ্ছা ৷
-- শুয়ে পড়ো আমি আসছি এখনি ৷
ছেলেটা এতো কিছুর পরেও আমার খবর নিচ্ছে এটাই তো আনএক্সপেক্টেড ৷ এই তো সেদিনও কতো হেসে হেসে নীলার সাথে আমার কথা বলিয়ে দিলো ৷ বললো ভাবী বাসায় বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু তোমার আমি আর কিছু জানিনা ৷ ছেলেটাকে আস্থা দিয়েছিলাম ওদের বিয়েটা হবে কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি ৷
সাতমাস আগে আমার বিয়ে হয় পলাশের সাথে ৷ আর সাত মাস পর বিয়ে হলো পলাশের ভাই পরাগের সাথে ৷ এটাই কি ভাগ্য?
পলাশ আর পরাগ যময ভাই একদম একরকম চেহারা ৷ আমাকে পলাশের জন্য যখন দেখতে গেলো তখন জানতামনা যে ওরা টুইন ৷ দেখতে এসেই বিয়ে হয় এক মাস পর বিদায় হয় ৷ খুব ভালো চলছিলো সংসারটা একদিন তো পলাশ ভেবে পরাগকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম সেদিন প্রথম জেনেছিলাম আমি মা হবো তাই জড়িয়ে ধরে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম ৷ পরাগ হাসতে হাসতে বলেছিলো তাই নাকি বউ? ভয়েস শুনে বুঝেছিলাম মিস্টেক করে ফেলেছি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো কি ভুলটা করে ফেললাম ইশ ৷
আর আমার বলতে হয়নি পরাগই চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে ছিলো নতুন অতিথীর কথা ৷ আমার তখন সবে তিন মাস প্রেগনেন্সি চলছিলো ৷ নতুন খবরে বাড়ীতে আনন্দের বন্যা ৷ সবাই এতো খুশী ছিলো যা প্রকাশ করার মতো না ৷ এই খুশীর দিনের সন্ধ্যাটা আমাদের সবার জীবন উল্টে পাল্টে দিলো খবর পেলাম পলাশের এক্সিডেন্ট হয়েছে হসপিটালে পৌছানোর আগেই স্বার্থপর ছেলেটা আমাদের পর করে দিয়ে চলে গেলো ৷ আমি টানা দশদিন ঠিকমতো দাড়াতে পারিনি প্রচন্ড জ্বর কাউকে চিনতে পারছিলামনা ৷ শুধু নাকি পরাগের হাত ধরে বলছিলাম পলাশ তুমি কিন্তু আমার হাত ছাড়বেনা ৷ পরাগও হাত ছাড়েনি ৷ এর কিছুদিনপর একদিন শুনছিলাম পরাগের ঘরে চেচামেচি হচ্ছে গিয়ে দাড়াতেই সবাই থেমে গেলো ৷ আমাকে যেনো কিছু একটা হাইড করতে চাচ্ছে কিন্তু আমি অনেক জেদ করায় শ্বাশুড়ী মা বললেন তারা পরাগের সাথে আমার বিয়ে দিতে চান ৷ কারণ তাদের বংশধর আমার গর্ভে ৷ আমি কি বলবো বুঝতে পারলামনা কি হচ্ছে এসব? আমি ও পরাগের মতো আপত্তি করলাম কারণ এটা কখনোই সম্ভব না ৷ এক ওকে কীভাবে হাসবেন্ড মানবো? দুই ও একজনকে ভালোবাসে ৷ সব মিলিয়ে আমি আর পরাগ দুজনেই না করতে থাকলাম আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাবার বাসায় চলে যাবো তাহলে হয়তো ঠিক হবে ৷ কিন্তু লাভ হলোনা যেতে তো পারলামই না উল্টা আব্বু আম্মুও আমাকে এসে বোঝাতে লাগলেন পরাগের সাথে যেনো বিয়েটা করি ৷
কাউকে বোঝাতে পারছিনা আমি এটা চাইনা ৷ শেষ পর্যন্ত এটাও বললাম পরাগের পছন্দ আছে মেয়েটা খুব ভালো কিন্তু কেউ পাত্তাই দিলোনা কথাটার ৷ এর মাঝে পাঁচ মাস হয়ে গেছে প্রেগনেন্সির ৷
সেদিন রাতে পানি নিতে ড্রয়িংরুমে যাবার সময় শ্বাশুড়ীর ঘরে চলা কথাগুলো কানে আসে ৷ তারা সকালে জোড় করে,আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিবেন এরকমটাই বলছিলেন ৷ আমি কোন পথ পাচ্ছিলামনা যেদিকে যাবো ৷ নাহ পরাগের জীবনটা নষ্ট করতে পারবোনা রুমে গিয়ে ফ্যানের সাথে শাড়ী বাধতে চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলামনা এর মধ্যেই পরাগ এলো এতো রাতে সে কেনো এসেছে আমি জানিনা দরজায় নক করছিলো আর আমি শাড়ী ফ্যানে বাঁধতে ব্যাস্ত ৷ আমার জন্য এতো কিছু সো আমি সরে যাবো কারও স্বপ্ন আমি ভাঙ্গতে পারবোনা ৷ গলায় ফাস লাগিয়ে বিছানা থেকে চেয়ার ফেলে দিলাম এই শব্দেই পরাগ বুঝেছিলো কিছু একটা হয়েছে ও বাবা মায়ের কাছে গিয়ে চাবি নিয়ে এসে দরজা খুলে আমাকে ধরে ফেললো ৷ কেনো যে শুধু লক করেছিলাম সেদিন যদি ছিটকিনি আটকাতাম আজ হয়তো বেঁচে থাকতে হতো না ৷ এরপর পরাগ নিজে থেকেই বিয়ে করতে রাজী হলো ৷ আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু আর আটকাতে পারলামনা বিয়েটা করতেই হলো ৷ এরপরেই পরাগ বের হয়ে গেছিলো আজ এসেছে ৷ একটা মানুষ কতোটা নিরুপায় হলে এমনটা করে তা বুঝি ৷ কিন্তু আমি তো চলেই যেতে চেয়েছিলাম তাও পারলামনা ৷ আর পরাগ হয়তো বুঝেছিলো আমি ওদের লাইফে না আসতে আবারো এমনটা করতে পারি তাই রাজী হয়েছিলো ৷
আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারিনা কোন মুখে তাকাবো? কিন্তু ও আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখে ৷ তবুও শেষ রক্ষাটা করতে পারলাম না ৷ আট মাসে বাথরুমে পড়ে গেলাম হসপিটালে নেয়া হলো পেটে প্রচন্ড ব্যাথা বুঝতে পারছিলাম আমি আর বাঁচবোনা ৷ ডক্টর ছিলো আমার কাজিনের হাসবেন্ড তাকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, নিয়াজ বেবীটাকে কি বাঁচানো যাবে? ও মুখ কালো করে বললো চুপ করে থাকো আগে জীবন ৷ আমি আবারো বললাম নিয়াজ আল্লাহর দোহাই লাগে বাচ্চাকে বাঁচাও আমার বেঁচে থাকা জরুরী না আর তুমি কথা দাও নীলার সাথে পরাগের বিয়ের ব্যাবস্থা করবে ৷ কথাগুলো খুবই হাস্যকর ছিলো ওই পরিস্থিতিতে কিন্তু আমার কিছু করার ছিলোনা ৷ আমার মাথায় শুধু পরাগের ভালো থাকাটা কাজ করছিলো নিয়াজ আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বললো কিন্তু আমি বেঁকে বসলাম পাশে রাখা কাচি হাতে নিয়ে বললাম তুমি কথা দাও নাহলে আমি সুইসাইড করবো ৷ নিয়াজ কিছুই বুঝতে পারছিলোনা তবুও থতমত খেয়ে বললো ওকে আমি ওদের বিয়ে দেবো কথা দিলাম তুমি কাচিটা আমাকে দাও ৷ আমি ওকে আবারো বললাম নিয়াজ আমাকে বাঁচানোটা জরুরী না ওদের বিয়েটা জরুরী আর কিছু মনে নেই কেউ পাশে থেকে ইনজেশান পুস করে দিয়েছে কারণ আমাকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছিলোনা ৷
কিন্তু ভাগ্যে অন্য কিছু ছিলো ৷ আমার বেবীটা আর রইলোনা কিন্তু আমি অপয়া বেঁচে গেলাম ৷ বাড়ী আসার কিছুদিন পর শ্বশুড় শ্বাশুড়ী আর আমাকে পছন্দ করছেননা ৷ অথচ এতোদিন তাদের চোখের মনি ছিলাম ৷ একদিন কানে এলো তারা পরাগ আর আমার ডিভোর্স করাবে ৷ এরপর ওর পছন্দে ওর বিয়ে দেবে ৷ এটাই তো চেয়েছিলাম কিন্তু তবুও কেনে যেনো কলিজাটায় গিয়ে কথাটা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিলো আমাকে ৷ পরাগের ফোন বাজছিলো ওকে দিতে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখলাম নীলা ফোন করেছে ৷ আমার তো খুশী হওয়া উচিত কিন্তু কেনো যেনো কান্না পাচ্ছিলো ৷ পরাগ ফোন নিয়ে বাইরে চলে গেলো ৷ এর মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে সামনের সপ্তাহে উকিলের কাছে যাওয়া হবে ৷ দেখতে দেখতেই সাতটা দিন চলে গেলো উকিলের কাছে যাবার পর বার বার মনে হচ্ছিলো বেবীটা থাকলে হয়তো ডিভোর্সটা হতো না ৷ ছিহ কি ভাবছি আমি? না না এটা হতেই হবে আমিই তো চেয়েছিলাম এটা আমার তো আনন্দ পাওয়া উচিত ৷
বাড়ী এসে কাপড় গোছানো শুরু করলাম বাবার বাড়ী চলে যাবো কারণ মায়া বাড়ছে যা বিপদজনক ৷ পরাগ এসে জানতে চাইলো কি করছো? বললাম চলে যাচ্ছি ৷ ও কিছুক্ষণ আমার পাশে বসে এরপর বললো শারমিন পারলে ক্ষমা করে দিও ৷ বলেই চলে গেলো ৷
পরের দিন বাবার বাড়ী চলে এলাম ৷ আর কিছুদিন পর ডিভোর্স হয়ে যাবে এরপর নীলা আর পরাগের বিয়ে হবে ৷ ওদের জীবনটা সুন্দর হবে ৷ কিন্তু আমার আর কিছু ভালো লাগছেনা দুই পাতা গ্যাসের অসুধ সাথে এক পাতা ঘুমের অসুধ পানিতে গোলালাম ৷ আমি মানতে পারছিনা কিছু তার চেয়ে মরে যাই ৷ কিন্তু খেতে গিয়েও থেমে গেলাম যদি আবার বেঁচে যাই? আগেরবার এটার জন্যই পরাগ বাধ্য হয়েছিলো বিয়েতে রাজী হতে ৷ আবার ওকে বিপদে ফেলবোনা ৷ মরলে এমন ভাবে মরবো যেখানে বাঁচার চান্স নেই ৷ আমি যে পরাগের প্রতি দুর্বল তা বেঁচে থাকতে ওকে বুঝতে দিবোনা ৷ হয়তো পলাশের মতো দেখতে পালাশের মতে আচরণ এসব বলেই ওকে ভালোবেসে ফেলেছি ৷
ঠিক করলাম উচু কোন ছাদ থেকে লাফ দেবো তাহলে বাঁচার চান্স জিরো ৷ এর মধ্যেই পরাগ এলো ৷ হঠাৎ কী ভেবে এলো বুঝলামনা এসেই বললো শারমিন চলো ৷ আমি বললাম কোথায়? ও বললো উকিল ডেকেছেন ৷ আমি আমার চোখের পানিটাকে কিছুতেই আটকাতে পারছিনা ৷ কিন্তু এটা তো ভুল যা হচ্ছে সেটাই তো ঠিক ৷ অফিসে গিয়ে পেপারসে সাইন করলাম বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার ৷ সব কিছু থেকে মুক্ত পরাগ ৷ আর কোন পিছুটান তার নেই ৷ ঘোরের মধ্যে ছিলাম বুঝতেই পারিনি রিক্সা বাড়ীর সামনে এসে পড়েছে ৷ ঘোর কাটলো পরাগের ডাকে, তারাহুরা করে নেমে ওকে বললাম তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা ৷ খুব হ্যাপি হও ৷ পরাগ হেসে বললো তোমাকেও ধন্যবাদ তোমার জন্যই সব সম্ভব হলো এতো সাপোর্টের জন্য আবারো থ্যাংক্স ৷ যাও ভেতরে যাও ৷
বললাম তুমিও এসো চা খেয়ে তারপর যাও ৷ ও বললো ওকে চলো ৷ আমি বাড়ীর দিকে ঘুরেই চমকে গেলাম এটা তো পরাগদের বাড়ী এতক্ষন তো খেয়ালই করিনি কি ব্যাপার পরাগ এখানে আনলো কেনো? ওকে জিগেস করার আগেই ভেতরে এসো বলে হনহন করে ভেতরে চলে গেলো ৷ কিছুই বুঝলাম না ৷ ভেতরে যাবার পর ও ওর রুমে ডাকলো এরপর বললো,
শারমিন তুমি সেদিন নিয়াজকে যা যা বলেছো সবই আমি শুনেছি কারণ ওরা একজন ফ্যামলি মেম্বার এলাও করে সাপোর্টের জন্য আমি ওখানেই মাস্ক পরা ছিলাম সবই শুনেছি তখন বলিনি আজ বলছি নীলার বিয়ে হয়ে গেছে আরো চার মাস আগেই ৷ সো আবার কীভাবে বিয়ে করি বলোতো? হাহাহাহা আর আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো ডিভোর্সটা চাও তাই রাজী হয়েছি কিন্তু সেদিন নীলার ফোন দেখে তোমার চোখের পানিই বলে দিয়েছে সব ৷ তবুও তোমাকে যেতে দিয়েছি কারন ডিভোর্স ফাইলটা তো বাতিল করতেও আবার সময় লাগবে ৷ ততদিন একটু কষ্টে রেখেছি বলেই আগাম সরি বলেছিলাম একটু চমকে দিতে চেয়েছিলাম আর কি ৷ আর নীলা ফোন করেছিলো ও হাসবেন্ড সহ বাইরে চলে যাচ্ছে আমি যেনো তোমাকে নিয়ে দেখা করি তার জন্য ৷ আর হ্যাঁ আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা সেটা অনেক আগে থেকেই বুঝেছি ৷ আজ পেপারগুলো বাতিলের জন্য সাইন করে এসেছি ৷
যে মেয়ে মৃত্যুর মুখে থেকেও আমার সুখটা ভাবে তার চেয়ে বেশী ভালো কেউ আমাকে বাসতে পারবে? তুমিই বলো?
আমি কিছু বলতে পারছিনা মেঝের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছি পরাগ আমাকে ওর বুকে টেনে নিলো ৷ এরপর বললো ভাগ্য সবসময় খারাপ করেনা সাময়ীক খারাপ করলেও শেষ পর্যন্ত বেষ্ট টাই দেয় যেমন তোমাকে দিলো ৷ আমি ফোপাতে ফোপাতে বললাম বাবা-মা? ও বললো তাদের ছেলের সুখের চেয়ে বড় কিছু আছে তাদের?
কেদোনা পাগলী! আমি ঠিক মানুষটাকেই পেয়েছি ৷ বিধাতাকে ধন্যবাদ ৷ যাও চা বানিয়ে আনো চা খাওয়াবে বলে এখন ফাঁকি দেবার ধান্ধা করছো নাকি? ?
আমি হেসে ফেললাম ৷ পাগল একটা ৷
( সমাপ্ত )