সুইমের আইফোন কিংবা স্যামসাং গ্যালাক্সি এস-৫ নাই! কুটিপতি বাবার সন্তান! তবুও কেন থাকবেনা? তাই তাঁর অনেক দুঃখ! বাবার হিসেব হচ্ছে, ছেলেরতো আগে জেএসসিটা পার করা চাই, তারপর না হয় এসব দেয়া যাবে। কিন্তু সুইমের দুঃখের অন্ত নেই। তার বন্ধুদের প্রায় প্রত্যেকেরই কারো আইফোন-৫, কারো হাতে গ্যালাক্সি এস-৫ কমসেকম একটা স্মার্টফোনতো আছেই। ডিজিটাল যুগের শিশুদের খেলার উপকরন এখন এগুলো। মাল্টিমিডিয়া, ইন্টারনেট, ব্লগিং, চ্যাটিং, ট্যাগিং শিশুদের আষ্ঠে-পৃষ্ঠে মিশে গেছে।
রাজধানীর ক্যামব্রিয়ান স্কুলের পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে সুইম। ক্যামব্রিয়ানে ভিত্তবানদের সন্তানরা ছাড়া পড়ার সুযোগ আর কারো নাই। খরচপাতি অনেক এক্সট্রিম হওয়াই এর কারন। স্কুলে নিজেদের গাড়ীতেই আসা যাওয়া করে সুইম। বাহিরের জগত সম্পর্কে তার তেমন একটা ধারনা নেই বললেই চলে। তার ধারনা তার বয়সি ছেলে মোয়েদের রাস্তাঘাট কিংবা বাহিরে বের হওয়াটা খুবই বিপদজনক। ছেলে ধরার খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
স্কুলে যাওয়ার পথে একদিন একটা ঘটনা ঘটেছিলো। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামের মধ্যে তার বয়সি একটা ছেলে তাদের গাড়ীর গ্লাসগুলো হটাৎ মুচতে শুরু করলো, এবং মুখে কি জানি সব বলছিলো। গ্লাস লাগানো ছিলো বিধায় সুইম কিছু শুনতে পাচ্ছিলোনা। সুইম ড্রাইভার আংকেলকে জিগ্যেস করলো আঙ্কেল ছেলেটা কি করতে চাইছে একং কি বলছে। আংকেল বলল "আরে এগুলো সব নর্দমার কীট! ধান্দাবাজী কইরা খায়"। সুইম আংকেলের কথার কিছুই বুঝলোনা। মনে মনে ভাবে ছেলেটির কত সাহস। বাহিরে গুরোগুরি করছে, তাও আবার রাস্তার মাঝখানে, শরীরে কেমন ময়লা জমিয়েছে, পাঁয়ের জুতোটাও কোথাও ফেলে এসেছে । আজকে নিশ্চিত বাসায় গেলে আচ্ছামত বকা খাবে।
সুইমদের মত জীবন যাত্রার মান যাদের সুপার ক্লাসের, তারা আসলে বুঝতেই পারেনা এদেশে নর্দমার কীটদের সংখ্যাই বেশী। যাদের তিন বেলার কোননা কোনটিতে অন্নহীন থাকতে হয় প্রায় সময়। পেটের ক্ষুদা যাদের নিত্তদিনের উপহাস। তাদের আবার শরীরে ময়লা কি? অথবা ছেলেধরার ভয় কি? কিংবা বাসায় গেলে বাবা মায়ের বকা খাওয়া কি?
সুইমের ড্রাইভার বিষয়টি নিয়ে সুইমের কৌতুহল উদ্দিপক দৃষ্টি দেখে মনে মনে একটু হাঁসলো। হাঁসতে হাঁসতে সুইমকে বলল, "বাবা ঐ ছেলেটা হচ্ছে একটা টোকাই। ৫-৬ বছর বয়সের ঐ টোকাই ছেলেটার কাজই হচ্ছে এগুলো। গাড়ী মুচে দিয়ে টাকা চাওয়া। দুইটাকার জন্য এজন ওজন গুরে বেড়ানো, মলিন চেহারায় কান্নাজড়িত কন্ঠে আকুতি জানানো, এর মধ্যে বড়লোকদের দুই একটা লাথি-উষ্ঠা খাওয়াতো আছেই।। পড়ালেখা কি জিনিস তারা তা বুজেনা কখনো। তোমার বাবার মত ওর বাবার অতকিছু নেই, মাথার উপরের ছালতো দুরের কথা- তিনবেলা ক্ষুদা নিবারনের ভাতটুকুও নাই। তাই খালি পায়ে- খালি গায়ে দুপুরের কর্কষ রোদের মধ্যে নেমে পড়েছে দুমুঠো ভাতের জন্য।" সুইম ড্রাইভার আংকেলের কথায় অনেকটা আকাশ থেকে পড়ার মত হতবম্ব হয়েগেছে(!)। তাঁর শিশুসুলভ চেহারায় অনেকটা কষ্টের চায়া ঝেঁকে ধরেছে। মনে মনে ভাবছে, আমার বাবার এত কিছু থাকলে তার বাবার কিছু নাই কেন? আমার বাবার অর্থ-সম্পদ, বাড়ী-গাড়ী, টাকা পয়সার একটুওতো অভাব নেই। ছেলেটার বাবার কিছুই নেই কেন? কোন উত্তর খুজে পায়না সুইম।
আমাকে আল্লাহ কতই না ভাল রেখেছে, তবুও একটি স্মার্টফোনের জন্য আমি কতইনা দুঃখ করছি, অভিমান করছি। ঐ টোকাই ছেলেটাতো কখনোই স্মার্টফোন কি জিনিস একটু চুয়ে দেখার সুযোগ পাবেনা হয়তো। সুইম মনে মনে নিজেকে সান্তনা দেয়।
সুইমের শিশুমনে সমাজের এ বৈশম্যের কোন কারন হয়তো খুজে পাচ্ছেনা। কিন্তু তার বাবার মত ভিত্তশীলরাও কি এর কারন জানেন না? জানেন! তবে, বিলাসিতার জৌলোশ তাঁদেরকে নির্বিকার এবং অন্ধ করে রেখেছে । এসব উধবাস্তু টোকাইদের পুনর্ভাসনে তাঁদের একটু সদিচ্ছার প্রতিফলনই যথেষ্ঠ, এটুকুন তাঁরা বুজেননা।।।