***
তার দিকে ফিরতি হাসি দিয়েই ভুলটা করেছিলাম।
আলো-আধারির লুকোচুরি। মানুষজন আজকে একটু কম। লোকটা বসে ছিল আমার পাশের টেবিলেই। হাতে গ্লাস। তাতে খয়েরি রঙের পদার্থের নড়াচড়া। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। একটা ফিরতি ছোট হাসি ফিরিয়ে দিয়েই ভুলটা করলাম। সে আবার হাসল। বুঝলাম ব্যাটা পুরোপুরি টাল হয়ে আছে। আমি বোকার মত হাসি হাসি মুখ করে অন্যদিকে তাকালাম। মাতাল কাউকে বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই। শব্দ করে চেয়ার টানার আওয়াজে কিছুটা চমকে উঠলাম। না তাকিয়েও বুঝতে পারি আমার সামনে এসে বসেছেন মহান টাল পুরুষ। কি যন্ত্রনা। পুলিশ আর পাগলের দিকে তাকিয়ে হাসতে নেই জানতাম। সেই তালিকায় দুনিয়ার সব মাতালকেও নিয়ে নিলাম।
মাঝে মাঝে এখানে আসি। পেটে কিছু পানি দিই। খানিকটা টলমল পায়ে চলে যাই- এটুকুই। কারো সাথে কথা হয় না তেমন। তাছাড়া কথা বলতে তেমন ভালোও লাগে না আমার। শুনতেও না। অস্বস্তি লাগে।
'আসসালামুয়ালাইকুম'
সালামের শব্দে লোকটার দিকে তাকালাম। চারকোনা ফর্সা গালে বসন্তের দাগ। অস্পষ্ট আলোতেও স্পষ্ট দেখা যায়। এছাড়া আর তেমন কোন বিষেষত্ব নেই। আমি আবার হাসলাম। তার সাথে যতক্ষন পারা যায় 'হাসিথেরাপি' চালানোর ইচ্ছা।
'সালামের জবাব দেয়া সুন্নত। আপনি কি হিন্দু নাকি?'
হাতে ধরা গ্লাস নাড়ি। মাথা নাড়ি। পাশাপাশি। আমি হিন্দু না। গরু খাই। গরুর মাংস বেশ পছন্দের। চালের রুটির সাথে ঝাল ঝাল মাংস। সাথে গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজ। এসব কথা মনে পড়তেই কিছুক্ষন আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া ক্ষুদা-শিশুটা জগতবিদারী কান্নার আওয়াজ তুলে কাঁদতে লাগল।
হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়ির কাটার মাথায় চেপে রাত কম হয় নি। বাসায় ফেরা দরকার। কাজের ছেলেটার উপর ভরসা নেই। রাত বেশি হলে ঘুমিয়ে পড়বে। আর একবার ঘুমিয়ে গেলে ক্রেন দিয়ে দরজা ধাক্কালেও তার মৃতঘুম ভাঙবে না। একবার টানা দেড়ঘন্টা দরজা ধাক্কিয়েও তার ঘুম ভাঙ্গাতে পারি নি। আরেকবার সোলেমান ডিম ভাজতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি যখন পোড়া গন্ধ পেলাম, রান্নাঘরে গিয়ে দেখি তাওয়ার উপর ডিম কয়লা হয়ে আছে। শক্ত আর কালো।
কথা বলছিনা। বলা উচিৎ। ইচ্ছা করছে না।
'একটা গল্প শুনবেন?'
অবাক হলাম। লোকটি কি নির্বোধ নাকি তার লজ্জাবোধ কম বুঝতে পারলাম না।
'বোধহয় বিরক্ত হচ্ছেন। আমি একটা গল্প বলেই বিদায় নিব।'
'আরে না না।' ভদ্র আমি, নিরীহ নিপাট।
লোকটা আমার দিকে ঝুঁকে এল।
'আপনি কখনো সামনা-সামনি কোন খুনী দেখেছেন?'
'খুনী মানে?' আকাশ থেকে পড়লাম। লোকটা অসুস্থ নাকি। এরতো চিকিৎসা হওয়া দরকার।
'খুনী মানে দ্য মার্ডারার। যে খুন করে। অবশ্য এর একটা সুন্দর বাংলা আছে। হন্তারক।'
মাথা নাড়লাম। আমার এরকম সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটিই হয় নি। আমি কখনো সামনা-সামনি খুনী দেখিনি।
লোকটি খুশি হল যেন। 'তাহলেতো কোন খুনীর সাথে মুখোমুখি বসে মদ্যপানও করেননি কখনো। তাই না?'
চমকে উঠলাম। লোকটা নিজের কথা বলছে নাতো। বুক টিপটিপ করে। হয়ত অসুস্থ কোন সিরিয়াল কিলারের সাথে বসে আছি। বা হয়ত তেমন কিছুই না। আমাকে সামান্য ভয় খাইয়ে মনযোগ আদায়ের চেষ্টা। বা হয়ত নির্বোধ রসিকতা। বুদ্ধিহীন লোকদের রসিকতা তীব্র হয়।
যাই হোক মনের খচখচভাব দূর হলো না। গলায় কাঁটার মত বিধে থাকল। ঢোক গিলতে গেলেই অস্বস্তি। ভদ্রলোক খয়েরি রঙের পদার্থ গলায় ঢালতে ঢালতে তার গল্প শুরু করলেন। তরল পদার্থটিকে কালো বর্নের মনে হতে থাকে। ভয় পেলে কি মানুষের রংবোধের পার্থক্য হয়? হয়ত হয়। কে জানে।
***
চার বছর আগে মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়। প্রেম করে আরেঞ্জ ম্যারেজ। দুপক্ষের সম্মতিতে। এসব ক্ষেত্রে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে সাধারনত প্রেমের নদীতে চর জাগে। আমার ক্ষেত্রে ঘটল উল্টো কাহিনী। আমার প্রেম গেল বেড়ে। মিলিরও। বৌয়ের হাত ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। মনে হত হাত ছেড়ে দিলেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। ঘর ছেড়ে বের হতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে তীব্র আনন্দে মরে যেতে ইচ্ছা করে। অসহ্য সুখে বুক চিনচিন করে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। মাঝে মাঝে মিলির সাথে টুকটাক ঝগড়া যে হত না তা না। তবে একটুপরেই মিলমিশ হয়ে যেত। যেভাবে চিনির দানা পানিতে হারিয়ে যায়।
ভদ্রলোক থামলেন। একচুমুকে গ্লাসটা সাদা করে আবার শুরু করলেন। আধো আলোতে তার চোখ চকচক করতে থাকে প্রভুভক্ত কুকুরের মত। মনে মনে ভদ্রলোকের গুছিয়ে কথা বলায় মুগ্ধ হই। প্রথমদিকে যতটুকু বিরক্ত লাগছিল তাকে এখন ততটা লাগছে না আর।
একদিনের কাহিনী। আমি আর মিলি নিউমার্কেট গেলাম। এক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনের উপহার কিনব। ফেরার সময় সাজিদের সাথে অনেকদিন পর দেখা হল। সাজিদকে চিনতাম না আমি। মিলি চিনত। ওর বন্ধু। অনেকদিন পর দেখা। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। টুকটাক কথা। চায়ের দাওয়াত। বিদায়। সাজিদ চা খেতে আসল একসন্ধ্যায়। আরেকদুপুরে আমাদের সাথে খাওয়ার দাওয়াত। এভাবেই টুকটাক। আমিও সাজিদকে পছন্দ করতাম খুব। আড্ডাবাজ, হাসিখুশি।
সময়ের সাথে সাথে কলিংবেলে সাজিদের হাতের ছাপ পড়তে থাকে দ্রুত। আমারও বেশ লাগে। ছেলেটা খুব সুন্দর করে জোকস বলতে পারে। আমি আর মিলি হেসে কুটিকুটি হই। সাজিদ যদি আপনাকে বলে 'রাতে খাবো না। খিদে নাই', আপনি ফিক হেসে দেবেন। আপনার মনে হবে 'খিদে নেই' এটার চেয়ে মজার কথা দুনিয়ায় খুব কমই আছে।
অনেকগুলো দিন কেটে যাবার পর কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মিলির হাসিটা আগের চেয়ে মলিন মনে হয়। ঠিক যেন ফুটছে না ঠোঁটের ধারে। আর মিলির হাতটা নিশ্চুপ নিশ্চুপ লাগে। শীতল আর প্রানহীন। খুব অসহায় লাগে। বুকটা ভারী ঠেকে। আপন কারো অবহেলা প্রচন্ডভাবে বুকে বিঁধে। আমার আবারো মরে যেতে ইচ্ছা হয়।
মাঝে মাঝে মিলির মুখে পুরনো হাসি ফোটে। আগের চেয়েও বেশ খানিক জ্বলজ্বল। বেশ লাগে দেখতে। আমি বিষন্নতার চাদর মুড়ি দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
'আপনি কারন জানতে চান নি?'
না। ভেবেছিলাম এম্নিতেই মন খারাপ। কিছুদিনপরই ঠিক হয়ে যাবে। ভদ্রলোক আবার বলতে শুরু করলেন।
আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। আজ সকাল থেকেই অসহ্যরকম মাথাব্যথা করছিল। মাঝেমাঝেই করে। ভেবেছিলাম সেরে যাবে। সারল না। অফিসে বসে বমিও করলাম একবার। বস ডেকে নিয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন। যদিও আমি আপত্তি করেছিলাম। ধোপে টিকল না। আমাকে যথেষ্ঠ স্নেহ করেন ভদ্রলোক।
ছুটি পেয়ে সোজা বাসায় চলে আসি। বাসার সামনে আসতেই একটা অস্বস্তিবোধ হয়। ম্যাজেন্টা কালারের একটা গাড়ি চার পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা আমি চিনি। সাজিদের গাড়ি। শূন্যবুকে হাতুড়ির ঘা পড়ে। আর মনের কোথাও অপরিচিত শিয়াল ডেকে ওঠে যেন। দারোয়ানের কাছ থেকে জানা গেল সাজিদ ইদানিং প্রায়ই এমন এমন সময় আসে।
কখন যে মাথাব্যথা মাথা ছেড়ে বিদায় নিয়েছে খেয়াল নেই। আমি তখন ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। চাবি দিয়ে যখন ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলি তখনো ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছিল। যেন ফেটে যাবে।
তার কন্ঠস্বর দুর্বল হয়ে আসে। ভদ্রলোক থামেন। তার চোখ কি চিকচিক করে ওঠে? হয়তবা। অন্ধকারে বোঝা যায় না পুরোপুরি। হঠাৎ চিকচিক চোখ চকচক করে। এই দৃষ্টি কেমন যেন ঘোলাটে; অপার্থিব। আমার কেন জানি একটা সাপের কথা মনে আসে।
'তারপর?' কিছুটা শঙ্কা আর ভয়মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। যেন শুনতেই পান নি। তিনি আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করেন।
'আপনি কখনো কারো গলা টিপে ধরেছেন? হাতগুলো তখন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর ভিক্টিম শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত জবরদস্তি করে শরীরের সবটুকু শক্তি একত্র করে। অ্যাটাকের আগে সুবিধাজনক পজিশন নিয়ে নিবেন। নইলে কিন্তু বিরাট ঝামেলা।'
ভদ্রলোক হাসলেন। শূন্য হাসি। আমার হাত ঠান্ডা হয়ে আসল।
তিনি খালি গ্লাস টেবিলে সাজাতে থাকেন।
'সবচেয়ে মজার জিনিস কি জানেন? ভিক্টিমের চোখ। প্রথমে চোখে থাকে অবিশ্বাস। এরপর ঘৃনা আর রাগ। তারপর আবারো অবিশ্বাস। একেবারে শেষ মুহূর্তেও সে ভাববে আপনি হয়ত তাকে ছেড়ে দেবেন; সে বেঁচে যাবে। চোখে বাঁচার আকুতি। কি হাস্যকর।'
হাস্যকর কথা বলেও ভদ্রলোক হাসতে পারলেন না। তার চোখ-মুখ উলটে আসল। উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালেন। বমি করবেন হয়ত।
আমি মূর্তির মত বসে থাকলাম। মাথায় আকাশ-পাতাল চিন্তা। একবার ভাবলাম এক দৌড়ে পালাই। আবার পরক্ষনেই তা বাতিল করে দিলাম। মাথায় নানাকথার আঁকিবুঁকি। একধরনের ভয় মেশানো বিষন্নতা আমাকে গিলতে থাকে হিসহিস শব্দ তুলে। পেটের ভেতর কিছু একটা নড়ে ওঠে। তবে সেটা ক্ষিদে না।
কতক্ষন এভাবে স্থানুর মত বসে ছিলাম জানি না। রিংটোনের কুৎসিত শব্দে বাস্তবে ফিরে আসলাম। যেন কানের ভেতর ককটেল ফাটছে। ভদ্রলোক ফোন রেখে গেছেন টেবিলের ওপর। ধরব না ধরব না করেও ফোনের দিকে হাত বাড়ালাম আমি। স্ক্রিনে কলারের নাম ভাসছে। মিলি। নামটা চেনা চেনা লাগে। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোনটা কানে ঠেকালাম।
'হ্যালো...' গলাটা বোধহয় কিছুটা কেঁপে ওঠে।
***
ভদ্রলোকের নাম জায়েদ। জায়েদ হাসান। জায়েদ সাহেবের গাড়িতে করেই বাসায় ফিরছি। জানালা দিয়ে অর্ধমৃত ঢাকা দেখতে দেখতে ঠোঁটে মুচকি হাসি ফোটে। বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে যেন আস্তে করে।
অতিরিক্ত অ্যালকোহলের সুবাদে ভদ্রলোক ঠিকমত দাঁড়াতে পারছিলেন না। তার স্ত্রী বেশ আন্তরিক মহিলা। চোখে বাচ্চাদের সারল্য। আমাকে বারবার করে ধন্যবাদ জানালেন জায়েদ সাহেবকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। ইদানিং নাকি ভদ্রলোক প্রায়ই মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফেরেন। আগে নাকি এমনটা ছিলেন না।
'বাসাতো চিনলেন। একদিন এসে চা খেয়ে যাবেন।' তার চোখে অকৃত্রিম আন্তরিকতা। মাথা নাড়ি। আসব।
করবোনা করবোনা করেও চলে আসার মুহূর্তে বেশ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম কথাটা।
'আচ্ছা সাজিদ নামের আপনার কোন বন্ধু আছে? মাঝেমধ্যেই বাসায় আসে।' আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
মহিলা অবাক হন। 'নাতো। এই নামেতো কাউকে চিনি না ঠিক। কেন?'
'না এমনি' একটা নিঃশ্বাস আর দুপদাপ পা ফেলে কোনরকমে নেমে আসি।
প্রশস্ত ফাঁকা রাস্তা। গাড়ি দৌড়ে চলে শোঁ শোঁ করে। শীতল বাতাস বুকের ভেতরটাও যেন ছুঁয়ে দেয়। বেশ সুখ সুখ লাগে। ঘড়ির দিকে না তাকিয়েও বোঝা যায় রাত কম হয়নি। সোলেমান ব্যাটা জেগে আছে কিনা কে জানে। থাকারতো কথা না।