ধর্মের নামে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের এক চক্রান্ত নতুন ভাবে শুরু হয়েছে। এখন থেকে ১৪৫০ বছর আগে রোমের সামন্ত রাজারা প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী খ্রিষ্টান ক্যাথলিক চার্চের যাযকদের সহায়তায় জনগনের উপর ধর্মের নামে যে অত্যাচার করে ছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল
"ব্লাসফেমি"। আধুনিক যুগ ত দূরের কথা এমনকি ১৪০০ বছরের ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের আইনের কোন ধারনা নেই।
ব্লাসফেমি আইন কি?.........
ব্লাসফেমি শব্দের অর্থ'- 'ধর্ম নিন্দা' বা 'ঈশ্বর নিন্দা'
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপে ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল। সে সময় রাজা বাদশাদের বলা হত ঈশ্বরের প্রতিনিধি,তাই রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলা,এইভাবে রাজার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগনের আন্দোলন যাতে গড়ে না উঠতে পারে সেই জন্য ওই সময় ব্লাসফেমি নামের এই কালো আইন তৈরী হয়েছিল।
বাংলাদেশে এই আইনের সাথে পরিচিত কিভাবে?
পাকিস্তানের কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ইসলাম ধর্মের বাতাবরনে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মধ্যযুগের এই বর্বর কালো আইনটিকে ধার করেছিল,পাকিস্তানের দণ্ডবিধিতে ১৯৮২ সালে ২৯৫খ এবং ১৯৮৬ সালে ২৯৫গ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছিল। ঠিক সেই দুটি আইন কে জামাত সাংসদ নিজামি সেটাকে বাংলাদেশের দণ্ড বিধির ২৯৫খ ও ২৯৫গ ধারা হিসাবে সংযুক্ত করার জন্য বিল আকারে সংসদে পেস করেন।
কি ছিল ধারা দুটিতে?
২৯৫খ.যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআন কিংবা এর কোন অংশের কোন অবমননা,ক্ষতিসাধন ও পবিত্রতা হানি করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হবে।
২৯৫গ.যে ব্যক্তি মৌখিক কিংবা লিখিত ভাবে,ইঙ্গিতে বা বাহ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর পবিত্র নামের অবমাননা করবে সে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করবে এবং তাকে জরিমানাও করা যেতে পারে।
এই আইনের বাস্তবায়নে এর ফল...।
পাকিস্তানে এই আইনের ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক মানুষের যাবজ্জীবন,মৃত্যুদণ্ডের ঘটনার অনেক নজির আছে,
পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে ১৯৯৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ২৯৫গ ধারায় একটি মামলায় আজও একজনের বিচার চলছে।
পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুর ১৯৯৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী ২৯৫গ ধারায় এক ব্যক্তিকে মৃত্যু দণ্ড দিয়েছিল।
পাঞ্জাবে ১৯৯২ সালের ২ নভেম্বর কোর্টে মাত্র একজনের সাক্ষীর ভিত্তিতে ৪২ বছরের একজনের মৃত্যু দণ্ড দেন।(অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১৯৯৪ সালে মুক্তির নির্দেশ দেন)
এই আইনের কারনে পোলিশ বিজ্ঞানী কোপারনিকাসের সেই 'দ্য রেভোলিওশনিবাস' বইটি ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ায় গির্জার পাদ্রীরা বই টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়,কারন ওই বইটিতে লিখা ছিল পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে,কিন্তু বাইবেলে লেখা ছিল পৃথিবীর
চারদিকে সূর্য ঘোরে। ১৫৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তিনি মারা যান। এরপর ইতালিয় বিজ্ঞানী জিয়দারনো ব্রুনো সেই আপ্রকাসিত সত্য উদ্ঘাটন করেন, এবং তা তিনি প্রচার করতে শুরু করলেন।এ কারনে তার প্রতি ধর্ম যাজকরা ক্ষিপ্ত হন এবং কোঠর শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নেয়,বাধ্য হয়ে ইতালি ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে যায়,সেখানেও তিনি একী কারনে বহিষ্কৃত হন।পোপের নির্দেশে একের পর এক দেশ ব্রুনোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়,এই সময় পোপের এক গুপ্তচর এক মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে ব্রুনোকে ইতালিতে নিয়ে আসে,১৫৯২ সালের ২৩ মে বিজ্ঞানী ব্রুনোর বন্দি করে তার উপর শুরু হয় নির্যাতন,টানা আট বছর ধরে সীসের ছাদের নিছে রেখে বিচারের নামে
প্রহসন চালায়,শেষে বিচারের রায় হল 'পবিত্র গির্জার আদেশে পাপি ব্যক্তির এক বিন্দু ও রক্ত নষ্ট না করিয়া হত্যা। অর্থাৎ আগুনে পুরিয়ে হত্যা ১৬০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হল এক বধ্যভুমিতে। তার জিভ শক্ত করে বাঁধা ছিল, যাতে শেষ বারের মত ও তার আদর্শের কথা না বলতে পারে,আগুনে পুরিয়ে এই বধ্যভুমিতে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে হত্যা করা হল। এই হল ব্লাসফেমি আইনের
নির্মম নিষ্ঠুর পরিনাম।
এখানেই শেষ নয়,ব্রুনোর পর ব্লাসফেমির আরেক শিকার বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তার শেষ আট টি বছর কারাগারে দিনকাটায় এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনেক দন্দ রয়েছে , এক পীর অন্য পীর কে কাফের ফতোয়া দেওয়ার ও দৃষ্টান্ত রয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কোরআন ও নবীর অবমননাকারী দাবী করেছে এই দন্দের কেও কি সমাধান দিতে পারবে?
পাকিস্তান আমলে একবার লাহোরে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হয়েছিল।তখন প্রধান বিচারপতি মুনীম এর নেতৃত্বে একতা কমিশন হয়েছিল।তিনি নেতৃস্থানীয় আলেমদের আলাদা ভাবে জিজ্ঞাস করেছিল মুসলমানের সংজ্ঞা কি? আলেমরা সবাই
ইসলামি মতে সংজ্ঞা দিয়ে ছিল। সেই বিচারপতি তার জীবনিগ্রন্থে লিখে ছিলেন,আমি মিলিয়ে দেখলাম ,একটা সংজ্ঞার সাথে আরেকটা সংজ্ঞার কোন মিল নাই,এমন কিছু সংজ্ঞা ছিল যা আরেকজনেরে সংজ্ঞায়িত মুসলমানকে কাফের করে দেয়।
একবার নজরুল আক্ষেপ করে বলেছিলেন"আজ বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একজন চিত্র শিল্পী
নাই,ভাস্কর নাই,সঙ্গীতজ্ঞ নাই,বৈজ্ঞানিক নাই,ইহা অপেক্ষা লজ্জার কি আছে?এই সবে যাহারা জন্মগত প্রেরনা লইয়া আসিয়াছিল,আমাদের গোঁড়া সমাজ তাহাদের টুটি টিপিয়া মারিয়া ফেলিয়াছে ও ফেলিতেছে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের সমস্ত শক্তি লইয়া বুঝিতে হইবে।নতুবা আর্টে বাঙালি মুসলমানের দান বলিয়া কোন কিছু থাকিবে না।পশুর মত সংখ্যাগরিষ্ঠ হইয়া বাঁচিয়া আমাদের লাভ কি,যদি আমাদের গৌরব করিবার কিছু না থাকে । ভিতরের দিকে আমরা যত মরিতেছি,বাহিরের দিকে তত সংখ্যায় বাড়িয়া চলেতেছি"