পিঠের উপর শটান শটান ব্যাতের মার খেতে খেতে উঠোনের মাটির উপর নুয়ে গেছে শিউলির দেহ। পাতলা সুতি কাপড়ের থ্রিপিস জামাটি শিউলির শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ব্যাতের প্রতিটি আঘাত পিঠের চামড়া পেটে পিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। পিঠের উপর গোলাপী রঙ্গের জামাটি রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। দুহাতে মুখ চেপে ধরে নিজের কষ্ট আর যন্ত্রনার গগন বিধারী আর্তনাদ থামিয়ে রেখেছে শিউলি। একটু পরপর মুখটাকে উপরের দিকে তুলে অত্যাচারী পঞ্চায়েতের দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকায়! আর কতক্ষন ধরে আমাকে মারবেন? আরতো সহ্য করতে পারছি না, এরকম একটা আকুতি চোখে তার মুখে ফুটে উঠে। পঞ্চায়েত মোশারফ মিঞার হাত চলছেই। কমসেকম ৭০টার মত বেত্রাঘাত করতেই হবে তাকে। এটা সকলের সম্মতিক্রমে শিউলির কৃত অপরাধের শাস্থী। মোশারফ মিঞা সমাজের অনেক প্রভাবশালী পঞ্চায়েত। সব শালিশ-বিচার এবং শাস্থী মোশারফ মিঞা তার নিজ হাতেই করে থাকেন।
লতিফ শহুরে ছেলে, চট্রগ্রাম কোন একটা গার্মেন্টসে চাকরি করতো। চাকরিতে কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো, চন্ডিগ্রামে তার খালার বাড়ীতে এসে থাকছে সপ্তাহ খানেক ধরে। গোলগাল চেহারা আর কথা বলার সুন্দর বাচনভঙ্গিতে যে কাউকে সহজে আকৃষ্ট করতে ফটু লতিফ। লতিফের খালার বাড়ীতে প্রবেশের যে রাস্তা ঠিক উল্টা দিকে যে বাড়ীটি ঐ বাড়ীতেই শিউলিরা বসবাস করে। গ্রামটা বলতেগেলে একদম নিরব নিস্তব্ধ কবরস্থান প্রকৃতির মনে হচ্ছে লতিফের কাছে। কোন হইহল্লোড় নেই, ঝগড়াঝাটি নেই, মানুষে মানুষে কোন বিবেধও নেই। যারযার মত সবাই নিজেদের কর্ম নিয়ে ব্যাস্ত। অবশ্য খালার কাছে শুনেছে এ গ্রামের সমাজপতিরা অনেক ক্ষমতাবান এবং রক্ষনশীল। কেউ নিয়মের বাহীরে কোন অন্যায় কাজ তেমন একটা করেনা। করলে তার পরিনাম খুবই বয়াবহ হয়।
শিউলি লক্ষ্য করে রাস্তার মাথায় একটি ছেলে প্রায়ই দাড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে সে যখন বাড়ীর দরজার পুকুরঘাটে কোন কিছু ধোয়ামুচা অথবা স্নান করতে যায়। রাস্তার ওখানটায় শুধু ঘাটের উপরিভাগটা দেখা যায় বিধায় শিউলির তেমন কোন সমস্যা হয়না। তাছাড়া কোন সমস্যার কথা শিউলি কখনো ভাবেওনা। সহজ- সরল, সাদা- মাটা বলতে যা বুঝায় শিউলি অনেকটা তেমন। সহজ-সরল বলে মা মনোয়ারা বেগমের মুখে কম গালাগালও শুনতে হয়না তাকে। মায়ের অভিযোগ মেয়েটা তার আস্ত একটা ঘাধা হয়ে জন্মেছে। কোন কিছু একাদিকবার বুঝিয়ে দিলেও ভুল করবে। শিউলির অবশ্য নিজের জ্ঞানের ব্যাপারে একটুও কোন আক্ষেপ নেই। তার হিসাব আমিতো কখনো স্কুলে যাইনি, আমার জ্ঞান-বুদ্ধি থাকবেনা এটাইতো স্বাভাবিক। এ জন্য মনোয়ারার সকল অভিযোগ সে সানন্দে মেনে নেয়।
শিউলির বাবা তার জন্মের আগে থেকেই অনেকটা থেকেও নেই । তার জন্মের আগে কি জানি কি রোগ হয়েছিলো মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সমাজের সবাই তাকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি হিসেবেই চিনে। এদিক সেদিক বেতাল গুরাগুরি আর বাচ্ছা ছেলেরা ক্ষ্যপালে তাদের তাড়িয়ে সময় কাটান তিনি। সংসারে অভাবের তাড়না নিত্যদিনের। মা মনোয়ারা এবাড়ী-ওবাড়ী কাজ করে বহু কষ্টে সংসার চালান। দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপর দোচালা টিনের ঘর দিয়েছিলো তারও জন্মের আগে বাবা সুস্থ থাকা কালিন। অনেক পুরনো ঘরের চালে কিছুকিছু স্থানে ফুটো হয়ে গেছে! বর্ষা এলে ভোগান্তির শেষ নেই। বৃষ্টির পানিতে ভিটা কর্দমাক্ত হয়ে যায় সবসময়। এতসব সমস্যা শিউলি কখনোই মাথায় নেয়না। তার ধারনা মানুষের জিবনই হয়তো এরকম।
শিউলি জানেনা তার সঠিক বয়স কত। কখনো মাকে জিগ্যাসা করেনা তার জন্ম কত সালে হয়েছিলো। তবে বিয়ের বয়স হয়েছে সেটা সে উপলুব্দি করকে পারে। তার বিয়ে নিয়ে মা মনোয়ারারও কোন তোড়জোড় নেই। দেখতে একদম সুন্দর না হলেও যথেষ্ট মায়াবতী চেহারা তার। শরীরের গঠন খুব বেশি সুঠাম না হলেও একদম হালকা পাতলা নয়। গ্রামের জীবন যাত্রার মান অনুযায়ী শিউলিকে অন্য সবার চেয়ে সবমিলিয়ে সুন্দরীই বলা যায়।
লতিফের খালার বাড়ীতে একদিন মেহমান আসবে। রান্নাবান্নার কাজ অনেক, সকাল সকাল সব কাজ গুছিয়ে নিতে হবে । মনোয়ারাকে ডেকে পাঠানোর জন্য লতিফকে তার খালা শিউলিদের বাড়ীতে যেতে বললো। শিউলি বাড়ীর উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলো। পিচন থেকে কেউ একজনের ডাকে সোজা হয়ে পিচনে তাকিয়ে দেখে ঐ ছেলেটি। সব সময় রাস্তার মাথায় যে দাড়িয়ে থাকে। একটু ইতস্তত বোধে শিউলি জিগ্যেস করে - কে আপনি? আমার নাম লতিফ, সামনের ঐ বাড়ীর মেহমান, বেড়াতে এসেছি, থাকবো কিছু দিন, তুমি অনেক সুন্দর। শিউলি লতিফের একনাগাড়ে কথাগুলো এবং শেষে তুমি অনেক সুন্দর কথাটি শুনে ব্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কি বলবে খুজে পায়না, মনে মনে পুলকিত হয়, ছেলেটির মুখে প্রশংসা শুনে। এর মধ্যে মনোয়ারাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পুরুষ কন্ঠ শুনে। লতিফ তাকে দেখেই, পরিচয় দিয়ে তার খালাম্মার ডাকার কথা মনোয়ারাকে বলে। মনোয়ারা যাওয়ার জন্য যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। হ্যা চলো যাই, উনি ডাকলেতো আমি কখনোই না করিনা। একথা বলেই সামনের দিকে হাঁটা দরে মনোয়ারা সাথে লতিফও। লতিফ আর শিউলির সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি। পিচনে একবার তাকিয়ে দেখলো, দেখলো শিউলি তাকিয়ে আছে তাদের ছলে যাওয়ার দিকে। চোখাচোখিও হলো, শিউলি সংকোচিত হয়ে কোমর বাঁকিয়ে আবার ঝাড়ু দিতে শুরু করে। "লতিফের দৃষ্টি অনেক প্রখর, সে বুঝতে পারে, শিকারের ডানা ভাঙ্গাই মনে হচ্ছে। কোন ফাঁদ পাততে হবেনা সম্ভবত। এমনিতেই শিকার হয়ে যাবে।"
লতিফ মনোয়ারাকে বাড়ী পৌঁচে দিয়ে আবার বের হয়। উদ্দেশ্য শিউলিদের বাড়ী। পুকুর ঘাটে একজন বৃদ্ধকে দেখে একটু থেমে গিয়েছিলো, পরে বুঝতে পারে শিউলির বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি বাবা হবে হয়তো। লোকটি ঘাটের উপর শুয়ে আছে আকাশের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে। পুকুর ঘাট পাশকাটিয়ে বাড়ীতে ডুকবে এসময় দেখে শিউলি কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে পুকুরের দিকেই আসছে। শিউলি দাড়িয়ে গেলো লতিফকে দেখে। লতিফ শিউলির একদম সামনে গিয়ে দাড়ায়। 'তোমার সাথে একটু কথা আছে চলো ভিতরে চলো' বললো লতিফ। শিউলি লতিফের এমন সহজলব্য কথাবলার ভঙ্গিতে দ্বীধা দন্দের মধ্যে পড়ে যায় কি করবে সে। লতিফের কথাই অনুসরন করবে! নাকি নিজের কাজের দিকে যাবে। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে সে। কি হলো চলো, লতিফ একটু নরম কন্ঠে দ্বিতীয়বার তাকে ভিতরে যেতে বললো। নিজের অজান্তেই শিউলি বাড়ীর দিকে গুরে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো, লতিফ একটু আগবাডিয়ে হাঁটছিলো।(চলবে)
একদম নতুন লিখিয়ে। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখলে কৃতজ্ঞ হইবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৩২