লোকটা বেঁচে থাকতে ভীষণ ভাবুক ছিলেন বোঝা যায়। তা না হলে কেউ কি দিনে-দুপুরে ট্রামের নিচে পড়ে! ট্রামতো আর ছোটখাটো কোনো বস্তু নয় যে খেয়াল হবে না। তাছাড়া অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রাম ড্রাইভার। তবু লোকটা ট্রামের নিচেই পড়লো। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর মুচড়ে গেলো। গুরুতর আহত লোকটার চিৎকার শুনে ছুটে আসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল। আরো কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে ক্যাচারের কঠিন কবল থেকে অতি কষ্টে টেনে-হিঁচড়ে বের করলো রক্তস্নাত মানুষটির অচেতন দেহ। কেটে, ছিঁড়ে থেঁতলে গেছে এখানে সেখানে। চুরমার হয়ে গেছে বুকের পাঁজর, ডান দিকের কন্ঠা আর উরুর হাড়। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। কিন্তু লাভ হয়নি।
৬২ বছর আগে মরে গেলো লোকটি। ২২ অক্টোবর রাতে।
কতটা ভাবুক হলে একটা মানুষ ট্রামের নিচে পড়ে মারা যেতে পারেন! কারণ গত একশ বছরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর আর কোন তথ্য নেই- একজন লোকই মৃত্যুবরণ করেছেন ট্রামের আঘাতে। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ।
রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে জীবনানন্দকেই প্রধান কবি হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো নির্বিঘ্ন জীবন তিনি পাননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। তার সারাজীবনের সংগ্রামের কথাও নিতান্তই কম নয়।
তখনকার তথাকথিত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্রাহ্ম মতাবলম্বীদের দ্বারা পরিচালিত কলেজে পড়াতেন জীবন। কলেজের অধিকাংশ ছাত্রই হিন্দু। তবু সেখানে হিন্দুধর্ম না, ব্রাহ্মই শেষ কথা। একবার বেশ কিছু ছাত্রের অনুরোধে মোটামুটি ঝুঁকি নিয়েই কলেজে লক্ষী পূজার আয়োজনের সাথে থাকলেন জীবনানন্দ। কিন্তু ব্রাহ্মরা তা মেনে নিতে পারেনি। একটা সাধারন লক্ষীপূজা তাদের কাছে হয়ে উঠল সাম্প্রদায়িক আচার। এ নিয়ে ছাত্র অসন্তোষ আর শিক্ষকদের তাতে সমর্থনের ফলে চাকরি গেলো জীবনবাবুর। ব্রাহ্ম হলেও তা যে একটা ধর্মই, এই কলঙ্কটুকু লুকাতে পারলো না তারা। যদিও কৌশলে অন্য কথা বলেছিলো কলেজ কতৃপক্ষ।
সময় যায়। চাকরি আসে, চাকরি যায়। শেষে দেশান্তরী হয়ে কলকাতা গেলেন 'স্বরাজ' পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদকের চাকরি করতে। ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় এ চাকরিটিও গেলো। নজরুলকে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে মত প্রকাশ করায় তাকে বিদায় করে দিলো এই কতৃপক্ষটিও। নজরুলের রচনার কোনো ধরণের সমালোচনা শুনতে নারাজ তারা। অনেকে ভাবে সাহিত্যের লোকেরা বোধহয় বিরাট মনের হয়। কথাটি সত্য-মিথ্যার মিশেলে। যারা বড় মনের তারা খুব বড় মনের, অন্যরা তেলাপোকার চেয়েও নিচুশ্রেণীর হয়। আর কে না জানে যুগে যুগে তেলাপোকারাই টিকে থাকে।
জীবনানন্দ দাশকে বুঝতে হলে এমন একজন কবির চরিত্রকে কল্পনা করতে হবে যিনি ছিলেন অমিত প্রতিভাবান অথচ অর্থকষ্টে পীড়িত। কল্পনা করতে হবে এমন একজন মানুষকে যিনি কবিতাকে ভালোবাসেন, লিখতে ভালোবাসেন, কিন্তু বারবার পরাজিত হতে থাকেন। জীবনের অলিতে গলিতে চলার সময় লেখা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যার পা কেটে যায় হোঁচট খেয়ে। কিন্তু তিনি থামেন না। ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে আবার উঠে দাঁড়ান। চলতে শুরু করেন। কারণ তিনি জানেন তাকে তাড়া করে ফিরছে শকুনেরা। এমন অনেক রাত গেছে হয়ত তার মাথায় গিজগিজ করছে লেখা, কিন্তু তাকে রাত জেগে হারিকেনের বাতি জ্বেলে এর কাছে, ওর কাছে টাকা ধার চেয়ে লিখে যেতে হয়েছে চিঠি। একজন লেখকের লিখতে না পারার যে যন্ত্রণা তা কবির মগজকে নীরবে খেয়ে চলেছিলো, সাথে দুশ্চিন্তা-ক্লান্তিও কি পেয়ে বসেনি তাকে?
তবু শত সমস্যা স্বত্বেও তিনি লিখে গেছেন। কখনো একটু সুযোগ পেলেই তার কলম হয়ে উঠতো তুলি। আর তিনি কাগজের ক্যানভাসে এঁকে যেতেন কাব্যচিত্র। সেই চিত্র কল্পনা করে আজও আমরা মোহিত হই। আমাদের মনে প্রেম জাগে, আমরা সুখের সন্ধান পাই। অথচ যে মানুষটির হাত ধরে আমরা বনলতা সেনদের চোখে ডুব দেয়া শিখেছি, কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে তা অনুমান কারার চেষ্টাও বোকামী।
তাঁর শেষজীবনের কথা বলা যাক। শেষ কয়েকবছর কবি জীবনানন্দ দাশ চরম অর্থকষ্টে ছিলেন। তুচ্ছ কারণে একটার পর একটা চাকরি হারিয়েছেন। কলকাতার ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। স্ত্রী লাবণ্যগুপ্তর অসুস্থতাসহ পুরো পরিবারের ভার তাকে অস্থির এবং ক্রমশ অসহায় করে তুলেছিলো। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভাড়াবাড়ির একটা ঘর সাবলেটও দিয়েছিলেন বেআইনিভাবে একজন নর্তকীর কাছে, যিনি কবি'র লেখা পড়ার পরিবেশ এবং সকল নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়েছিলেন। টিউশনি করেছেন, এমন কি বীমা কোম্পানির দালালি পর্যন্ত করেছেন। টাকা ধার করেছেন সম্ভব-অসম্ভব যে-কোনও সূত্র থেকে: ভাই-বোন, ভাইয়ের বউ, বীমা কোম্পানি, স্কটিশ ইউনিয়ন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাণী রায়, প্রতিভা বসুসহ আরো অনেকের কাছ থেকে। শোধ করেছেন ভেঙে ভেঙে।
এরপর এলো আরো কঠিন সময়- নিদারুন অর্থকষ্ট। জীবনানন্দ জানেন না আর সাত মাস পর তিনি মারা যাবেন। তাই দুইবারের মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরকে চিঠি লিখলেন। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ক্ষমতাশালী ও কবি। সে চাইলে কিছু করতে পারবে। আর কবিরের পত্রিকা স্বরাজেইতো কাজ করতেন জীবন। সে কি পারে না কিছু করতে। একমাসের মাঝে তিনটি চিঠি লিখলেন তিনি। একটারও জবাব এলো না। ছয় মাস পর জবাব নিয়ে এলো বালিগঞ্জের ট্রাম।
প্রথম চিঠিটি লিখেছিলেন ছোট করে। হয়ত আশা করেছিলেন এতেই কাজ হয়ে যাবে। মন্ত্রীর ক্ষমতার অসাধ্যতো কিছু নেই। অল্প কথাতেই কাজ হয়ে যাবে।
১৭.৩.৫৪
আমার প্রিয় মিস্টার কবির,
আপনি এখন একটা খুব প্রভাবশালী জায়গায় আছেন। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সাহিত্য, প্রকাশনা এবং অন্যান্য অনেক বিষয় আপনার সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে আছে, যাদের মাধ্যমে আপনি আমাকে কোনও একটা উপযুক্ত চাকরিতে বসিয়ে দিতে পারেন। দয়া করে কিছু একটা করুন এক্ষুনি। আশা করে রইলাম তাড়াতাড়ি করে আপনি আমাকে কিছু জানাবেন।
শুভেচ্ছা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন-সহ
আপনার জীবনানন্দ দাশ
কাজ হয় না। চিঠির উত্তর পর্যন্ত আসে না। এদিকে ঝামেলা বাড়ছেই। কবি বুঝলেন এত কম কথায় হবে না। আমাদের দরিদ্র কবি মাসখানেক পর সবটুকু কাকুতি-মিনতি জানিয়ে লিখলেন দ্বিতীয় চিঠিটি-
১৬.৪.৫৪
আমার প্রিয় অধ্যাপক কবির,
বিশিষ্ট বাঙালিদের ভিতর আমি পড়ি না; আমার বিশ্বাস, জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন’ আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কোনও কিছু – যা শেষ বিচারে একটা কোনও জিনিসের-মতন-জিনিস; – কিন্তু, ভাগ্য এমনই যে, আজ তার পেটের-ভাত জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে, যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না। আপনার কথা-মতো আমি জ্যোতিবাবুর অথবা বি.সি. রায়’এর সঙ্গে এখনও দেখা করার চেষ্টা করি নি; আমার মনে হয়, আমার মতন মানুষের পক্ষে তাঁরা দূরের মানুষ। আমি যেন অনুভব করি, আপনিই আমাদের মতন লোকের জন্য এক-মাত্র মানুষ; আপনার উপর আমার গভীর আস্থা আছে। আমি সর্বদা বিশ্বাস করি যে, আপনার নিজের পরিপূর্ণ শাসনের ভিতরে আছে, এমন কোনও একটা, আমার পক্ষে মানানসই, জায়গায় আপনি আমাকে বসিয়ে দিতে পারেন; আমাকে একটা উপযুক্ত কাজ দিয়ে দেবার মতন সুযোগ-সুবিধা আপনার খুবই আছে। আমার আর্থিক অবস্থাটা এখন এতটাই শোচনীয় যে, যেকোনো একজন সকর্মক ‘অপর’ মানুষ যে-কাজ করতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকার’এর অধীনে সে-কাজ আমারও করতে পারা উচিত। আমি মনে করি, এ-রকম একটা কাজ এক জন মানুষকে সেই সম্মানটা দিয়ে দিতে পারে, যা প্রতিটি মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে অর্জন করে নেয়; তার বেশি আমি আর কিছু চাই না। আমার দেশ আমার অস্তিত্বের স-র-মাত্রাটার সাপেক্ষে সেই যথাযোগ্য সুযোগটা আমাকে দিক, যাতে আমি আমার ন্যূনতম জীবনযাপন নিয়ে থেকে যেতে পারি। প্রাইভেট কলেজের অধ্যাপকের কাজ ক্ষুদ্র কাজ : অধিকন্তু অন্যান্য নানা কারণেও ওই কাজটা আমি আর করতে চাই না। আমার খুবই পছন্দ তেমন কোনও একটা মানানসই কাজ, যাতে অনেকটা গবেষণা করতে হয়, লিখতে হয় এবং ভাবনা-চিন্তা করতে হয়।
ইতি
আপনার জীবনানন্দ দাশ
কয়দিন পর লেখেন তৃতীয় চিঠিটিও। কিন্তু অধ্যাপকের কানে দরিদ্র কবির দুর্বল কণ্ঠস্বর হয়তো পৌঁছায় না। কোনো সাহায্য আসে না। আসে না কোনো সাহসের প্রতিশ্রুতিও। কবি হলেওতো তিনি মানুষ। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে কতোটা ভাঙ্গা যায়। মানসিকভাবে না হোক, শরীরটা একদিন ভেঙ্গে পড়লো ট্রামের নিচে। অথচ ট্রামটিকে ঠিক খুনী বলা যায় না। দয়া করে ট্রামটিই কি মুক্তি দিয়ে গেলো না কবিকে? কে জানে।
ট্রাম দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এ সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন কবি। ডাব নিয়ে কেউ আত্নহত্যা করতে যায় না। তবু অনেক গবেষক একে আত্নহত্যা কিংবা স্বেচ্ছামৃত্যু হিসেবে দেখতে চান। যদিও এর কোনো নিশ্চিত সত্যতা নেই। তবে জীবনানন্দ মৃত্যু নিয়ে ভাবতেন খুব। এমনকি তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর সম্ভবনার কথাও বলতেন পরিচিতদের। তবে সত্যতা যাই হোক, এটা এক ধরণের খুন। সমাজ কতৃক একজন লেখককে খুন, দারিদ্র দিয়ে একজন কবিকে খুন।
জীবনানন্দ বেঁচে থাকবে আরো হাজারকাল, এ কথা নতুন করে বলা অর্থহীন। জীবনানন্দ দাশ নামটি আসলে দুই ধরণের কবিতা- একটা হচ্ছে তাঁর লেখা কবিতা, আর ব্যক্তি জীবনানন্দের জীবন নিজেই একটি কবিতা।
যে কবির জীবনও কবিতা, তাঁরতো মরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:৫৫