বাংলা কবিতার দায়মুক্তি-১
Click This Link
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বেশিরভাগ সমালোচকের মতে বীরাঙ্গনা কাব্যটি মাইকেলের শ্রেষ্ঠ কাব্য । যাই হোক, মাইকেলের পৌরাণিক ও প্রথাগত বদ্ধমূল সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাকে বলা যেতে পারে কবিতার বিষয়বস্তু সংক্রান্ত দায়মুক্তি প্রচেষ্টা । এটা ছাড়াও মাইকেল কবিতার শরীরগত তথা আঙ্গিক নিয়াও একটি বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার শুরু করেন । অমিত্রাক্ষর ছন্দ । যা শেষ পর্যন্ত বাংলা উত্তরাধুনিক কবিদের মূলধারায় পরিণত হয়েছে ।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা অন্ত্যমিল নিয়া মাথাব্যাথাহীনতা আমার মনে হয় বাংলা কবিতার শরীরগত দুইটি বিশ্বযুদ্ধজাতীয় ব্যাপারের মধ্যে প্রথমটি যার দ্বিতীয়টি গদ্য কবিতার আবির্ভাব । মাইকেল নিজে যদিও শেষ পর্যন্ত অনেক কবিতাই লিখেছেন মিত্রাক্ষরে, কিন্তু অত্যন্ত সার্থকভাবে শুরু করেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধারাটি । তার মেঘনাদবধ মহাকাব্যটি পুরোটাই অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা । তার আগ পর্যন্ত কবিতায় অন্ত্যমিলকে দেখা হত অনেকটা কবিতার একমাত্র বৈশিষ্ট্যরুপে । গদ্য-পদ্যের পার্থক্যকারী চিহ্ন হিসাবে । প্রতি দুইপদে অন্ত্যমিল রাখতে গিয়ে দেখা যায় সবসময় যথোপযুক্ত শব্দের জায়গায় মিলযুক্ত একটি অস্পষ্ট বা কম স্পষ্ট শব্দ ব্যাবহার করতে হয় । অনেক ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুও পরিবর্তন করে ফেলতে হয় । যা বলেতে চাওয়া, যে ভাব প্রকাশ করতে চাওয়া তাকে নিয়মের জালে বেঁধে অন্য কথা বলিয়ে নেয়ার মত ।
শরীর এবং বিষয়বস্তু নিয়া এমন বিপ্লবী মাইকেলও কিভাবে সনেট লেখাতে এত আগ্রহী ছিলেন এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ধরে না । বাংলা কবিতার এখন পর্যন্ত বিকাশে উত্তরাধুনিক গদ্যকবিতা যদি হয় শরীরগত ভাবে দায়মুক্তির চূড়ান্ত অবস্থা তাইলে নির্ঘাত অন্ত্যমিলযুক্ত সনেটই হবে শরীরগত দায়বদ্ধতার চূড়ান্ত অবস্থা । চৌদ্দ মাত্রার চৌদ্দ পঙতি, আট পঙতির অষ্টকে মূলভাব প্রকাশ, ছয় পঙতির ষষ্টকে ভাবের পরিণতি , এত এত নিয়মের মধ্যে ভাব যে কিভাবে আসে সেটা এক বিস্ময় । হতে পারে এটা মানুষের উৎকর্ষের একটি চূড়ান্ত রুপও প্রকাশ করে । শত প্রতিকুলতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েও মানুষ যে তার শ্রেষ্ঠত্ব ফুটিয়ে তুলতে পারে তার একটা প্রমাণ মনে হয় সনেট । মাইকেলের সনেটগুলা বিস্ময়কর । আমার কাছে তার সনেট লেখাটাও বিস্ময়কর ।
মাইকেলের পর বাংলা কবিতার বৃহত্তম বটগাছটি যেকোনোভাবেই রবীন্দ্রনাথ ।
পাঠক হিসাবে আমার ব্যাক্তিগত বিশ্লেষণ এটা, সেইটা স্বীকার করে নিয়া বলি বাংলা কবিতার দায়মুক্তির ইতিহাস বা বিকাশের ইতিহাসেও আমি নিজে দুইজন জায়ান্টকে অন্তর্ভুক্ত করি না । রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল । এটা পাঠকের স্বাধীনতা । আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলে হয়ত এই মনোভাব নিয়া পরীক্ষায় ফেইল করতে হত । সৌভাগ্যক্রমে আমি তা না । অতএব অল্প কথায় তাদের অন্তর্ভুক্ত না করার কারণটা বলে নিই । অল্প কথায় কারণ আমার লেখার মূল বিষয়ের সাথে এদের তেমন কোনো সম্পর্ক নাই ।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন প্রচুর । কিন্তু তার পূর্বসুরী বিশ/পঁচিশজন কবির কবিতাসমগ্র নিয়া বসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাবের মোটামুটি পুরোটাই পাওয়া যাবে বলে মনে হয় । এছাড়া তার সুরটি একটু বিলাপপ্রতিম, ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার মত, যা বাংলা কবিতার জন্মেরও আগের পুঁথিগুলার সাথে সমতুল্য । নজরুল দেশপ্রমিকদের আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া ছাড়া কবিতা নিয়া তেমন কিছু একমপ্লিশ করতে পারেন নাই ।
আবারও বলি রবীন্দ্র নজরুল নিয়া এই বিশ্লেষণ একান্তই পাঠক হিসাবে আমার ব্যাক্তিগত মতামত ।