রেশমার চতুর্দিক আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত। তার এ দুঃসময়ে একান্ত আপন জনরাও কাছে নেই। পাড়া পড়শিতো দুরের কথা আপন সংসারের স্বামী, সন্তানরাও তাকে ধিক-ধিক করে দুরে ঠেলে দিচ্ছে। দোচালা ঘরের পিচনের দিকে খোলা বারান্দায় পাটি বিচিয়ে শুয়ে আছে সেই ভোর থেকে। দুপুর ঘড়িয়ে বিকালের স্নিগ্ধ চায়া নামে নামে ভাব। রেশমার খোজ নেয়না কেউ। সকালেও কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরের খাওয়ার সময়ও এর মধ্যে পার হয়ে গেছে। কেউ একটিবার খোঁজও নিলোনা রেশমা খেয়েছে কিনা। গতকালওতো এমন ছিলোনা, রেশমাইতো সবাইকে রান্নাবান্না করে ভাত বেড়ে দিতো। কতইনা সুখের সংসার তার। তবে আজ কেন এমন হলো, মনে আসতেই ডুঁকরে ডুঁকরে কাঁদে রেশমা। সেই সকাল থেকে কেঁদেই যাচ্ছে, তার কান্না থামানোর কেউ নেই। আকাশের ডাক শুনা যাচ্ছে, কালো মেঘের আচ্ছাদন জানান দিচ্ছে কিচুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। একটু পরই বিকট গর্জনে আকাশ ছেড়ে দিয়েছে তার প্রবল বর্ষনের বাঁধ। অঝোড় ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আর রেশমার বুকে চলছে কাল বোশেখির ঝড়। কান্নার রোল, সাথে চোখের পানিতে প্রকৃতির বর্ষন আর গর্জনকে হার মানাচ্ছে যেন।
ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং........
রাত ১.৪০মিনিট তখন। রেশমার ফোনে রিং হচ্ছে । গভির ঘুমে নিমগ্ন সে। এত রাতে রেশমার ফোন কখনো এর আগে বাজেনি। ফোনের রিংয়ে জেগে উঠে ফোন কানে ধরলো । হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে একটি ভরাট কন্ঠ..... আসসালামু আলাইকুম..... হক্ মাওলা। ওয়ালাইকুম সালাম, কে বলছেন- রেসমা প্রশ্ন করে।
-খামোশ......তোর নাম কি রেশমা?
-জ্বি...... রেশমা ভয় পেয়ে যায় লোকটির ভরাট কন্ঠে 'খামোশ' শব্দ শুনে।
-তোর ছেলে-মেয়ে দুজন? জ্বি-
-তোর স্বামী বিদেশ থাকে? জ্বি-
-তোর বাড়ী নোয়াখালী লক্ষিপুর? জ্বি-
-পড়া লেখা একদমই করিসনি, ঠিক? জ্বি-
হক্ মাওলা................
আপনি আমার সব কিছু জানেন, কে আপনি একটু বলবেন (কাঁপা কাঁপা ভীত সন্ত্রস্ত গলায় রেশমা প্রশ্ন করে)?
-খামোশ...রেশমা! কথা কম বলবি,...... শুধু শুনবি.......। আমি কে জানবি, ধীরে ধীরে সব জানবি। শুধু এটুকুন জেনে রাখ.... 'বাবা' বাবা বলে ডাকবি আমাকে। আমি জাগতিক কোন প্রানী নই। গভির রাতে বিশেষ প্রয়োজনে জমিনে নেমে আসি। শ্রষ্টা আমাকে মাঝে মাঝে পাঠান, তার প্রিয় বান্দাদের উপকার করার জন্য। তোর উপর সৃষ্টিকর্তা খুবই সন্তুষ্ট। তবে তোর কিছু ভুল-ভ্রান্তি আছে সেগুলো তুই শুদ্ধ করবি। রাত্রি বেলায় কম ঘুমাবি, বেশি বেশি শ্রষ্টাকে ডাকবি। আমার কথা কাউকে বলবিনা খবরদার। তাহলে ইহজগত পরজগত সবই হারাবি। তোর মঙ্গলে আমি আবার তোকে ফোন দেবো। তবে রাত্রি বেলায়, গভির রত্রিতে। যাহ, ঘুমাহ...নিশ্চিন্তে ঘুমাহ্....খোদা হাফেজ... হক্ মাওলা।
রেশমার মন আনন্দে চটপট করতে থাকে। শ্রষ্টা তার উপর সন্তুষ্ট, তাকে উপকার করার জন্য একজন বাবাকে পাঠিয়েছেন। সেদিন আর ঘুমায়নি রেশমা, এবাদত বন্দেগী করেই কাটিয়ে দিয়েছে সারা রাত।
পরেরদিন ঠিক রাত ২টায় বাবার ফোন। আজকে আর রেশমা ঘুমায়নি, জিকির আজগার করছিলো। ফোন ধরে রেশমা সালাম দিলো। বাবা কেমন আছেন বলতেই, ওপাশ থেকে বাবা ধমকের শুরে খামোশ.... আমাকে কেমন আছি জিঙ্গেস করবিনা। আমাদের শ্রষ্টা কোন রোগ-বালাই দেননা। বাবা ক্ষমা করবেন, আমিতো জানিনা তাই জিগাইলাম। বাবার প্রতি রেশমার অগাধ বিশ্বাস জোরালো হতে থাকে ক্রমেই।
শোন রেশমা, তোর প্রতি শ্রষ্টা খুশি হয়ে তোকে কিছু পুরুষ্কার দেয়ার জন্য আমাকে নির্দেষ করছে। তোর অভাব অনটন, তোর বাচ্ছাদের পড়া লেখার খরচের চাহিদা পুরন, তোর স্বামীর কষ্টকর প্রবাস জিবন জাপনের অবসান করে দিতে শ্রষ্টা আমাকে নির্দেষ করেছেন। বাবার থেকে এগুলো শুনে চোখ বড়বড় হয়ে উঠে। যেন স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে সে। বুকের মধ্যে উত্তেজনায় দুপদাপ করতে শুরু করেছে। আসলেই তার সব সমস্যা অবসান হয়ে যাবে? মনে মনে আলাদিনের দৌত্যের গল্পের কথা মনে পড়ে। আল্লাহ আমার খুশি হওয়ারইতো কথা আমিতো আর কোন পাপ কাজ করছিনা। ফোনের ওপাস থেকে কর্কষ ডাক শুনে রেশমার বিভোরতা কাটে। জ্বি বাবা বলেন, রেশমা উত্তর দেয়।
শুন রেশমা, ভালো থাকার জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোর কিছু সম্পদ। আমি তোর জন্য ৫ পাতিল স্বর্ণমুদ্রার ব্যবস্থা করেছি। খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে তুই স্বর্ণ মুদ্রা ভর্তি ৫টি পাতিল পেয়ে যাবি। তবে খবরদার পাওয়ার আগ পর্যন্ত তুই ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে যদি বলিস! পাতিলতো পাবিইনা বরং তোর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। রেশমার আনন্দের সিমা নাই, খুশিতে চেহারার একদম আকৃতিটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাবার নির্দেষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার কথা বাবাকে সাচ্ছন্দে জানিয়ে দিতে একটুও দেরি করেনি সে।
বাবা স্বর্নমুদ্রা পাওয়ার পদ্ধতি বাতলে দেয়। পাঁচ পাতিল স্বর্ণমুদ্রাগুলো তোর থেকে কয়েক শত মাইল দুরে আছে। এগুলো তোর কাছে আনতে হলে তোকে একটা পদ্ধতি অনুসরন করতে হবে। কোন সমস্যা নাই বাবা বলেন, আপনি যা করতে বলবেন আমি তাই করমু।
-তোর কাছে অল্প সল্প কিছু স্বর্ন আছে তাইনা?
-জ্বি বাবা, ১০ ভরির মত আছে
-নাহ! তা দিয়ে হবেনা। বাবার বিরক্তিকর মন্তব্য
- কয় ভরি লাগবে বাবা?
- কমসে কম ৩০ ভরি লাগবে
- বাবা আমি ব্যবস্থা করতে পারবো, কি করা লাগবে আপনি সেটা বলেন।
-হ্যা, তোর উপর আমার ভরসা আছে, পারবি তুই। ঠিক আছে, তুই ব্যাবস্থা করে সব গুলো একসাথে করে একটা পেকেট করবি। হয়েছে কিনা আগামীকাল রাত্রে জানাবি। বাকিটা তখন জেনে যাবি। খোদা হাফেজ.....হক্ মাওলা।
সকাল হতেই রেশমার নেমে পড়েছে কাজে। বাড়ীর সবার কাছেই যথেষ্ট বিশ্বস্ত সে। একদিনের জন্য যারযার ব্যবহার্য স্বর্নগুলো একবার চাইতেই তাকে দিয়ে দিয়েছে আশপাশের পড়সিরা। নিজেরটা এবং পড়সিদের গুলো মিলিয়ে সাত্র ১৭ ভরি হলো, আরো ১৩ ভরি কম। মাথায় আসলো স্বর্নের দোকানে জমি বন্ধক রেখেতো স্বর্ন নেয়া যায়। বাড়ীর পাশে একটি মাত্র ধানি জমিটি স্বর্ণকারের কাছে বন্ধক রেখে ৩০ ভরি স্বর্ন মিলিয়ে ফেললো সে। রেশমা পেকেটটি প্রস্তুত করে বাবার ফোনের অপেক্ষা করছে মধ্যরাত পর্যন্ত ।
ঠিক রাত একটায় বাবার ফোন।
সালাম দিয়ে হক্ মাওলা... বলে শুরু করলেন বাবা। রেশমা আজকে তুই এবাদত বন্দেগী একদমই করিসনি। আগামী কালকে বেশি করে করবি। নসেত আমার জবাব দিহি বেড়ে যাবে মনে রাখিস। বাবা, জ্বি- একটুও ভুল হবেনা। আমি ৩০ ভরি স্বর্ন রেডি করে পেকেট করেছি বাবা । খামোশ.... আমি জানি সবই জানি। তুই পারবি, তাইতো তোর কাছে শ্রষ্টা আমাকে পাঠিয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যে তোর ফোনে একটা আকাশ বার্তা যাবে। জানি তুই পড়তে পারবিনা, তাই বলে দিচ্ছি কি করবি । বার্তায় একটা ঠিকানা থাকবে। পেকেটটা নিয়ে তোর নিকটবর্তি কোন একটা কুরিয়ার সার্ভিসে যাবি। বার্তার ঠিকানাটা তাদেরকে দিয়ে পেকেটের উপর লিখিয়ে রেখে আসবি। পেকেটটি ঐ ঠিকানার দিকে যে গতিতে যাবে ঠিক সে গতিতে কয়েকশত মাইল দুর থেকে ৫ পাতিল স্বর্ণমুদ্রা তোর নিকটবর্তি হতে থাকবে। যাহ্ এবার ঘুমিয়ে পড়, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়। খোদা হাফেজ.... হক্ মাওলা।
রেশমা বাবার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সকাল হওয়া মাত্রই কুরিয়ার সার্ভিসে গিয়ে ৩০ ভরি স্বর্ণের পেকেটটি আকাশ বার্তাটির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। এবার অপেক্ষা শুধু ৫ পাতিল স্বর্ণমুদ্রা কতক্ষনে, কোন পথে, কার মাধ্যমে তার কাছে এসে পৌচবে। না সারাদিনেও কোন খোজ আসলোনা। হতে পারে অনেক দুরে হওয়াতে দেরি হচ্ছে। বাবার কথায় আস্তাহীনতা মনে আসলেই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিশ্চিন্ত মনে অগাধ বিশ্বাসে অপেক্ষা থাকে রেশমা। রাতে নিশ্চয় বাবা ফোন দিবে। তখন কতদুর আসলো জানা যাবে। রাত দেড়টা বাজে, একটু পরই বাবা ফোন দিবে হয়তো। দেড়টা- দুইটা পার হয়ে আড়াই বেজে গেছে, বাবাতো ফোন দিচ্ছেনা। রেশমার এবার একটু কেমন কেমন লাগছে মাথাটায় যেন। সেতো কখনো বাবাকে ফোন দেয়নি। এখন কি দেয়া ঠিক হবে! অনেক চিন্তা ভাবনার পরে সিদ্ধান্ত নিলো ফোন একটা দিয়েই দেখি। বাবার নাম্বারে ফোন করতেই একটি নারী কন্ঠ- "দুঃখিত, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি আর ব্যবহারিত হচ্ছেনা"। বার বার একই কন্ঠই বাজতেছে বাবার নাম্বারটিতে। রেশমার আর তর সয়না, ৩০ ভরি স্বর্ন যদি সে হারিয়ে ফেলে। যদি ৫ পাতিল স্বর্ন সে না পায় তার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। হলোও তাই! বাবার নাম্বার থেকে এর পর আর কোন ফোন আসেনি, নাম্বারটাও আর খোলা পাওয়া যায়নি। প্রভাতের আলো নামতেই সবাইকে বিষয়টা বলার পর রেশমাকে ঘিরে ধরে নতুন অমানিশার অন্ধকার। সব আলোর চটাক তাকে নিভৃত করে দিয়ে প্রচ্ছন্ন অন্ধকারে সে ডুবতে থাকে।
সন্ধা নামে নামে প্রায়, সারাদিনের উপোস রেসমার পেটে এখনো একটু ক্ষুদা নেই। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে অনেক্ষন হলো। রেশমার কষ্টের নোনা বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন নেই। নিজের শেষ সম্বল, পড়সিদের একদিনের জন্য নেয়া স্বর্ণগুলো,, একটি মাত্র জমি সবকিছু কিভাবে সামাল দিবে সে, ভাবতেই নিজেকে নিজে খুন করতে মন চাচ্ছে তার। ছেলে মেয়েরা সম্ভবত মায়ের উপর রাগ করে আত্মিয়ে বাসায় ছলে গিয়েছিলো। অন্ধকার প্রকট থেকে আরো প্রকট হচ্ছে। ঘরে একটি বাতি জ্বালাবে এমন কেউ নেই। সেদিনের অন্ধকারেই কি নিভিয়ে দিয়েছিলো রেশমা নিজের জিবন প্রদিপ! তা আর জানা যায়নি।