দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির নিবন্ধন বাতিলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেই সাথে আরও ২৭টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন হারাতে পারে। সিপিবি, গণফোরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশসহ ২৮টি রাজনৈতিক দলকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই হবে। কারণ পরপর দুইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বিরত থাকলে আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থাকে না।
কোনো কারণে যদি তারা নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। ওই ২৮টি দল বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে নিবন্ধন রক্ষা করতে হলে আগামী নির্বাচনে তাদের অংশ নিতেই হবে। ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২ সংশোধন করে কোন দল পরপর দুইবার নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধনের অযোগ্য ঘোষণার বিধান সংযোজন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, যে সব রাজনৈতিক দল বিগত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি সেইসব দলকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নতুবা আইনানুযায়ী ওইসব রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আপনা-আপনি বাতিল হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে, পরপর দুইবার নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন থাকবে না।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (৯০এইচ)(১) দফায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের এ নির্দেশনা রয়েছে। ওই দফার (ই) উপ-দফায় উল্লেখ রয়েছে, কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল পর পর দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নিবন্ধন বাতিল হবে। তবে তাদের নিবন্ধন বাতিলের আগে ওই দলগুলোর বক্তব্য শুনতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। (৯০এইচ)(২) দফায় এই বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
এছাড়া উল্লেখ রয়েছে, শর্ত থাকে যে দফা (১)-এর (সি), (ডি) ও (ই)’র অধীন নিবন্ধন বাতিলের পূর্বে কমিশন নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে শুনানির সুযোগ প্রদান করবে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (৯০এইচ)-এর (১) ও (২) দফা পরস্পরবিরোধী। কেননা আরপিওতে যেখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে পরপর দু’বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নিবন্ধনের অযোগ্য হবে, সেখানে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকলেও নিবন্ধন বহাল রাখার কোন সুযোগ আইনে নেই।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম আসাদুজ্জামান বলেন, শুনানির বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। ফলাফল যেখানে আইনে নির্ধারিত, সেখানে শুনানির প্রয়োজন কি? আইনের এই অস্পষ্টতা অনেক সময় জটিলতা তৈরি করে। এ কারণে কোন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হলে বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে ৪১টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত। ওই দলগুলোর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি দল অংশ গ্রহণ করেনি।
এগুলো হলো- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাকের পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) এবং বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট। এর বাইরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। ফলে এ দলটির ওই রায় বহাল থাকা পর্যন্ত নির্বাচন করারই সুযোগ নেই।
গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩শ আসনের মধ্যে ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ১২টি দল অংশগ্রহণ করে। দলগুলো হলো- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং গণতন্ত্রী পার্টি।
বিষয়টি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে সময় নিবন্ধিত ৩৮টি দলের সবগুলোই অংশ নিয়েছিল। সে কারণে ওইসব দলের মধ্যে যেসব দল ১০ম জাতীয় সংসদে অংশ নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নেই। তবে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ২৮টি দল অংশ নেয়নি, সেসব দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। তবে এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দলগুলো উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস রয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের। দেশে এ পর্যন্ত দশটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। তবে পরপর দু’বার কোন সংসদ নির্বাচন থেকে বিরত থাকেনি এসব রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ইস্যুতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল, একই ইস্যু বর্তমানেও বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে শাসক দলও সংবিধানের কাঠামোর বাইরে গিয়ে সমঝোতায় অংশ নিবে না। ফলে কি প্রক্রিয়ায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নিবে তার মীমাংসা ভবিষ্যতের হাতে।
সুত্রঃ এমটিনিউজ২৪