আজ ১৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিরাপদ চলাচলের প্রতীক “সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস” পালিত হতে যাচ্ছে। প্রতিবারের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়ে থাকে। এবার পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির কারণে ১৫ অক্টোবর পালন করার ক্ষেত্রে ঐদিনটির পরিবর্তে অনেকে ঈদের পর দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সাদা ছড়ি কেবল মাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মানুষকে নয় দৃষ্টিমান মানুষদেরকেও নানাভাবে সহযোগিতা করছে। সাদা ছড়ি দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে একটি দিনের জন্য হলেও আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের জন্য বিশেষ করে ভাবছি। সাদা ছড়ি দিবস আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবরতনেও বিশেষভাবে সহযোগিতা করে থাকে। আমাদের মধ্যে অনেকে আছে যারা তাদের সন্তানের প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চান। যা আমাদের সন্তানদের সামাজিকীকরনের ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায় হয়ে থাকে।
এ দিবস দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সকলের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নিরাপদে আত্মবিশ্বাসের সাথে এবং স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের এই সাদাছড়ি একটি প্রতিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্বাধিন ও মুক্তভাবে চলার ক্ষেত্রে সাদা ছড়ি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বড় উপকরণ। সাদা ছড়ি তাদের জন্য আ্ডি কার্ডের মতো। সাদা ছড়ি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি মানুষদের আত্নবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা যেতে পারে সাদা ছড়ি তাদের জন্য ক্ষমতায়নের রাস্তা তৈরি করেছে। তবে অভিজ্ঞরা মনে করেন, সাদা ছড়ি ব্যবহারের জন্য উপর্যুপরি প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন। যেমন একজন গাড়ি চালককে সবসময় সতর্ক থাকতে হয় তেমনি সাদা ছড়ি ব্যবহারকারিকেও সতর্ক থাকতে হয় তা না হলে দু:র্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।সাদা ছড়ি হাতে কোনো মানুষকে দেখে সমাজের অপরাপর মানুষজন বুঝতে পারে যে সে ব্যক্তি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তাই, চলার পথে প্রয়োজনে সহায়তা দিতে সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন। চলার পথে কোনো বিঘ্ন থাকলে কণ্ঠ নির্দেশে সচেতন মানুষ সতর্ক করে দেয়। রাস্তা পারাপারে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ির চালক গাড়ি থামিয়ে এবং সমাজকর্মীরা তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন। এভাবে ‘সাদা ছড়ি’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাধীনতার, মুক্তভাবে চলাচলের, নিরাপদে চলাচলের/ভ্রমণের আত্মনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
সাদা ছড়ি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনে এনেছে কাঙিক্ষত পরিবর্তন, এনেছে আত্মবিশ্বাস আর মুক্ত স্বাধীনভাবে নির্বিঘ্নে চলাচলের ক্ষমতায়ন। এ দিবসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- “সাদা ছড়ি” অন্ধত্বের প্রতীক নয় বরং সাদা ছড়ি দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মানুষের ক্ষমতায়নের প্রতীক।
১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসের উদযাপনের উদ্দেশ্য হলো-
১।দদ দক দদদ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ আমাদের জীবনে এই দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করা।
২। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মেধা, কৌশল, প্রতিভা ইত্যাদিকে মূল্যায়ন করতে তাদের সফল জীবন কাহিনী জনসম্মুখে তুলে ধরা।
৩। দিবসটির তাৎপর্য জাতীয় জীবনে অর্থাৎ জনগণের কাছে তুলে ধরতে গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৪। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে এবং তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত করা।
এই দিবস উদযাপনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে-
ক) আমেরিকা সরকার ৬ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে ঘোষণা করেন যে, সে বছর ১৫ অক্টোবর সারাদেশে জাতীয় সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস উদযাপন করা হবে এবং অদ্যাবধি সে দেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে।
খ) ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের মি. জেমস্ বিগ্স নামের এক ফটোগ্রাফার দুর্ঘটনায় তার দৃষ্টিশক্তি হারালে তার পথ চলার জন্য লাঠিটাকে সাদা রঙে রঞ্জিত করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিসেবে অপরের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
গ) ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়িস পিওরিয়া, লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট জর্জ বেনহ্যাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের লাঠিতে লাল রঙের ব্যান্ড জড়িত করে অপরাপর দৃষ্টিমান ব্যক্তিদের সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে সূচনা করেন।
ঘ) এরপর গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বজুড়ে লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে চক্ষুষ্মমান এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একে অপরকে সহায়তার হাতিয়ার হিসেবে সাদা ছড়ি বিতরণ কার্য শুরু করেন।
ঙ) ১৯৩১ সালে ফ্রান্সের মি. গুইলি ডি. হারবিমোন্ট সে দেশে “জাতীয় সাদা ছড়ি মুভমেন্ট” হিসেবে ১৫ অক্টোবরকে ঘোষণা ও প্রচলন করেন এবং সে বছর প্যারিসে ৫০০০ সাদা ছড়ি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করেন।
চ) শ্রীলংকায় এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ৭০ দশক থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে।
ছ) বাংলাদেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ৭০ দশক থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে।
জেনে রাখা ভাল যে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে বা তার আরো পূর্ব থেকে ছড়ি ব্যবহার করে আসছে তাদের নিরাপদ চলাচলের হাতিয়ার হিসেবে। তথাপি ১ম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ছড়ি/লাঠি-ই যে তাদের চলাচলের উপযুক্ত যন্ত্র, তা স্বীকৃত ছিল না।
বাংলাদেশ সরকার এ দিবসকে সামনে রেখে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও অপরাপর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনে ইতিবাচক সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা দিয়ে থাকে।
ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাসিক ভাতা, চাকুরির কোটা, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন করা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা, যানবাহনে বিশেষ রেয়াতে চলাচলের আসন সংরক্ষণ করা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা খরচায় লেখাপড়ার সুযোগ দান, ইশারা ভাষার প্রচলন ও ব্রেইল বই এর সহজলভ্যতা ইত্যাদির সুব্যবস্থা করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনে সম-অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আগামীতে এদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের অধিকার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পাবে এবং দেশমাতৃকার গঠনে ও মূল স্রোতধারায় তাদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৩:০৮