ময়লা আকাশের দিকে চেয়ে ছোট কিন্তু অগভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো পরীবানুর। আকাশে কুৎসিত কালো মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাকেই যেন ভেংচি কাটছে মেঘগুলো। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। বৃষ্টি মানেই একটা যন্ত্রনা। কঠিন শাস্তি। প্রকৃতির শাস্তি। বস্তির এইদিকটা খানিক নিচু। মিনিট পাঁচেকের বৃষ্টিতেই দুয়ার পর্যন্ত পানি উঠে যায়। ঘর থেকে বেরুবার উপায় থাকে না। রুগ্ন চার দেয়ালের ভেতরেও একটা ছোটখাট আযাব নামে। আর মেঝেতে মাঝারি ধরনের বন্যা হয়ে যায়। মাটির মেঝেতে কাদাপানি জমে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়। ভাবতেই তার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার।
তার মনের আশঙ্কা বুঝতে পেরেই হয়তবা বড়বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে। পরীবানু নিজের অজান্তেই আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই বৃষ্টি হারুন সাহেবদের জন্য নামে, তাদের জন্য না। বৃষ্টি হলেই সেই বাসায় কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব আসে। ছোট খালামনি স্কুলে যায় না। বড় খালামনিরও ভার্সিটির ক্লাস হয় না তখন। আর খিঁচুড়ি রান্না হয়। হলুদ রঙের খিঁচুড়ি থেকে ছাইরঙ্গের ধোঁয়া ওঠে। সেই ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে না, কিন্তু মুখের ভেতরটা ভিজে যায়। পরীবানু হারুন সাহেবের বাসায় কাজ করে। তাই নিয়মমাফিক তার জন্যও কিছুটা বরাদ্দ থাকে। সে খায় না; খিঁচুড়ি নিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করে। সে জানে তিনটা শুকনো মুখ মেঝেতে কাদাপানি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
পরীবানুর মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয় হারুন সাহেবদের কোন এক বৃষ্টির দিনে বস্তির এই ঘরে এনে রাখে। যদিও এই দৃশ্যটা কল্পনা করলেই তার হাসি পেয়ে যায়। হারুন সাহেব একটা কোম্পানির বড় অফিসার। তাদের দুইটা গাড়ি আছে। একটা লাল, অন্যটা ময়লা। পরীবানু বোঝে না এতগুলো টাকা দিয়ে মানুষ ময়লা রঙের গাড়ি কেনে কেন। দেখতে যদিও খারাপ লাগে না। দামী জিনিসে কাদা মেখে রাখলেও দেখতে সুন্দর লাগে। এটাই নিয়ম।
শরীরটা ভালো না, তাই বেলা পার হয়ে এলেও আজকে এখনো কাজে যেতে পারেনি পরীবানু। সকাল থেকেই বিছানায় পড়ে আছে। উঠে বসার শক্তিটাও নেই। ইদানিং প্রায়ই শরীরটা দুর্বল থাকে, আগের মত আর খাটতে পারে না- বয়সের দোষ। অথচ এখনই শরীরটা শক্ত থাকার দরকার ছিল। সংসারে ভাত আনার হাত বলতে পরীবানুর হাতদু'টিই। এই হাত দু'টাও অচল হয়ে গেলে বাঁচার আর উপায় থাকবে না। অবশ্য এখনো যে বাঁচার খুব বেশি উপায় আছে তা না। অথচ বছর খানেক আগেও তারা বেশ ভালোই ছিলো। তারিফ আলী রিকশা চালিয়ে যা পেত তাতে পড়া না জুটলেও, অন্তত দুইবেলার খাওয়া জুটত। এক্সিডেন্টে তারিফ আলীর পা যাওয়ার পর থেকেই সংসারটা প্রায় অচল হয়ে আছে। তারিফ আলী এখন একটা ময়লা কাঁথা জড়িয়ে সারাদিন শুয়ে থাকে আর কারনে-অকারনে গালাগালি করে। এই লোকটা আগে এমন ছিল না। পা হারানোর পর থেকেই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেছে। কাউকেই আর সহ্য করতে পারে না। সারাটাদিন কাঠের বিছানার সাথে আটকে থাকতে থাকতে তার মনটাও হয়ত কাঠের হয়ে গেছে। খড়খড়ে শুকনো কাঠ। সেই কাঠের প্রান নেই।
চালের উপর বৃষ্টির ধারালো কামড় টের পাওয়ার সাথে সাথেই বড় মেয়ে পারুল ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বৃষ্টি আসলে টিনের চালের ফুটা বরাবর পাতিল বসানো তার কাজ। তাতে মেঝেতে বন্যা হওয়ার আগে কিছুটা সময় পাওয়া যায়। সে পাতিলগুলো টিনের চালের ছিদ্র বরাবর মেঝেতে রাখে। একটা করে পাতিল বসিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে। পাতিলের ভেতর বৃষ্টির ফোঁটা টপ করে পড়ার শব্দ শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে আরেকটা পাতিল নিয়ে অন্যদিকে এগোয়। এ কাজ সে বহুবছর ধরে করছে। তাই এ ব্যাপারে তার বহুবর্ষার অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র অভ্যাসের বশে তার কান পাতিলে পানি পড়ার শব্দের জন্য অপেক্ষা করে। এই কাজটা পারুলের বেশ লাগে। একটা খেলা মনে হয়। শব্দ ধরার খেলা।
'মা, খিদা লাগছে'
রাশেদ পরীবানুর হাত ধরে। ভাবে মা হয়ত কিছু খেতে দেবে। ছেলেটার শরীরের হাড় গোনা যায়। গায়ের গেঞ্জিটার কাঁধের কাছে একখাবলা তালি দেয়া। শুকনো মুখটা অপরিষ্কার। তবু পরীবানুর বড় মায়া লাগে। রাশেদ মায়ের কাছ থেকে কোন একটা উত্তর আশা করেছিল হয়ত। পরীবানুকে নীরব দেখে আগের কথাটাই আবার বলে। হয়ত আরেকটু করুন সুরে বলার চেষ্টা করে। যদিও তা যথেষ্ঠ করুন হয় না। শুকনো গলা করুন হতে চায় না। কেমন একটা ঝাঁঝ লেগে থাকে; ক্ষিদের চোটে গলাটাও বুঝি গায়ের চামড়ার মত খসখসে হয়ে গেছে।
'ঘরে কিছু নাই। দেখস না কামে যাইতে পারি নাই। খানা কি আসমান থেইকা পড়তাসে?' পরীবানুর মনের মায়াটা মুখ পর্যন্ত আসে না। পেট খালি থাকলে মনের মায়া অলীক ছায়া হয়ে উড়ে যায়। রয়ে যায় ঝাঁঝটা। সেটা চোখে আটকে পড়া বালির মত খচ খচ করে।
রাশেদ মায়ের মুখে এমন উত্তর আশা করে নি হয়ত। সে চুপসে ঘরের অন্যকোনায় চলে যায়। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বোতলের একটা ছিপি ফুটো করার চেষ্টা করে। পাশেই একফালি সুতো রাখা। নতুন ধরনের কোন খেলনা তৈরীর প্রস্ততি হয়ত। পরীবানু সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তার মায়া লাগে। দুয়েকটা ভালো কথা বলতে চায় ছেলেটাকে। মুখে আসে না। শুকনো মুখের কথাও শুকনো হয়। ছেলেটার নিশ্চয়ই অনেক ক্ষিদে পেয়েছে। এতটুকুন বাচ্চা, কতইবা সহ্য করতে পারে। একটু আগের খেঁকিয়ে ওঠার জন্য মনে মনে নিজেকে একটা বিশ্রী গালি দেয় পরীবানু। মনে মনে মাফ চায়। পরীবানু নিজেওতো আগে এমন ছিল না। একজন মা ছিল। অভাব খুব খারাপ জিনিস। মানুষকে বদলে দেয়, খুব খারাপভাবে বদলে দেয়।
বাইরে অন্ধকার পা টিপে টিপে গাঢ় হয়ে আসে। সেই অন্ধকারে অশুভ ছায়া- যেন সবাইকে গিলে খাবে। ঘরের ভেতরকার কুপিটা জ্বলছে যদিও, তবু একলা কুপি সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। বরঞ্চ দুর্বল আলোয় অন্ধকারটা আরো জমাট বাধে। পরীবানুর মনে হয় অন্ধকার কোন খাওয়ার জিনিস হলে ভালো হত। সকাল থেকে চারটা প্রানীই না খেয়ে আছে। একটা ভাতের দানাও না। ঘরে আর কিছুই নেই। শেষ যেটুকু ছিল কাল রাতেই সবাই মিলে সাবাড় করেছে। অন্ধকার খাওয়া গেলে বেশ হত। একথালা অন্ধকার আর এক গ্লাস বৃষ্টির পানি খেয়ে সে রাশেদ আর পারুলকে নিয়ে শুয়ে থাকত। রাশেদটা হয়ত উশখুশ করত, মুখে কিছু বলত না। বিরক্ত হলেও তার গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকত। পরীবানু বুঝতে পেরে মনে মনে হাসত। মন ভালো থাকলে সে হয়ত কোন গল্পও শোনাত। সাত ভাই আর চম্পাটার গল্প। কিংবা অন্য কোন গল্প।
পরীবানু মিটিমিটি চোখে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। কুপির লোমশ আলোয় তাকে একটা মূর্তি বলে মনে হয়। সে হয়ত তখন কাজে না যাবার জন্য মনে মনে নিজেকে গাল দিচ্ছিল। হারুন সাহেবের বাসায় আজকেও নিশ্চয়ই খিঁচুড়ি রান্না হয়েছে। হলুদ আর ধোঁয়া ওঠা। এই অন্ধকারে সে চাল আর ডাল একসাথে সিদ্ধ হওয়ার গন্ধ পায় নাকে। কি মিষ্টি গন্ধ। খিঁচুড়ির গন্ধই বোধহয় জগতের সবচেয়ে সুন্দর গন্ধ। ভাবতে ভাবতে তার জিভে জল এসে যায়। ছেলেমেয়ে দু'টোকে ডেকে ওদেরকেও খিঁচুড়ির কথা ভাবতে বলতে ইচ্ছা করে পরীবানুর। তাতে গন্ধ পাওয়া যায়। তাই বা খারাপ কিসের।
ঘরের অন্যপ্রান্তে তারিফ আলী উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে আছে। এই ঝড়-বাদলাতেও বিকারহীন। ময়লা জীর্ন কাঁথাটা জড়িয়ে খিদে পেটে শুয়ে আছে বেচারা। কাল রাতেও খায় নি। খেতে বসার আগেই ভাতের হাড়িটা শূন্য হয়ে গেল। কেউ হয়ত জিভের ফাঁদে পড়ে দু'টি ভাত বেশিই খেয়ে ফেলেছিল। মানুষটার এই এক স্বভাব- মরে গেলেও কাউকে কিছু বলবে না। লোকটার বুকে কফ জমা। মাঝে মাঝে কাশির দমকে মরে যাবার মত হয়। পরীবানু জানে সকাল সকাল একটু চা হলে বুকের আরাম হয় কিছুটা। কিন্তু সেকথা তারিফ আলী কখনোই বলবে না। সে কিছুই বলে না। সামনে শীত আসছে। শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে কাশিটাও বেড়ে যাবে। গত শীতটা ভয়ানক কষ্টে গেছে। পরীবানু ভাবে মাসে মাসে আর কয়টা টাকা বেশি পেলে সে সবার প্রথমে তারিফ আলীর জন্য একটু চা এর ব্যবস্থা করবে। কিছু বাড়তি টাকা খুব প্রয়োজন। সব জিনিসের দাম বাড়ন্ত। হারুন সাহেবকে আর কয়টা টাকা বাড়িয়ে দিতে বলবে সে। অবশ্যই বলবে।
অবশ্য হারুন সাহেবকে এ কথা আগেও বলেছে পরীবানু। ভদ্রলোকের স্ত্রী দিনের অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকেন না বলে সব কথা তাকেই বলতে হয়। তার স্ত্রী নানান সমাজসেবামূলক কাজ করেন। নির্যাতিত ও দুস্থ মহিলাদের উন্নয়ন নিয়ে তাকে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়। সমস্যা হল- হারুন সাহেবের সামনে যেতে পরীবানুর অস্বস্তি হয়। লোকটার চেহারায় একটা ইঁদুরভাব আছে। আর কথা বলার সময় তার চকচকে চোখগুলো মুখ থেকে পিছলে নিচের দিকে নেমে যায় বারবার। যেন কতদিন ধরে না খেয়ে আছে। চুলের অনেকটা অংশে পাক ধরা পরীবানুর কলজে পর্যন্ত নড়ে যায়। একটা ভয় মাথা থেকে হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত তিরতির করে ছড়িয়ে যায়।
ক'দিন আগেই হারুন সাহেবকে বেতন ক'টা টাকা বাড়িয়ে দিতে বলেছিল পরীবানু। সেদিনও তার স্ত্রীর কি একটা মিটিং ছিল। হারুন সাহেব পেপার পড়ছিলেন। দেশের নানান খারাপ ঘটনায় তাকে প্রায়ই চিন্তিত থাকতে দেখা যায়। কখনো কখনো 'দেশটা রসাতলে গেল' বলে আর্তনাদ করে ওঠেন। পরীবানুর গলা শুনেই পেপার থেকে চোখ তুললেন। এবং যথারীতি চোখটা মুখের দিকে থাকে না, ঘোরাফেরা করে। এবং পরীবানু বরাবরের মতই শিউরে উঠেছিল। হারুন সাহেব বেতনের কথা শুনে হাসলেন। হাসিও যে কুৎসিত হতে পারে পরীবানু আগে জানত না।
'বেতন বাড়াতে চাও?
'জ্বী'
'তোমার একটা মেয়ে আছে না? পারুল না কি যেন নাম?'
পরীবানু চমকে ওঠে। গত ঈদে পারুলকে নিয়ে এ বাসায় এসেছিল একবার। এই লোক সেটা মনে রেখেছে। নামও মনে রেখেছে। তার কেমন জানি অস্বস্তি লাগে।
'পারুল'
'ওকে কাজে দাও না কেন? তোমার বয়স হয়ে গেছে। তুমি আর কি কাজ করবা?' হারুন সাহেব থামলেন। একটা তেলতেলে হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার মুখে।
'ওরে এইখানে কাজে দাও। টাকা-পয়সা বেশ বাড়িয়েই দিব। চিন্তা কোর না।'
সাহেবের চকচকে চোখ দেখে পরীবানু কথা বাড়ায় না আর। সরে আসে। মানুষটাকে তার ঘেন্না লাগে। সেয়ানা মেয়েটাকে ঐ বাড়িতে কাজে দিতে মন সায় দেয় না। তাই বেতন বাড়ানোর কথা আর মুখেও তুলে নি কোনদিন। চেপে গেছে।
দরকারে না খেয়ে থাকবে, তবু পারুলকে ঐ বাসায় কাজে দেবে না সে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। পারুলটাকে ঐ লোকের সাথে একলা বাসায় ভাবতেই তার দমবন্ধ ভাব হয়, নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে। ঐ ইঁদুরমুখার কথাতে কিছু একটা খারাপ ভঙ্গি আছে। ভঙ্গিটা খুব একটা অচেনা না। প্রথম প্রথম কাজে গিয়ে পরীবানুর এমন ভঙ্গির সাথে পরিচয় হয়েছিল। কি নাম ছিল ভদ্রলোকের? মনির বা জহির কিংবা সোহেল, তার মনে পড়ে না ঠিক। তবে ভদ্রলোকের বুকের কাছে একটা কাটা দাগ ছিল। গভীর আর কালচে দাগ। মাঝে মাঝেই তাকে দাগটা খুব কাছ থেকে দেখতে হত। না দেখে উপায় ছিল না। সেটা এমনি এক বৃষ্টির দিনের কথা। বাসার সবাই কোথাও গিয়েছিল। পরীবানু তখনো বৃষ্টির জন্য বেরুতে পারে নি। আকাশ শুকনো হবার অপেক্ষা করছিল।
একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আচমকা তাকে বেঁধে ফেলেছিল। বড় কঠিন সে বন্ধন। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই সে তার শরীরের উপর আরেকটি শরীরের উত্তাপ টের পায়। অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল বোধহয়, হয় না। তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। অনেকটা জীবন্ত মানুষকে বস্তায় আটকে ফেললে যেমন দমবন্ধ লাগে তেমন। একমুহূর্তের জন্য পরীবানুর মনে হয়েছিল সে মারা যাচ্ছে। কিন্তু শরীর এত সহজে মরে না। পরীবানু মরে না, তার শরীর মরে না, বরং মাতাল সাগরের ঢেউয়ের মত কেঁপে কেঁপে ওঠে। নিজেকে তার হয়ত তখন সাগর মনে হয়েছিল, যার স্রোতের মাথায় মাথায় ফিনকি দেয়া রক্তের ধারা। সাগর যখন শান্ত হয়ে আসে, তার সৈকতে পড়ে থাকে কষ্টকাঁকড়ার দল। তাদের দলে অপমান ছিল, যন্ত্রনা ছিল। ছিল না শুধু জীবনের গন্ধ। সামান্য পরে তার নিথর হয়ে পড়ে থাকা ক্লান্ত হাতের মুঠোয় কিছু কাগজ গুঁজে দেয়া হল। পরীবানু না তাকিয়েও বুঝতে পারে- কাগজগুলো টাকা, টাকাগুলো শক্ত করে ধরে রাখে সে। তার খুব শব্দ করে হাসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু নিতান্তই ভদ্রলোকের বাসা বলে হাসে না, শুধু চোখ হতে দু'টি সরলরেখা চিবুক বেয়ে হেঁটে যায়, তারা কেন হাঁটে পরীবানু জানা নেই। জানা ছিল না।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। আকাশটা অন্ধকার গায়ে মেখে গর্জন করে চলে অবিরত। মনে হচ্ছে এখনই পৃথিবীতে রাত নেমে এসেছে। অনন্ত-অসীম অন্ধকার। কখনো এই অন্ধকার দূর হবে বলে মনে হয় না। পরীবানুর নিজেকে ভীষন অসহায় লাগে। তারিফ আলী এখনো অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে। গায়ে ছেঁড়া কাথাটা জড়িয়ে অল্প অল্প কাঁপছে লোকটা। হয়ত জ্বর এসেছে। টাকা হলে মানুষটাকে একটা রেডিও কিনে দেবে পরীবানু। সারাদিন শুয়ে থাকে বেচারা। একটা কিছু থাকলে তাও সময় কাটে। আর রাশেদকে একটা বড় চকলেট কিনে দেবে। ছেলেটার অনেকদিনের বায়না। রাশেদের দিকে তাকাল পরীবানু। কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে ছোকড়া। মুখটা হাসি হাসি। সে কি স্বপ্ন দেখছে? বড় চকলেটের স্বপ্ন? হয়তবা।
নিচুস্বরে পারুলের নাম ধরে ডাকে পরীবানু। ডাক শুনে মেয়েটা পাশে এসে বসল। পারুলকে সুন্দর লাগছে। রঙটা অবশ্য একটু চাপার দিকে। তবে চেহারাটা বড় মায়া মায়া। মুখের কোনে সরল একটুকরো হাসি। দেখে বড় ভালো লাগে। এই সেদিনকার ছোট মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। ছোট ছোট আঙ্গুল, সরু হাত, রেশমের মত চুল, ফোকলা দাঁতে আধো আধো কথা বলা... সময় কত দ্রুত যায়।
'মা কিছু বলবা?'
পারুলের কথা শুনে পরীবানুর বাস্তবে ফিরে আসলো। কথাটা বলার আগের মনের ভেতর আরেকবার নাড়াচাড়া করে নেয়।
'...কালকে থেইকা তুই হারুন সাবদের বাড়িত কামে যাবি, মা।'
পরীবানু যেন ঘোরের মাঝে শব্দগুলো বলে চলে। বলতে বলতে তার কল্পনায় নানা দৃশ্য ভাসে। সেগুলোর কোনটাতে হারুন সাহেব আর পারুলের নগ্ন দেহ, কোনটাতে পারুলের চোখ ভেজা, কোনটাতে... ছিঃ। পরীবানু চোখ বন্ধ করে কল্পনা মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করা গেলেও মন বন্ধ করার উপায় না জানা থাকায় সে পুরোপুরি সফল হয় না। মাথার ভেতর কল্পনা তিরতির করে কাঁপতে থাকে।
'আমার শরীর যে আর চলে না...'
পরীবানুর গলাটা কি ধরে আসে? বৃষ্টির অবিরত শব্দে তা ঢাকা পড়ে যায়। বাইরে বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতিও হয়ত চায় না তার কষ্ট ধরা পড়ুক। কারন প্রকৃতি অসুন্দর পছন্দ করে না, লুকিয়ে রাখে। খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখে।