নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে আসিফের। অথচ সে কিছুই করেনি। কিছু করার মত অবস্থাতেও নেই। কারন তাকে এখন টারজানের ভূমিকায় অভিনয় করতে হচ্ছে। টারজান যেমন জঙ্গলে গাছের লম্বা লম্বা লতায় ঝুলে থাকে, আসিফও তেমনি লোকাল বাসে একহাতে ওপরের স্ট্যান্ড ধরে ঝুলে আছে। আক্ষরিক অর্থেই ঝুলে আছে। কারন তার পা ঠিক মেঝেতে নেই, কিসের উপর তাও পরিস্কার না। বাসে ভীষন ভীড়। তার উপরে আবার ভ্যাপসা গরম, ঘামের তীব্র কটু গন্ধ। সামনে-পেছনে-ডানে-বামে কোনদিকেই একচুল ফাঁকা জায়গা নেই। আসিফ নিশ্চিত এই ভীড়ের মধ্যে ওপর থেকে সুঁই ছেড়ে দিলে তা মেঝেতে পড়বে না, কোথাও না কোথাও ঠিকই আটকে যাবে।
ঢাকা শহরে অসংখ্য রুটে নাম জানা-অজানা-লোকাল-নামে সিটিং-কাজেও সিটিং-বাইরে টিকেট-ভেতরে টিকেট এমনি কতশত বাসের ছোটাছুটি। একেকটা বাস যেন একেকটা চলন্ত থিয়েটার। কতরকম নাটক যে এইসব বাসে বাসস্থ হয়- কে হিসাব রাখে? সিটের জন্য কাড়াকাড়ি, ভাংতি নিয়ে মারামারি, মহিলা সিটে বসা পুরুষদের ঝাড়াঝাড়ি। দাঁড়িয়ে থাকা তরুনীকে সিট ছেড়ে দেয়া যুবক, দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দিকে কিছু অন্যমনষ্ক মানুষের কাছিয়ে আসা, হাজার যুদ্ধবিগ্রহ উপেক্ষা করে পেছনের দিকের সিটে বসা প্রেমিক যুগলের গুটুরগুটুর প্রেম। এত এত নাটক- একেবারে বিনামূল্যে। শুধু চোখ-কান একটু খোলা রাখা চাই।
টাকমাথার ভদ্রলোকটি আবারো আসিফের দিকে তাকালেন। এবং আসিফ আবারো ‘চোর চোর’ বোধ করল। ভদ্রলোকের নাকের নিচে বাটারফ্লাই গোঁফ। আসিফ ভেবেছিল এই গোঁফে হিটলার আর চার্লি চ্যাপলিন ছাড়া আর কাউকে মানায় না। এখন দেখছে তার অনুমান ভুল। এই ভদ্রলোককেও বেশ মানিয়ে গেছে। তার চেহারাতেও একটা হিটলার হিটলার ভাব আছে। ভদ্রলোক পেছনের মানিব্যাগের পকেটে হাত বোলালেন। যেন দেখলেন মানিব্যাগটা ঠিকমতো আছে কিনা। হিটলার ভদ্রলোক আসিফের ঠিক সামনেই ঝুলছেন। একহাতে ব্যাগ। অফিসফেরত চাকুরীজীবি হয়ত।
ঘটনাটা হল এই যে- একহাতে ঝুলতে ঝুলতে হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আসিফের। টনটন করছিল হাতটা। এইভাবে কতক্ষন ঝোলা যায়। সেওতো মানুষ, এটাতো তার বাঁদুড়জন্ম না। তাই হাত বদল করে স্ট্যান্ড ধরার সময় হয়ত একটা হাত লেগে গিয়েছিল ভদ্রলোকের পেছনে, ঠিক যেখানে তার সবুজ আর মোটা মানিব্যাগটি উঁকি দিচ্ছিল। গুপ্তধনে অযাচিত স্পর্শ পেয়ে প্রায় সাথে সাথেই হিটলার স্পর্শকাতর হয়ে ওঠেন। আর সম্ভাব্য পকেটমারের চেহারা দেখতে তার মোটা এবং ভাঁজযুক্ত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। আর আসিফতো তাকিয়েই ছিল। ফলাফল- হাতেচোখে ধরা। ভদ্রলোক চোখের তপ্ত দৃষ্টি হেনে বুঝিয়ে দিলেন, ‘আমার সাথে এসব চলবে না বাপু। তোমার দিকে আমার নজর থাকল।‘ এরপর থেকেই আসিফের নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে। সে ভীড়ের মাঝে এদিক সেদিক সরে যাবার চেষ্টা করে। পারে না। চারদিকে সব জীবন্ত স্ট্যাচু।
আসিফ নামবে শুক্রাবাদ। ছোটচাচার বাসায় যাবে। উদ্দেশ্য- বাবার কিছু কাগজপত্র দিয়ে আসা। নিতান্তই তুচ্ছ কাজ। তবে গৃহপালিত বেকারদের জন্য কোন কাজই তুচ্ছ না। সব কাজই গুরুত্বপূর্ন। ছোটচাচার বাসায় যাবার অনেকরকম যন্ত্রনা আছে। সবচে বড়টা হল- ছোটচাচীর বানানো চা নামক বস্তুটা পান করা। সেই চায়ের কথা মনে পড়তেই তার চোখ-মুখ আপনা আপনি কুঁচকে ওঠে। এই চা না খেলে কেউ আসলে বুঝতে পারবে না যে চা জিনিসটা এতটা বিস্বাদ হতে পারে। কতকটা কুসুম কুসুম গরম পানি যার ফোঁটায় ফোঁটায় চিনির রাজত্ব- ঘন সিরাপ জাতীয় আঁঠালো পদার্থ। চিনির সিরাপ হলেও জিনিসটার স্বাদ তিতা। চিনি দিয়ে ছোটচাচী কিভাবে একে তিতা করেন তা এক রহস্য। এই রহস্যটা জানতে খুব ইচ্ছে করে আসিফের।
ভদ্রলোক আবার আসিফের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ঘৃনা। এই ঘৃনার উৎস কি কে জানে। ভালো যন্ত্রনায় পড়া গেল। আসিফ মনে মনে ভাবে। এদেশের মানুষের হচ্ছেটা কি? সবার বিশ্বাসের লেভেলটা দিনকে দিন নিচে নামছে। সবাই সন্দেহবাতিক হয়ে যাচ্ছে কেন। কারো দিকে তাকিয়ে হাসবেন? ভাববে নিশ্চয়ই কোন বদমতলব আছে। বাসে বসে কোথাও যাচ্ছেন? পাশের জন কিছুক্ষন পর পর পকেটে হাত দিয়ে দেখে নেবে মোবাইলটা ঠিকঠাক আছেতো? জাতি হিসেবে আমরা কি দিন দিন নিচু মনের হয়ে যাচ্ছি? জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কি জাতির মনের ক্ষেত্রফলটাও কমে যাচ্ছে? হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে আসিফ গেটের দিকে এগুতে চায়। সামনেই শুক্রাবাদ। নামতে হবে।
বাস থেকে নেমে আসিফের মনে হল চার বছরের সশ্রম কারাদন্ডের মেয়াদ শেষে সে মাত্র জেলখানা থেকে বের হয়েছে। বুক ভরে শহরের সীসা মেশানো বাতাসে ফুসফুস ভর্তি করতে করতে পকেটে হাত চলে যায় আসিফের। সবুজ স্বাস্থবান মানিব্যাগটা বের করে আনল। ভেতরের মশলা কেমন আছে কে জানে। টাকমাথা হিটলারের মুখটা মনে আসতেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায় তার। আসিফ ঠোঁট গোল করে শিস দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সামনে এগুতে থাকে। হাসি এবং শিস একসাথে যায় না।